নামাজের গুরুত্ব ও ফজীলত

সূচিপত্র

 নামাজের গুরুত্ব ও ফজীলত

 

নামাজের পরিচয়ঃ

মুসলিম হবার পর সর্বপ্রথম যে কাজটি করা একজন মানুষের ওপর ফরজ বা অবশ্য কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায়, তা হলো  নামাজ ৷ আজকের আলোচনায় আমরা নামাজের গুরুত্ব ও ফজীলত তুলে ধারার চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ।

নির্ধারিত সময়ে বিশেষ পদ্ধতিতে যে ইবাদাত করা হয়, সেটাই নামাজ ৷ ঈমানের পর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আমল এটি ৷ বলা যায়, একজন মুসলিমের পরিচয়ই প্রকাশ পায় নামাজের মাধ্যমে ৷ দাড়ি, টুপি এবং জুব্বা মোটকথা চেহার সুরত ও পোশাক আশাক অন্য ধর্মাবলম্বীদের থাকলেও তাদের সাথে পার্থক্য সূচিত হয় নামাজের মাধ্যমে ৷

কুরআনুল কারিমে নামাজের ব্যপারে সর্বাধিক গুরুত্বারোপ করা হয়েছে ৷ প্রায় আশি জায়গায় নামাজের আলোচনা এসেছে ৷

নবীজী সাঃ শতাধিক হাদীসে যথাযথভাবে নামাজ পড়ার তাগিদ দিয়েছেন ৷ নামাজ হচ্ছে দীনের খুঁটি বা স্তম্ভ ৷ ইসলাম দাঁড়িয়ে আছে যে কটি মৌলিক আমলের ওপর, তার মধ্যে নামাজ সর্বাগ্রে ৷

৫ ওয়াক্ত নামাজের গুরুত্ব ও ফজিলত

 

নামাজের প্রভাব সর্বজন স্বীকৃত ৷ অশ্লীলতা, বেহায়াপনা ও গুনাহ থেরে ব্যক্তিকে বিরত রাখার ব্যাপারে নামাজের জুড়ি নাই ৷

কোনে বান্দা যখন আল্লাহ তাআলাকে হাজির নাযির জেনে ৷ আল্লাহ তার সম্মুখে আছেন ৷ তাঁর নামাজ প্রত্যক্ষ করছেন ৷ এই ধ্যান করে ৷ খুশুখুযু তথা বিনয়, স্থিরতা ও প্রেমভয় নিয়ে নিয়মিত নামায আদায় করতে থাকে ৷ তখন এই নামায রিপুর দোষ থেকে তার অন্তরকে পরিশুদ্ধ করে দেয় ৷ জীবনকে পরিশীলিত করে তোলে।

অন্যায় ও অপরাধ থেকে তাকে দূরে সরিয়ে আনে। এই নামায সততা, সাধুতা, আল্লাহ প্রেম ও খোদাভীতির গুণ তাকে উপহার দেয়। এ জন্যই ইসলামে নামাযের এত গুরুত্ব, সমস্ত ফরজ ইবাদতের উপর নামাযের শ্রেষ্ঠত্ব। এবং এই কারণেই নবীজীর আদত ছিলো, কেউ ইসলাম গ্রহণ করলে তাওহীদ শিক্ষা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রথমেই তাকে Namaj আদায়ের আদেশ দিতেন, অঙ্গীকার নিতেন।

নামাজের গুরুত্ব সম্পর্কে হাদিস

পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের মধ্যে এশা ও ফজরের জামায়াতের গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। এ দুই সময়ে মানুষ সাধারণত পরিবারের সঙ্গে সময় কাটায় ও বিশ্রাম করে। ফলে এ জামাত দুটিতে যথেষ্ট অবহেলা ও গাফিলতি হয়ে থাকে। এজন্য হাদিসে এর প্রতি বিশেষভাবে উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করা হয়েছে।

