আসসালামু আলাইকুম, আশা করি সবাই ভালো আছেন। আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় কুরবানী। আমরা আজকে জানবো, কুরবানীর ইতিহাস, উদ্দেশ্য, কুরবানী করার নিয়ম সহ কোরবানী রিলেটেড সকল গুরুত্বপূর্ণ মাসআলা জানার চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ।
সূচিপত্র
কুরবানী অর্থ কী?
আরবি করব বা কুরবান (قرب বা قربان) শব্দটি উর্দূ ও ফার্সীতে (قربانى) কুরবানি নামে রূপান্তরিত। এর অর্থ হলো-নৈকট্য বা সান্নিধ্য। কুরআনুল কারিমের কুরবানির একাধিক সমার্থক শব্দের ব্যবহার দেখা যায়।
কোরবানির ইতিহাস
মানব ইতিহাসের প্রথম কোরবানিদাতা হলেন আদি পিতা হজরত আদম (আ.)-এর পুত্র হাবিল (রা.) ও কাবিল।
দুনিয়ার প্রাথমিক অবস্থায় আদম ও হাওয়া (আঃ)-এর একটি ছেলে ও একটি মেয়ে একসাথে জন্মগ্রহণ করত। পরবর্তী গর্ভে অনুরূপ একটি ছেলে ও একটি মেয়ে জন্মগ্রহণ করত। তখন পূর্ব গর্ভের ছেলে মেয়ের সাথে পরবর্তী গর্ভের ছেলে-মেয়ের বিবাহ দেয়া হত।
হাবীলের যমজ বোন সুন্দরী ছিল না। কিন্তু কাবীলের যমজ বোন সুন্দরী ছিল। তৎকালীন শরীয়ত অনুপাতে হাবীলের বিবাহ কাবীলের যমজ বোনের সাথে আর কাবীলের বিবাহ হাবীলের যমজ বোনের সাথে হবার কথা। কিন্তু কাবীল তা মানতে অস্বীকৃতি জানাল।
আদম (আঃ) কাবীলকে বুঝালেন। কিন্তু সে বুঝতে চেষ্টা করল না। অবশেষে আদম (আঃ) উভয়কে আল্লাহ তা‘আলার নামে কুরবানী পেশ করার নির্দেশ দিলেন এবং বললেন: যার কুরবানী কবূল হবে কাবীলের যমজ বোন তার সাথে বিবাহ দেয়া হবে।।
প্রথম কুরবানীর ঘটনাঃ
হাবীল ছিল মেষওয়ালা, ফলে হাবীল একটি মোটা তাজা মেষ কুরবানীর জন্য পেশ করল। আর কাবীল ছিল কৃষক, সে কিছু গমের শিষ কুরবানীর জন্য পেশ করল।
আসমান থেকে আগুন এসে হাবীলের কুরবানী জ্বালিয়ে দিল, যা কবূল হবার নিদর্শন। কাবীলের কুরবানী গ্রহণ করা হল না। ফলে হিংসায় সে হাবীলকে হত্যা করার মনস্থ করল।
এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা বলেন: ‘আদম (আ.)-এর পুত্রদ্বয়ের বৃত্তান্ত আপনি তাদের শোনান। যখন তারা উভয়ে কোরবানি করেছিল, তখন একজনের কোরবানি কবুল হলো আর অন্যজনেরটা কবুল হলো না।…অবশ্যই আল্লাহ মুত্তাকিনদের কোরবানি কবুল করেন।’ (সুরা মায়িদা, আয়াত: ২৭)।
এতে প্রতীয়মান হয়, কোরবানি কবুল হওয়ার জন্য তাকওয়া, অর্থাৎ খোদাভীতির প্রয়োজন। লোকদেখানো কোনো ইবাদত আল্লাহ তাআলা কবুল করেন না।
কুরবানী নিয়ে হযরত ইসমাঈল ( আঃ) এর ঘটনাঃ
কোরবানির ইতিহাস পবিত্র কোরআনে এভাবে এসেছে: ‘হে আমার প্রতিপালক! আমাকে এক নেক সন্তান দান করুন। অতঃপর আমি তাকে এক সহিষ্ণু পুত্রের সুসংবাদ দিলাম, অতঃপর সে যখন তার পিতার সঙ্গে কাজ করার বয়সে উপনীত হলো, তখন ইবরাহিম (আ.) বললেন, “হে বত্স! আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, তোমাকে আমি জবাই করছি, তোমার অভিমত কী?” সে বলল, “হে আমার পিতা!
আপনি যা আদিষ্ট হয়েছেন, তা-ই করুন। আল্লাহর ইচ্ছায় আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের অন্তর্ভুক্ত পাবেন।” যখন তারা উভয়ে আনুগত্য প্রকাশ করল এবং ইবরাহিম (আ.) তার পুত্রকে কাত করে শোয়াল, তখন আমি তাকে ডাক দিয়ে বললাম: “হে ইবরাহিম!