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: «لَوْ يَعْلَمُ النَّاسُ مَا فِي النِّدَاءِ وَالصَّفِّ الْأَوَّلِ ثُمَّ لَمْ يَجِدُوا إِلَّا أَنْ يَسْتَهِمُوا عَلَيْهِ لَاسْتَهَمُوا عَلَيْهِ، وَلَوْ يَعْلَمُونَ مَا فِي التَّهْجِيرِ لَاسْتَبَقُوا إِلَيْهِ، وَلَوْ عَلِمُوا مَا فِي الْعَتَمَةِ وَالصُّبْحِ لَأَتَوْهُمَا وَلَوْ حَبْوًا»

আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ:

রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) : বলেছেন : মানুষ যদি জানত, আযান দেয়া এবং সালাতের প্রথম কাতারে দাঁড়ানোর মধ্যে কি ফযীলত রয়েছে, তবে তা পাবার জন্য লটারী ছাড়া উপায় না থাকলে তারা তার জন্য লটারী করত। আর তারা যদি জানত যে, দ্বি-প্রহরের (যোহর ও জুম’আ) সালাতের প্রথম সময়ে গমনে কি রয়েছে, তবে তার দিকে দ্রুতগতিতে ধাবিত হত। আর তারা যদি জানত ইশা ও ফজরের সালাতে কি রয়েছে, তাহলে উভয় সালাতের জন্য অবশ্যই হামাগুড়ি দিয়ে হলেও উপস্থিত হত।

[সুনানে আন-নাসায়ী, হাদিস নং ৬৭১]

সুন্নত নামাজের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ফজরের দুই রাকাত সুন্নত। হাদিসে এর প্রভূত ফজিলত বর্ণিত হয়েছে, যা অন্য সুন্নতের ক্ষেত্রে হয়নি।
عَنْ عَائِشَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهَا قَالَتْ لَمْ يَكُنْ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم عَلَى شَيْءٍ مِنْ النَّوَافِلِ أَشَدَّ مِنْهُ تَعَاهُدًا عَلَى رَكْعَتَيْ الْفَجْرِ.

আয়িশা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ:

তিনি বলেন, নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কোন নফল সালাতকে ফজরের দু’রাক’আত সুন্নাতের চেয়ে অধিক গুরুত্ব প্রদান করতেন না।

[সহিহ বুখারী, হাদিস নং ১১৬৯]

রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘ফজরের দুই রাকাত (সুন্নত) দুনিয়া ও দুনিয়ার মধ্যে যা কিছু আছে তার চেয়ে উত্তম।’ মুসলিম।

ফরজ নামাজের গুরুত্ব

নামাজের গুরুত্ব ও ফজিলত
নামাজের গুরুত্ব ও ফজিলত

নামাজের মধ্যে ফরজ নামাজের গুরুত্ব অনেক অনেক বেশি ৷ ভোরবেলা ফজরের নামাজ যদি কোন ব্যক্তি জামাতের সাথে আদায় করে ৷ ভোরের নির্মল বাতাস তার গায়ে মাখামাখি করে ৷ যার ফলে সে অনেক ধরনের রোগ ব্যাধি থেকে নিরাপদ থাকে ৷ কোন এক বুজুর্গ ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করা হলো ৷ ভোর বেলার বাতাস এত সুমিষ্ট এবং নির্মল কেন? তখন সেই বুজুর্গ বললেন, কারণ ভোরের বাতাসে মোনাফিকদের নিঃশ্বাস মেশে না ৷ কারণ মুনাফিকরা এই ফজর নামাজ জামাতের সাথে আদায় করতে পারেনা ৷ যারা প্রকৃত মুমিন তারা অবশ্যই ফজরের আজান হলে আর বিছানায় থাকতে পারে না ৷ তারা শীত আর গরম নয় মসজিদে এসে জামাতের সাথে নামাজ আদায় করে ৷

হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘শত্রু বাহীনি তোমাদের তাড়া করলেও তোমরা এ দুই রাকাত কখনো ত্যাগ করো না।’ ( আবু দাউদ )।