আপনি তো স্বপ্নাদেশ সত্যই পালন করলেন!” এভাবেই আমি সত্কর্মশীলদের পুরস্কৃত করে থাকি। নিশ্চয় এটা ছিল এক সুস্পষ্ট পরীক্ষা। আমি তাকে মুক্ত করলাম এক মহান কোরবানির বিনিময়ে। আমি এটা পরবর্তীদের স্মরণে রেখে দিলাম।
পড়ুন – ঈদুল আজহা নামাজের নিয়ম ও নিয়ত
ইবরাহিম (আ.)-এর জন্য অভিবাদন! আল্লাহর পক্ষ থেকে শান্তি ও শুভেচ্ছা।’ (সুরা সাফফাত, আয়াত: ১০০-১১০)।
পবিত্র কোরআনে কোরবানি সম্পর্কে আল্লাহ যা যা বলেছেন
তোমরা আল্লাহর উদ্দেশ্যে হজ ও ওমরাহ পূর্ণ করো। কিন্তু যদি তোমরা বাধা পাও তবে সহজলভ্য কোরবানি করো। আর কোরবানি সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত মুণ্ডন করো না। কিন্তু অসুস্থতা বা মাথায় কোনো রোগের কারণে আগেই মস্তক মুণ্ডন করে ফেললে ‘ফিদিয়া’ বা প্রায়শ্চিত্ত হিসেবে রোজা রাখবে, কোরবানি বা সদকা দেবে। নিরাপদ পরিস্থিতিতে কেউ হজের আগে ওমরাহ করে উপকৃত হতে চাইলে সে সহজলভ্য কোরবানি করবে। কিন্তু যদি কেউ কোরবানির কোনো পশু না পায়, তবে সে হজের সময় তিন দিন ও ঘরে ফিরে সাত দিন, এভাবে মোট ১০ দিন রোজা রাখবে। মসজিদুল হারামের কাছে পরিবার-পরিজনসহ বাস করে না এমন লোকদের জন্য এ নিয়ম প্রযোজ্য। অতএব হে মানুষ! আল্লাহ-সচেতন হও। আল্লাহর ধর্মবিধান লঙ্ঘন হতে দূরে থাকো। জেনে রাখো, আল্লাহ মন্দ কাজের শাস্তিদানে কঠোর। (সূরা বাকারা, আয়াত ১৯৬)
কুরবানী সম্পর্কে কোরআনের আয়াতঃ
হে নবী! কিতাবিগণকে আদমের দুই পুত্র হাবিল ও কাবিলের ঘটনা ভালো করে বর্ণনা করো। তারা যখন কোরবানি করেছিল, তখন একজনের কোরবানি কবুল হলো। কিন্তু অন্যজনের কোরবানি কবুল হলো না। ক্ষিপ্ত হয়ে সে বলল, আমি তোমাকে খুন করবো। অপরজন বলল, প্রভু তো শুধু আল্লাহ-সচেতনদের কোরবানিই কবুল করেন। (সূরা মায়েদা, আয়াত-২৭)
হে নবী! ওদের বলুন, আমার সালাত, আমার কোরবানি, আমার জীবন, আমার মরণ-আমার সবকিছুই বিশ্বজাহানের প্রতিপালক আল্লাহরই জন্যে। তিনি একক ও অদ্বিতীয়। এ আদেশই আমি পেয়েছি। আমি সমর্পিতদের মধ্যে প্রথম।’ (সূরা আনআম, আয়াত ১৬২-১৬৩)
আমি প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জন্যে কোরবানিকে ইবাদতের জঅংশ করেছি। যাতে জীবনোপকরণ হিসেবে যে গবাদি পশু তাদেরকে দেয়া হয়েছে, তা জবাই করার সময় তারা আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে আর সব সময় যেন মনে রাখে একমাত্র আল্লাহই তাদের উপাস্য। অতএব তাঁর কাছেই পুরোপুরি সমর্পিত হও। আর সুসংবাদ দাও সমর্পিত বিনয়াবনতদের, আল্লাহর নাম নেয়া হলেই যাদের অন্তর কেঁপে ওঠে, যারা বিপদে ধৈর্যধারণ করে, নামাজ কায়েম করে আর আমার প্রদত্ত জীবনোপকরণ থেকে দান করে। (সূরা হজ, আয়াত ৩৪-৩৫)
কোরবানির পশুকে আল্লাহ তাঁর মহিমার প্রতীক করেছেন। তোমাদের জন্যে এতে রয়েছে বিপুল কল্যাণ। অতএব এগুলোকে সারিবদ্ধভাবে বাঁধা অবস্থায় এদের জবাই করার সময় আল্লাহর নাম উচ্চারণ করো। এরপর এরা যখন জমিনে লুটিয়ে পড়ে, তখন তা থেকে মাংস সংগ্রহ করে তোমরা খাও এবং কেউ চাক না চাক সবাইকে খাওয়াও। এভাবেই আমি গবাদি পশুগুলোকে তোমাদের প্রয়োজনের অধীন করে দিয়েছি, যাতে তোমরা শুকরিয়া আদায় করো। (সূরা হজ, আয়াত ৩৬)
কোরআনের আলোকে কুরবানীঃ
কিন্তু মনে রেখো কোরবানির মাংস বা রক্ত আল্লাহর কাছে পৌঁছায় না, আল্লাহর কাছে পৌঁছায় শুধু তোমাদের নিষ্ঠাপূর্ণ আল্লাহ-সচেতনতা। এই লক্ষ্যেই কোরবানির পশুগুলোকে তোমাদের অধীন করে দেয়া হয়েছে। অতএব আল্লাহ তোমাদের সৎপথ প্রদর্শনের মাধ্যমে যে কল্যাণ দিয়েছেন, সেজন্যে তোমরা আল্লাহর মহিমা ঘোষণা করো। হে নবী! আপনি সৎকর্মশীলদের সুসংবাদ দিন যে, আল্লাহ বিশ্বাসীদের রক্ষা করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ কোন বিশ্বাসঘাতক, অকৃতজ্ঞকে পছন্দ করেন না। (সূরা হজ, আয়াত ৩৭-৩৮)
ছেলে যখন পিতার কাজকর্মে অংশগ্রহণ করার মতো বড় হলো, তখন ইব্রাহিম একদিন তাকে বলল, ‘হে আমার প্রিয় পুত্র! আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, তোমাকে কোরবানি দিতে হবে। এখন বলো, এ ব্যাপারে তোমার মত কী? ইসমাইল জবাবে বলল, হে আমার পিতা! আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে, তাই করুন। ইনশাল্লাহ! আল্লাহর ইচ্ছায় আপনি আমাকে বিপদে ধৈর্যশীলদের একজন হিসেবেই পাবেন।’ (সূরা সাফফাত, আয়াত ১০২)
মনে রেখো, এ ছিল এক সুস্পষ্ট পরীক্ষা। আমি তাকে সুযোগ দিলাম এক মহান কোরবানির। পুরো বিষয়টি স্মরণীয় করে রাখলাম প্রজন্মের পর প্রজন্মে। ইব্রাহিমের প্রতি সালাম। এভাবেই আমি সৎকর্র্মশীলদের পুরস্কৃত করি। (সূরা সাফফাত, আয়াত ১০৬-১১০)
অতএব তুমি তোমার প্রতিপালকের জন্যেই নামাজ পড় ও কোরবানি দাও। নিশ্চয়ই তোমার প্রতি যেই বিদ্বেষ পোষণ করবে, বিলুপ্ত হবে ওর বংশধারা। (সূরা কাওসার, আয়াত ১০৮)
কোরবানি মানব ইতিহাসের সূচনাকাল থেকে চলে আসা একটি ইবাদত; যা মূলত স্রষ্টার উদ্দেশে সৃষ্টির নজরানা। কোরবানি শব্দের অর্থ ত্যাগ, আত্মোত্সর্গ; নৈকট্য লাভ। পরিভাষায় কোরবানি হলো, জিলহজ মাসের ১০ তারিখ সকাল থেকে ১২ তারিখ সূর্যাস্তের পূর্ব পর্যন্ত আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে নির্দিষ্ট জন্তু জবাই করা। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা বলেন: ‘সকল সম্প্রদায়ের জন্য আমি কোরবানির বিধান দিয়েছি, তিনি (আল্লাহ) তাদের জীবন উপকরণস্বরূপ যেসব চতুষ্পদ জন্তু দিয়েছেন, সেগুলোর ওপর যেন তারা আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে।’ (সুরা হজ, আয়াত: ৩৪)।
আমাদের কোরবানি
আজকের মুসলিম সমাজে কোরবানির যে প্রথা চলমান আছে, এ সম্পর্কে সাহাবায়ে কেরাম প্রিয় নবীজি (সা.)-কে জিজ্ঞাসা করলেন, হে আল্লাহর রাসুল! কোরবানি কী? এটা কোথা থেকে এসেছে? প্রিয় নবী (সা.) উত্তরে বললেন, ‘এটা হলো তোমাদের পিতা হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর সুন্নত বা আদর্শ। এই আদর্শকে অনুসরণের জন্যই আল্লাহ পাক তোমাদের ওপর কোরবানি ওয়াজিব করেছেন।’ সাহাবায়ে কেরাম (রা.) আবার জিজ্ঞেস করলেন, এতে আমাদের জন্য কী রয়েছে? উত্তরে মহানবী (সা.) বললেন: ‘কোরবানি জন্তুর প্রতিটি পশমে তোমরা একটি করে নেকি পাবে।’
কোরবানির উদ্দেশ্য কী?
প্রত্যেক মানুষ ইবাদত করবে শুধু তার মহান মালিক আল্লাহ তাআলার, মোমিন বান্দা তার কোনো ইবাদতে অন্য কাউকে শরিক করবে না। অর্থাৎ ইবাদত হতে হবে সকল প্রকার শির্কমুক্ত, শুধু এক আল্লাহর উদ্দেশে। মহান রাব্বুল আলামিন হজরত ইবরাহিম (আ.)-কে সে শিক্ষাই দিয়েছেন।
ইরশাদ হচ্ছে: ‘বলুন: নিশ্চয় আমার নামাজ, আমার কোরবানি, আমার জীবন এবং আমার মৃত্যু সমগ্র জগতের প্রতিপালক আল্লাহর জন্যই নিবেদিত।’ এ আয়াত দ্বারা স্পষ্ট হয়ে গেল, কোরবানি শুধু আল্লাহর উদ্দেশেই হতে হবে। লৌকিকতা বা সামাজিকতার উদ্দেশে নয়। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা বলেন: ‘আল্লাহর নিকট ওদের গোশত-রক্ত পৌঁছায় না; বরং পৌঁছায় তাঁর কাছে তোমাদের তাকওয়া।’ (সুরা হজ, আয়াত: ৩৭)।
প্রিয় নবী (সা.) বলেছেন: ‘আল্লাহ তাআলা তোমাদের স্বাস্থ্য-চেহারা এবং ধনসম্পদের প্রতি দৃষ্টিপাত করেন না; বরং তিনি দৃষ্টি দেন তোমাদের অন্তর এবং আমলের প্রতি। সুতরাং, কোরবানির পূর্বেই কোরবানিদাতার নিয়ত বা সংকল্প শুদ্ধ করে নিতে হবে।’
কোরবানির বিধান
হাদিস শরিফে বলা হয়েছে, কোরবানি হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর সুন্নত। এখানে সুন্নত অর্থ তরিকা বা পদ্ধতি, আদর্শ বা অনুসৃত বিষয়। আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে এরশাদ করেন: ‘ফা ছল্লি লিরব্বিকা ওয়ানহার’ অর্থাৎ হে নবী (সা.)! আপনি আপনার রবের উদ্দেশে নামাজ পড়ুন এবং কোরবানি করুন। (সুরা কাওসার, আয়াত: ২)। এই আয়াত দ্বারা বোঝা যায়, কোরবানি একটি ওয়াজিব (আবশ্যিক) বিধান।