কিন্তু আফসোসের বিষয় হলো, বহু মুসলমান নামাজই পড়ে না। আর যারা নামাজী তাদের মধ্যে অনেকে ফরজ নামাজ নিয়মিত পড়তে পারে না। যারা নিয়মিত পড়ে তার মধ্যেও অনেকে জামাতে শরিক হতে পারে না।

 

আরো পড়ুন – জুমার নামাজের গুরুত্ব ও ফজিলত এবং নিয়ম 

 

আবার দেখা যায় অনেক মুসলিম ভাই ও বোন আছে, যারা সুন্নত নামাজের প্রতি তেমন গুরুত্ব দেয় না। শুধু ফরজ পড়ে ক্ষান্ত  থাকে। কিন্তু অনেকেরই অজানা ফরজ নামাজের পাশাপাশি সুন্নত নামাজের গুরুত্ব ও ফজিলত সম্পর্কে।

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘কিয়ামতের দিন বান্দার কাছ থেকে তার আমলগুলোর মধ্যে যে আমলের হিসাব সবার আগে নেওয়া হবে, তা হলো নামাজ। নামাজ ঠিক হলে সে পরিত্রাণ ও সফলতা লাভ করবে। নচেৎ (নামাজ ঠিক না হলে) ধ্বংস ও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

সুতরাং হিসাবের সময় ফরজ নামাজে কোনো কমতি দেখা গেলে আল্লাহ ফেরেশতাদের উদ্দেশে বলবেন, দেখো, আমার বান্দার কোনো নফল (নামাজ) আছে কিনা। অতএব তার নফল নামাজ দ্বারা ফরজ নামাজের ঘাটতি পূরণ করা হবে। অতঃপর আরও সব আমলের হিসাব অনুরূপভাবে গ্রহণ করা হবে।’ আবু দাউদ।

নামাজের গুরুত্ব

বহু মুসলিম আছেন, যারা অবলীলায় নামাজ ছেড়ে দেন ৷ পড়েন না ৷ এটাকে পান্তাভাত মনে করেন ৷ পড়া না পড়াকে তারা ঐচ্ছিক মনে করেন ৷ বা বুড়ো হলে নামাজ ধরবেন বলে ভাবেন ৷ তাদের জন্য বিশ্বনবীর হাদীসে কঠোর হুঁশিয়ারি আছে ৷ নামাজ না পড়াকে নবীজী সাঃ কুফুরী কাজ এবং কাফেরের স্বভাব বলে উল্লেখ করেছেন।

 

পড়ুন – সব নামাজের নিয়ম ও নিয়ত 

এক হাদীসে এসেছে,

لَا سَهْمَ فِي الْإِسْلَامِ لِمَنْ لَا صَلَاةَ لَهُ. قال الهيثمي: وَفِيهِ عَبْدُ اللَّهِ بْنُ سَعِيدِ بْنِ أَبِي سَعِيدٍ، وَقَدْ أَجْمَعُوا عَلَى ضَعْفِهِ.

“যার ভিতরে নামায নেই, তার ভিতর দ্বীনের কোনো হিস্যা নেই।” [মুসনাদে বায্যার, হাদীস নং ৮৫৩৯]

অপর এক হাদীসে নবীজী ইরশাদ করেন,

إِنَّ بَيْنَ الرَّجُلِ وَبَيْنَ الشِّرْكِ وَالْكُفْرِ تَرْكَ الصَّلَاةِ

“কোনো বান্দা আর কুফর-শিরকের মাঝে পার্থক্য বোঝা যাবে তার নামায তরকের দ্বারা।” [সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১৩৪]

 