কোরবানি ওয়াজিব হওয়ার শর্তঃ
প্রাপ্তবয়স্ক, সুস্থ মস্তিষ্কসম্পন্ন প্রত্যেক মুসলিম নর-নারী—যে ১০ জিলহজ ফজর থেকে ১২ জিলহজ সূর্যাস্ত পর্যন্ত সময়ের ভেতরে প্রয়োজনের অতিরিক্ত নেসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হবে; তার ওপর কোরবানি করা ওয়াজিব।
অর্থ-কড়ি, টাকা-পয়সা, সোনা-রূপা, গহনা-অলঙ্কার, বসবাস ও খোরাকির অতিরিক্ত জমি, প্রয়োজন অতিরিক্ত বাড়ি, ব্যবসায়িক পণ্য ও অপ্রয়োজনীয় সব আসবাবপত্র কোরবানির নেসাবের ক্ষেত্রে হিসাবযোগ্য।
আর নেসাব হল স্বর্ণের ক্ষেত্রে সাড়ে সাত (৭.৫) ভরি, রূপার ক্ষেত্রে সাড়ে বায়ান্ন (৫২.৫) ভরি। আর টাকা-পয়সা ও অন্যান্য বস্তুর ক্ষেত্রে নিসাব হলো- এগুলোর মূল্য সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপার মূল্যের সমপরিমাণ হওয়া (টাকার অংকে প্রায় ৫৫ হাজার টাকা)।
আর সোনা বা রূপা কিংবা টাকা-পয়সা এগুলোর কোনো একটি যদি পৃথকভাবে নেসাব পরিমাণ না থাকে কিন্তু প্রয়োজন অতিরিক্ত একাধিক বস্তু মিলে সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপার মূল্যের সমপরিমাণ হয়ে যায়, তাহলেও কোরবানি করা ওয়াজিব। (আলমুহিতুল বুরহানি: ৮/৪৫৫; ফাতাওয়া তাতারখানিয়া: ১৭/৪০৫)
কোরবানির নিয়ম
জিলহজ মাসের ১০ তারিখ সকাল থেকে ১২ তারিখ সূর্যাস্তের পূর্ব পর্যন্ত আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে শরিয়তের বিধান অনুসারে নির্দিষ্ট পশু জবাই করা। একটি কোরবানি হলো একটি ছাগল, একটি ভেড়া বা একটি দুম্বা এবং গরু, মহিষ ও উটের সাত ভাগের এক ভাগ। অর্থাৎ একটি গরু, মহিষ বা উট সাত শরিকে বা সাতজনের পক্ষ থেকে কোরবানি করা যাবে।
কোরবানির পশু যেকোনো মুসলমান নারী ও পুরুষ জবাই করতে পারেন। যাঁর কোরবানি তাঁর নিজে জবাই করা উত্তম। দোয়া জানা জরুরি নয়। ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার’ বলে জবাই করলেই হবে। এ ছাড়া অন্য দোয়া জানা থাকলে পড়া ভালো। জবাইয়ের জন্য কোনো নিয়ত নেই এবং কোরবানিদাতার নাম বলাও জরুরি নয়।
যিনি কোরবানি দিচ্ছেন, তাঁর মনের ইচ্ছাই নিয়ত হিসেবে কবুল হবে। নিজে জবাই করতে না পারলে যেকোনো কাউকে দিয়ে জবাই করাতে পারেন। জবাইয়ের সময় নিজে উপস্থিত থাকতে পারলে ভালো।
কোরবানির গোশত ধনী–গরিব সবাই খেতে পারেন। সুন্নাত হলো কিছু অংশ আত্মীয়স্বজনকে দেওয়া, কিছু অংশ গরিব পাড়া–প্রতিবেশীদের দেওয়া এবং কিছু অংশ নিজের পরিবারের জন্য রাখা। যত বেশি দেবে, তত ভালো। প্রয়োজনে সম্পূর্ণটাও রাখা যাবে।।
অনেকে সাত ভাগের এক ভাগ দিয়ে থাকেন, অনেকে সামান্য রেখে পুরোটাই দিয়ে দেন। ত্যাগের কোরবানির গোশত ভোগের জন্য পুঞ্জীভূত করে রাখা অনৈতিক ও অমানবিক। তবে বিশেষ কোনো ব্যক্তির জন্য বা শখের বশে অল্প পরিমাণে রাখলে কোনো দোষ নেই।
ওয়াজিব কোরবানি ছাড়াও ছোট–বড় জীবিত–মৃত যেকোনো কারও পক্ষ থেকে যেকোনো কেউ নফল কোরবানি আদায় করতে পারেন। এতে উভয়েই সওয়াবের অধিকারী হবেন। নারী যদি সামর্থ্যবান বা নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হন, তাঁর পক্ষেও কোরবানি ওয়াজিব।
শিশুদের ওপর কোরবানিসহ কোনো ফরজ ওয়াজিব প্রযোজ্য নয়। হিজড়ারা মূলত নারী বা পুরুষ। তাই তাঁরাও প্রাপ্তবয়স্ক এবং সামর্থ্যবান হলে নামাজ, রোজা, হজ, জাকাতের মতো কোরবানিও ওয়াজিব হবে। গরু, মহিষ বা উট অংশ হিসেবে যেভাবে ভাগে একাধিকজনের পক্ষে কোরবানি দেওয়া যায়, সেভাবে একটিকে সাতটি ধরে অংশ হারে আকিকাও দেওয়া যায়। কোরবানি ও আকিকা একসঙ্গে করতে কোনো বাধা নেই।
কোরবানি শুধু পশু জবাইয়ের মাধ্যমেই সম্পন্ন হয়। কোরবানির কোনো বিকল্প নেই। টাকাপয়সা প্রদান, অর্থসম্পদ দান ও সদকা খয়রাতের মাধ্যমে কোরবানি আদায় হবে না। সামর্থ্যবান কোনো ব্যক্তি বিশেষ ওজরের কারণে নিজে কোরবানি সম্পাদনে সক্ষম না হলে অন্য কাউকে দিয়ে বা প্রতিনিধির মাধ্যমে তা সম্পাদন করাতে পারবেন।
এ ক্ষেত্রে পশুর মূল্য ও ব্যবস্থাপনার যাবতীয় ব্যয়ও তাঁকে বহন করতে হবে। কেউ যদি বিনা পারিশ্রমিকে করে দেন, তাতেও কোনো ক্ষতি নেই।
যদি কেউ কোরবানির পশু কেনা, জবাই করা ও গোশত বিতরণ করা ইত্যাদি ঝামেলা এড়াতে চান, তবে বিশ্বস্ত কোনো ব্যক্তি-আত্মীয়স্বজন বা গ্রামের লোকজন অথবা নির্ভরযোগ্য কোনো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান বা সেবা সংস্থাকে তাঁর কোরবানি সম্পাদনের দায়িত্ব দিতে পারেন।
কোরবানির পাশাপাশি অভাবী গরিব, দুঃখী, দুর্দশাগ্রস্ত মানুষকে ঈদ আনন্দে শামিল করার জন্য বেশি বেশি আর্থিক দান–অনুদান, জামাকাপড় প্রদান এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় ও ঈদসামগ্রী কিনে দেওয়ার মাধ্যমে আরও বেশি পুণ্য অর্জন করা যায়।
যৌথ কোরবানির নিয়ম
কোরবানির পশুতে প্রত্যেক অংশীদারের অংশ সমান হতে হবে। কারো অংশ অন্যের অংশ থেকে কম হতে পারবে না। যেমন কারো আধা ভাগ, কারো দেড় ভাগ। এমন হলে কোনো শরিকের কোরবানি শুদ্ধ হবে না।
(বাদায়েউস সানায়ে: ৪/২০৭)
• উট, গরু, মহিষ সাত ভাগে এবং সাতের কমে যেকোনো সংখ্যা যেমন দুই, তিন, চার, পাঁচ ও ছয় ভাগেকোরবানি করা জায়েয। (মুসলিম, হাদিস: ১৩১৮; বাদায়েউস সানায়ে: ৪/২০৭)
কোনো অংশীদারের নিয়ত গলদ হলে
• অংশীদারদের কেউ যদি আল্লাহ তাআলার হুকুম পালনের উদ্দেশ্যে কোরবানি না করে, শুধু গোশত খাওয়ার নিয়তে কোরবানি করে; তাহলে তার কোরবানি শুদ্ধ হবে না।
তাকে অংশীদার বানালে অংশীদারদেরও কোরবানি হবে না। তাই অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে অংশীদার নির্বাচন করা জরুরি।
(বাদায়েউস সানায়ে: ৪/২০৮, কাজিখান: ৩/৩৪৯)
কোরবানির পশুতে আকিকার অংশ
হ্যাঁ, কুরবানির পশুতে আকিকার অংশ নেয়া যাবে । কোন সমস্যা নেই। কুরবানীও আল্লাহর জন্য করা হয়। আকিকাও আল্লাহর জন্য করা হয়। হাদীসের মাঝে কুরবানী এবং আকীকা উভয়ের জন্যই “নুসুক” শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে।
سئل رسول الله صلى الله عليه وسلم عن العقيقة، فقال : لا أحب العقوق كأنه كره الاسم، قالوا يا رسول الله! نسألك عن أحدنا يولد له، فقال : من أحب منكم أن ينسك عن ولده فليفعل، على الغلام شاتان مكافأتان، وعلى الجارية شاة.
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সাহাবায়ে কেরাম বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের মাঝে কারো সন্তান হলে, তার পক্ষ থেকে কোন কিছু নুছুক তথা জবাই করবো কি?
নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জবাব দিলেন, তোমাদের মাঝে যে ব্যক্তি তার সন্তানের পক্ষ থেকে নুসুক তথা জবাই করতে চায়, সে যেন তা করে, ছেলের পক্ষ থেকে দু’টি মোটাতাজা বকরী, আর মেয়ের পক্ষ থেকে একটি বকরী।
(দ্র. আলমুসান্নাফ, আব্দুর রা
নুসুক তথা কুরবানী এক উট, গরুতে সাতজন শরীক হতে পারে। সেই হিসেবে এক পশুতে আকিকা ও কুরবানী একই সাথে শরীক করা যাবে। যেহেতু উভয়টিই নুসুক।
• কোরবানির গরু, মহিষ ও উটে আকিকার নিয়তে অংশীদার হতে পারবে। এতে কোরবানি ও আকিকা দুটোই শুদ্ধ হবে। ছেলের জন্য দুই অংশ আর মেয়ের জন্য এক অংশ দিতে হবে।
• শৈশবে আকিকা করা না হলে বড় হওয়ার পরও আকিকা করা যাবে। যার আকিকা সে নিজে এবং তার মা-বাবাও আকীকারগোশত খেতে পারবে। (ইলাউস সুনান: ১৭/১২৬)
• ফাতাওয়া শামীসহ ফিকহ-ফাতাওয়ার কিতাবাদিতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, কোরবানির সাথে আকীকা সহীহ। (রদ্দুল মুহতার ৬/৩২৬; হাশিয়াতুত তহতাভি আলাদ্দুর: ৪/১১৬)
সুদ-ঘুষ বা অবৈধ টাকার কোরবানি শুদ্ধ নয়।
• কোরবানি করতে হবে সম্পূর্ণ হালাল সম্পদ থেকে। হারাম টাকা দ্বারা কোরবানি করা শুদ্ধ নয় এবং এক্ষেত্রে অন্য অংশীদারদের কোরবানিও শুদ্ধ হবে না।