নামাজের গুরুত্ব সম্পর্কে  আরো কিছু হাদিস

হাদীসের উদ্যেশ্য হলো, যখন কেউ নামাজ ছেড়ে দিলো, তখন সে যেন কুফরের সঙ্গে গিয়ে মিলিত হলো। তার নামাজ না পড়াটা কুফরি কাজের সমতূল্য হলো। একজন কাফের নামাজ পড়ে না ৷ অপরদিকে নামধারি একজন মুসলিমও নামাজ ছেড়ে দিলো ৷ দুজন নামাজ না পড়ার বিষয়ে একি কাজ করলো ৷ সুতরাং নামাজ ছেড়ে দেয়াটা কুফরির মতো হলো ৷

নামাজের বয়ান

নামাজ আদায় কত বড় সৌভাগ্যের বিষয় আর তরক করাটা কত বড় দুর্ভাগ্যের বিষয় সামনের হাদীস থেকে তা কিছুটা অনুমান করা যাবে। নবীজী ইরশাদ করেন,

مَنْ حَافَظَ عَلَيْهَا كَانَتْ لَهُ نُورًا، وَبُرْهَانًا، وَنَجَاةً يَوْمَ الْقِيَامَةِ، وَمَنْ لَمْ يُحَافِظْ عَلَيْهَا لَمْ يَكُنْ لَهُ نُورٌ، وَلَا بُرْهَانٌ، وَلَا نَجَاةٌ.

“যে ব্যক্তি নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত Namaj যত্নের সাথে আদায় করবে, কেয়ামতের সময় এ নামায তার জন্য আলো হবে, তার ঈমান ও ইসলামের দলিল হবে এবং তার নাজাতের ওসিলা হবে। আর যে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়মিত নামায আদায় করবে না, কেয়ামতের বিভীষিকাময় পরিস্থিতিতে নামায তার জন্য আলো হবে না, দলিল হবে না এবং সে আযাব ও শাস্তি থেকে রেহাইও পাবে না।”  [মুসনাদে আহমদ, হাদীস নং ৬৫৭৬]

এই হাদীস আমাদের কী ম্যাসেজ দিলো? আমরা যদি নামাজে যত্নবান না হই, তবে হাশরে কী পরিণতি অপেক্ষা করছে! এটা আমাদের চিন্তা করা উচিত ৷ ভাবা দরকার ৷

বেনামাজীর হাশর কেমন হবে?

দুনিয়ার জীবনে বেনামাজী প্রকৃতপক্ষে সফল তো হতে পারবে না ৷ আর কিয়ামতের দিন বেনামাজী কঠিন অপদস্থতা ও লাঞ্ছনার শিকার হবে  ৷ কুরআনুল কারীমের একটি আয়াতে তার বিবরণ এসেছে ৷ যার সারমর্ম নিম্নরূপ–

يَوْمَ يُكْشَفُ عَنْ سَاقٍ وَيُدْعَوْنَ إِلَى السُّجُودِ فَلَا يَسْتَطِيعُونَ .خَاشِعَةً أَبْصَارُهُمْ تَرْهَقُهُمْ ذِلَّةٌ وَقَدْ كَانُوا يُدْعَوْنَ إِلَى السُّجُودِ وَهُمْ سَالِمُونَ

কিয়ামতের সেই কঠিন দিনে যখন আল্লাহ তাআলার বিশেষ নূর প্রকাশ পাবে এবং সকল মানুষকে সিজদায় পড়ে যেতে বলা হবে, তখন (যে খোশনসীব দুনিয়াতে নামাজ পড়তো, সে তো সিজদায় পড়ে যাবে। কিন্তু) যারা নামাজ পড়তো না, তারা সিজদার জন্য ঝুঁকতেই পারবে না। (কারণ তাদের কোমরকে কাঠের মতো শক্ত করে দেওয়া হবে।) ভয় ও লজ্জার কারণে তাদের চক্ষু অবনমিত থাকবে। লাঞ্ছনা ও গঞ্জনার আযাব তাদেরকে ঘিরে ফেলবে। এ শাস্তি এই জন্য যে, দুনিয়াতে তাদেরকে সিজদার প্রতি আহ্বান করা হতো, যখন তারা সুস্থ সবল ছিলো। তা সত্ত্বেও তারা সিজদায় ঝুঁকে পড়তো না। [সূরা কলাম, আয়াত ৪২-৪৩]