• কেউ যদি গরু, মহিষ বা উট একা কোরবানি দেওয়ার নিয়তে কিনে আর সে ধনী হয়, তাহলে তার জন্য এপশুতে অন্যকে অংশীদার করা জায়েয। তবে এতে কাউকে শরিক না করে একা কোরবানি করাই শ্রেয়। শরিক করলে সে টাকা সদকা করে দেওয়া উত্তম।
• আর যদি ওই ব্যক্তি এমন গরীব হয়, যার উপর কোরবানি করা ওয়াজিব নয়, তাহলে যেহেতু কোরবানির নিয়তে পশুটি ক্রয় করার মাধ্যমে লোকটি তার পুরোটাই আল্লাহর জন্য নির্ধারণ করে নিয়েছে, তাই তার জন্য এপশুতে অন্যকে শরিক করা জায়েজ নয়। যদি শরিক করে তবে ওই টাকা সদকা করে দেওয়া জরুরি হবে। কোরবানির পশুতে কাউকে শরিক করতে চাইলে পশু ক্রয়ের সময়ই নিয়ত করে নিতে হবে। (কাজিখান: ৩/৩৫০-৩৫১, বাদায়েউস সানায়ে: ৪/২১০)
কোরবানি করতে না পারলে করণীয়
কেউ যদি কোরবানির দিনগুলোতে ওয়াজিব কোরবানি দিতে না পারে, তাহলে কোরবানির পশু ক্রয় না করে থাকলে তার উপর কোরবানির উপযুক্ত একটি ছাগলের মূল্য সদকা করা ওয়াজিব।
আর যদি পশু ক্রয় করেছিল, কিন্তু কোনো কারণে কোরবানি দেওয়া হয়নি, তাহলে ওই পশু জীবিত সদকা করে দেবে। (বাদায়েউস সানায়ে: ৪/২০৪; ফাতাওয়া কাজিখান: ৩/৩৪৫)
কোরবানির গুরুত্বপূর্ণ কিছু মাসয়ালা
কোন কোন পশু দ্বারা কুরবানী করা যাবে
মাসআলা : উট, গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া ও দুম্বা দ্বারা কুরবানী করা জায়েয। এসব গৃহপালিত পশু ছাড়া অন্যান্য পশু যেমন হরিণ, বন্যগরু ইত্যাদি দ্বারা কুরবানী করা জায়েয নয়। -ফাতাওয়া কাযীখান ৩/৩৪৮; বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০৫
কুরবানীর পশুর বয়সসীমা
মাসআলা : উট কমপক্ষে ৫ বছরের হতে হবে। গরু ও মহিষ কমপক্ষে ২ বছরের হতে হবে। আর ছাগল, ভেড়া ও দুম্বা কমপক্ষে ১ বছরের হতে হবে। তবে ভেড়া ও দুম্বা যদি ১ বছরের কিছু কমও হয়, কিন্তু এমন হৃষ্টপুষ্ট হয় যে, দেখতে ১ বছরের মতো মনে হয় তাহলে তা দ্বারাও কুরবানী করা জায়েয। অবশ্য এক্ষেত্রে কমপক্ষে ৬ মাস বয়সের হতে হবে।
উল্লেখ্য, ছাগলের বয়স ১ বছরের কম হলে কোনো অবস্থাতেই তা দ্বারা কুরবানী জায়েয হবে না। -ফাতাওয়া কাযীখান ৩/৩৪৮; বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০৫-২০৬
মাসআলা : উট, গরু, মহিষ সাত ভাগে এবং সাতের কমে যেকোনো সংখ্যা যেমন দুই, তিন, চার, পাঁচ ও ছয় ভাগে কুরবানী করা জায়েয। অর্থাৎ কুরবানীর পশুতে এক সপ্তমাংশ বা এর অধিক যে কোন অংশে অংশীদার হওয়া জায়েয। এক্ষেত্রে ভগ্নাংশ- যেমন, দেড় ভাগ, আড়াই ভাগ, সাড়ে তিন ভাগ হলেও কোনো সমস্যা নেই। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৩১৮; বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০৭
রুগ্ন ও দুর্বল পশুর কুরবানী
মাসআলা : এমন শুকনো দুর্বল পশু, যা জবাইয়ের স্থান পর্যন্ত হেঁটে যেতে পারে না তা দ্বারা কুরবানী করা জায়েয নয়। -জামে তিরমিযী ১/২৭৫; আলমগীরী ৫/২৯৭; বাদায়েউস সানায়ে ৪/২১৪
দাঁত নেই এমন পশুর কুরবানী
মাসআলা : গরু-ছাগলের অধিকাংশ দাঁত না থাকলেও যে কয়টি দাঁত আছে তা দ্বারা যদি ঘাস চিবিয়ে খেতে পারে তবে সেটি দ্বারা কুরবানী সহীহ। কিন্তু দাঁত পড়ে যাওয়ার কারণে যদি ঘাস চিবিয়ে খেতে না পারে তবে ঐ পশু কুরবানী করা যাবে না। -বাদায়েউস সানায়ে ৪/২১৫; ফাতাওয়া আলমগীরী ৫/২৯৮
যে পশুর শিং ভেঙ্গে বা ফেটে গেছে
মাসআলা : যে পশুর শিং একেবারে গোড়া থেকে ভেঙ্গে গেছে, যে কারণে মস্তিষ্ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সে পশুর কুরবানী জায়েয নয়। কিন্তু শিং ভাঙ্গার কারণে মস্তিষ্কে যদি আঘাত না পৌঁছে তাহলে সেই পশু দ্বারা কুরবানী জায়েয।
তাই যে পশুর অর্ধেক শিং বা কিছু শিং ফেটে বা ভেঙ্গে গেছে বা শিং একেবারে উঠেইনি, সে পশু দ্বারা কুরবানী করা জায়েয। -জামে তিরমিযী ১/২৭৬; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৩৮৮; বাদায়েউস সানায়ে ৪/২১৬; রদ্দুল মুহতার ৬/৩২৪; আলমগীরী ৫/২৯৭
কান বা লেজ কাটা পশুর কুরবানী
মাসআলা : যে পশুর লেজ বা কোনো কান অর্ধেক বা তারও বেশি কাটা সে পশুর কুরবানী জায়েয নয়। আর যদি অর্ধেকের কম হয় তাহলে তার কুরবানী জায়েয। তবে জন্মগতভাবেই যদি কান ছোট হয় তাহলে অসুবিধা নেই। -জামে তিরমিযী ১/২৭৫; মুসনাদে আহমাদ ১/৬১০; ইলাউস সুনান ১৭/২৩৮; ফাতাওয়া কাযীখান ৩/৩৫২; আলমগীরী ৫/২৯৭-২৯৮
মৃতের পক্ষ থেকে কুরবানী
মাসআলা : মৃতের পক্ষ থেকে কুরবানী করা জায়েয। মৃত ব্যক্তি যদি ওসিয়ত না করে থাকে তবে সেটি নফল কুরবানী হিসেবে গণ্য হবে। কুরবানীর স্বাভাবিক গোশতের মতো তা নিজেরাও খেতে পারবে এবং আত্মীয়-স্বজনকেও দিতে পারবে। আর যদি মৃত ব্যক্তি কুরবানীর ওসিয়ত করে গিয়ে থাকে তবে এর গোশত নিজেরা খেতে পারবে না। গরীব-মিসকীনদের মাঝে সদকা করে দিতে হবে। -মুসনাদে আহমাদ ১/১০৭, হাদীস ৮৪৫; ইলাউস সুনান ১৭/২৬৮; রদ্দুল মুহতার ৬/৩২৬; কাযীখান ৩/৩৫২
অন্য কারো ওয়াজিব কুরবানী আদায় করতে চাইলে
মাসআলা : অন্যের ওয়াজিব কুরবানী দিতে চাইলে ওই ব্যক্তির অনুমতি নিতে হবে। অনুমতি নিলে এর দ্বারা ওই ব্যক্তির কুরবানী আদায় হয়ে যাবে। নতুবা ওই ব্যক্তির কুরবানী আদায় হবে না। অবশ্য স্বামী বা পিতা যদি স্ত্রী বা সন্তানের বিনা অনুমতিতে তার পক্ষ থেকে কুরবানী করে তাহলে তাদের কুরবানী আদায় হয়ে যাবে। তবে অনুমতি নিয়ে আদায় করা ভালো।
গোশত, চর্বি বিক্রি করা
মাসআলা : কুরবানীর গোশত, চর্বি ইত্যাদি বিক্রি করা জায়েয নয়। বিক্রি করলে পূর্ণ মূল্য সদকা করে দিতে হবে। -ইলাউস সুনান ১৭/২৫৯; বাদায়েউস সানায়ে ৪/২২৫; কাযীখান ৩/৩৫৪; আলমগীরী ৫/৩০১
বিদেশে অবস্থানরত ব্যক্তির কুরবানী অন্যত্র করা
মাসআলা : বিদেশে অবস্থানরত ব্যক্তির জন্য নিজ দেশে বা অন্য কোথাও কুরবানী করা জায়েয।
মাসআলা : কুরবানীদাতা এক স্থানে আর কুরবানীর পশু ভিন্ন স্থানে থাকলে কুরবানীদাতার ঈদের নামায পড়া বা না পড়া ধর্তব্য নয়; বরং পশু যে এলাকায় আছে ওই এলাকায় ঈদের জামাত হয়ে গেলে পশু জবাই করা যাবে। -আদ্দুররুল মুখতার ৬/৩১৮
কুরবানীর পশুর হাড় বিক্রি
মাসআলা : কুরবানীর মৌসুমে অনেক মহাজন কুরবানীর হাড় ক্রয় করে থাকে। টোকাইরা বাড়ি বাড়ি থেকে হাড় সংগ্রহ করে তাদের কাছে বিক্রি করে। এদের ক্রয়-বিক্রয় জায়েয। এতে কোনো অসুবিধা নেই। কিন্তু কোনো কুরবানীদাতার জন্য নিজ কুরবানীর কোনো কিছু এমনকি হাড়ও বিক্রি করা জায়েয হবে না। করলে মূল্য সদকা করে দিতে হবে।।আর জেনেশুনে মহাজনদের জন্য এদের কাছ থেকে ক্রয় করাও বৈধ হবে না। -বাদায়েউস সানায়ে ৪/২২৫; কাযীখান ৩/৩৫৪; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ৫/৩০১
কাজের লোককে কুরবানীর গোশত খাওয়ানো
মাসআলা : কুরবানীর পশুর কোনো কিছু পারিশ্রমিক হিসাবে দেওয়া জায়েয নয়। গোশতও পারিশ্রমিক হিসেবে কাজের লোককে দেওয়া যাবে না। অবশ্য এ সময় ঘরের অন্যান্য সদস্যদের মতো কাজের লোকদেরকেও গোশত খাওয়ানো যাবে। -আহকামুল কুরআন জাস্সাস ৩/২৩৭; বাদায়েউস সানায়ে ৪/২২৪; আলবাহরুর রায়েক ৮/৩২৬; ইমদাদুল মুফতীন পৃ. ৮০২
জবাইকারীকে পারিশ্রমিক দেওয়া
মাসআলা : কুরবানীর পশু জবাই করে পারিশ্রমিক দেওয়া-নেওয়া জায়েয। তবে কুরবানীর পশুর কোনো কিছু পারিশ্রমিক হিসেবে দেওয়া যাবে না। -কিফায়াতুল মুফতী ৮/২৬৫
কুরবানীর শিক্ষা
আল্লাহ তাআলা ইবরাহিম (আ.)-এর স্মৃতিবিজড়িত কোরবানিকে পরবর্তী মানুষের জন্য অনুসরণীয় করে দেন। যাতে মানুষ বুঝতে পারে এবং শিখতে পারে যে, অর্থ-সম্পদ, টাকাপয়সা, আল্লাহর রাস্তায় কীভাবে ব্যয় করতে হয়।
এমনকি প্রয়োজনে আল্লাহর জন্য জীবন দিতেও যেন মানুষের কোনো দ্বিধা, সংশয় না থাকে। তা ছাড়া কোরবানি আত্মত্যাগের প্রশিক্ষণ ও অনুশীলন। মানুষের ষড়্রিপু তথা হিংসা, লোভ, কাম, ক্রোধ, ত্যাগের মাধ্যমে মনের পশুবৃত্তি তথা কুপ্রবৃত্তিকে জবাই করতে হবে। পশু কোরবানির সঙ্গে সঙ্গে ধনলিপ্সা, লোভ-লালসা, জাগতিক কামনা-বাসনা এবং দুনিয়াপ্রীতিকে কোরবানি করে আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টি ও সান্নিধ্য অর্জন করা কোরবানির শিক্ষা। কোরবানির গোশত আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী ও গরিবদের মাঝে বিতরণ করা সুন্নত ও অতি উত্তম আমল।
কুরবানী সম্পর্কে হাদিসঃ
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন: সে প্রকৃত মোমিন নয় যে নিজে পেট পুরে খায়; কিন্তু তার প্রতিবেশী ক্ষুধার্ত থাকে। (তিরমিজি)।
• কোরবানি শিরক থেকে মুক্ত থাকার একটি কার্যকরী মাধ্যম। ইসলাম মুসলিমদের কোরবানির বিধান দিয়ে তাওহীদ তথা একত্ববাদের বিশ্বাসকে উজ্জ্বল ও দৃঢ় করণের পাশাপাশি এই শিক্ষাও দেওয়া হয়েছে যে এসব সৃষ্টি করা হয়েছে কোরবানি করে আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি অর্জন করার জন্য। এর দ্বারা একদিকে যেমন তাওহীদের বিশ্বাস শাণিত হয়। তেমনি মানুষকে ইসলামের মহান আদর্শে উদ্বুদ্ধ করা সম্ভব। কোরবানির মাধ্যমে নিজেদের বিবেককে জাগিয়ে তোলা প্রয়োজন।
• কোরবানি করার মাধ্যমে সবাই আল্লাহ তা’আলার ক্ষমতা ও আধিপত্য দৃঢ়চিত্তে মেনে নেওয়ার অনুপ্রেরণা পায়। এর মাধ্যমে আল্লাহ তা’আলার তাওহীদের স্বীকৃতি ঘোষিত হয়।
• মুসলিমরা বিশ্বাস করে থাকেন- আল্লাহ তা’আলাই হলেন এ বিশ্ব জাহানের স্রষ্টা ও সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। এসব পশু তাঁরই। পশু কোরবানি সেই বিশ্বাসের স্বীকৃতিস্বরূপ।
• আল্লাহ তা’আলা যেসব পশুকে আমাদের অধীন করে দিয়েছেন এবং সেসব দ্বারা আমাদের নানাভাবে উপকার লাভের সুযোগ দান করেছেন- তার শুকরিয়া আদায় করা হয় কোরবানির মধ্যমে।
• কোরবানির মাধ্যমে আশরাফুল আম্বিয়া সায়্যিদুনা মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু অলাইহি ওয়া সাল্লাম, মূসা আলাইহিস সালাম ও ঈসা আলাইহিস সালাম প্রমুখ নবীদের পিতা ইব্রাহিম আলাইহিস সালামের স্মৃতি রক্ষা করা হয়। তিনি তাঁর প্রিয় পুত্র হজরত ইসমাইল আলাইহিস সালামকে আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকে নির্দেশপ্রাপ্ত হয়ে কোরবানি করার চেষ্টা করেন। তখন আল্লাহ তা’আলা একটি দুম্বাকে তার পরিবর্তে কোরবানি করান। এর মাধ্যমেই কোরবানি প্রবর্তন হয়।
• কোরবানি করার দ্বারা দুনিয়ার সম্পদ ও পার্থিব জীবনের ভালোবাসা ইত্যাদি থেকে পরিশুদ্ধি অর্জন করা হয়। কোরবানির পশু জবেহ করার মাধ্যমে বাহ্যত কোরবানি দাতার মালের ক্ষতি হয়। আর এ লোকসান বা ক্ষতি আল্লাহ তা’আলার সন্তুষ্টির জন্যই হয়ে থাকে। তাই জাকাতের মতো এর দ্বারাও সম্পদের ভালোবাসার মধ্যে কিছুটা ঘাটতি সৃষ্টি হয়ে থাকে। সেই সঙ্গে কোরবানি দাতার মনে এই অনুভূতি জাগ্রত হয় যে একটি পশু কোরবানি যখন আল্লাহ তা’আলার দরবারে তাঁর সন্তুষ্টি এবং নৈকট্য অর্জনের কারণ হয়- তাহলে স্বয়ং নিজের জান-মাল সবকিছু আল্লাহর রাহে কোরবানি করে দেওয়া আল্লাহ তা’আলার সন্তুষ্টি ও সান্নিধ্য লাভের কতো বড়ো মাধ্যম হতে পারে। এই অনুভূতি তার নিজের প্রতি ভালোবাসা কমিয়ে দিয়ে নিজেকে আল্লাহ তা’আলার রাহে কোরবানি করার চেতনাকে উজ্জীবিত করে।
কুরবানী নিয়ে কমন কিছু প্রশ্নের উত্তরঃ
১৷ কুরবানী ফরজ না ওয়াজীব?
উত্তরঃ – কুরবানী একটি ওয়াজিব ইবাদত
২। সাত ভাগে কুরবানী দেওয়া যাবে কী?
উত্তরঃ – সাত ভাগে কোরবানি দেওয়া যাবে।
৩। কুরব্নীর সাথে আকিকার নাম দেওয়া যাবে?
উত্তরঃ- যাবে
আপনার জন্য আরো কিছু গুরুত্বপুর্ণ লেখা
-
দোয়া কুনুত বাংলা উচ্চারণ ও অর্থ
-
নামাজের গুরুত্ব ও ফজিলত
-
সব নামাজ পড়ার নিয়ম ও নিয়ত বাংলায়
- দোয়া মাসুরা বাংলা উচ্চারণ
- আয়াতুল কুরসি বাংলা উচ্চারণ ও অর্থ
- ইস্তেখারা নামাজের দোয়া ফজিলত
- সেরা ইসলামীক উক্তি
লেখকঃ
হাফেজ মাওলানা দীদার মাহদী
ভাইস প্রিন্সিপ্যাল, দারুলহুদা মডেল মাদরাসা
কোদালপুর, গোসাইরহাট, শরীয়তপুর ৷
ইমেইলঃ didarmahdi6@gmail.com