হাদীসে বিষয়টির ব্যাখ্যা এসেছে এভাবে–
آدَمُ حَدَّثَنَا اللَّيْثُ عَنْ خَالِدِ بْنِ يَزِيْدَ عَنْ سَعِيْدِ بْنِ أَبِيْ هِلَالٍ عَنْ زَيْدِ بْنِ أَسْلَمَ عَنْ عَطَاءِ بْنِ يَسَارٍ عَنْ أَبِيْ سَعِيْدٍ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ قَالَ سَمِعْتُ النَّبِيَّ يَقُوْلُ يَكْشِفُ رَبُّنَا عَنْ سَاقِهِ فَيَسْجُدُ لَهُ كُلُّ مُؤْمِنٍ وَمُؤْمِنَةٍ فَيَبْقَى كُلُّ مَنْ كَانَ يَسْجُدُ فِي الدُّنْيَا رِيَاءً وَسُمْعَةً فَيَذْهَبُ لِيَسْجُدَ فَيَعُوْدُ ظَهْرُهُ طَبَقًا وَاحِدًا.

আবূ সা‘ঈদ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ:

তিনি বলেন, আমি নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-কে বলতে শুনেছি, আমাদের প্রতিপালক যখন তাঁর পায়ের গোড়ালির জ্যোতি বিকীর্ণ করবেন, তখন ঈমানদার নারী ও পুরুষ সবাই তাকে সাজ্দাহ করবে। কিন্তু যারা দুনিয়াতে লোক দেখানো ও প্রচারের জন্য সাজ্দাহ করত, তারা কেবল বাকী থাকবে। তারা সাজদাহ করতে ইচ্ছে করলে তাদের পিঠ একখণ্ড কাঠের ন্যায় শক্ত হয়ে যাবে।
[সহিহ বুখারী]

 

নামাজের আলোচনা

 

এ হাদীসে একজন মুমিনের জন্য রয়েছে চমৎকার সতর্ক বার্তা ৷ একজন বেনামাজীর জন্য রয়েছে অপূর্ব শিক্ষা ৷ বেনামাজী ব্যক্তি এক হিসাবে খোদাদ্রোহী, তাকে যত লাঞ্ছিত করা হোক আর যত শাস্তিই দেয়া হোক, সে এর উযুক্তই বটে। উম্মতের কতক মুজতাহিদ ঈমাম তো বেনামাযীকে ইসলাম থেকে খারিজ এবং কতলের উপযুক্ত বলেও মত প্রকাশ করেছেন!

সালতই আমাদের মুসলিম পরিচায়ক ৷ আল্লাহ তায়ালার সঙ্গে বান্দার সম্পর্কের ভিত রচনা করে সালাত ৷ মানুষকে আল্লাহ তাআলার রহমতের হকদার বানায়। সুতরাং নামাজ ছাড়া মুসলমান হওয়ার দাবী দলিলহীন ও ভিত্তিহীন।

নামাজ পড়ার উপকারিতা

সালাত আমাদের ওপর ফরজ ৷ অবশ্য কর্তব্য বিধান ৷ তবুও এর উপকারিতা বিদ্যমান ৷ আল্লাহ তাআলার যে বান্দা দৈনিক পাঁচবার আল্লাহ তাআলার সামনে হাত জোড় করে দাঁড়ায় ৷ তাঁর প্রশংসা ও স্তুতি গায় ৷ তাঁর সামনে ঝোঁকে ও সিজদাবনত হয় এবং দুআয় নিমগ্ন হয় ৷ সে বান্দা আল্লাহ তাআলার বিশেষ রহমত ও মুহাব্বতের অধিকারী হয়ে যায়। তাঁর গোনাহখাতা ঝরে যেতে থাকে, পাপের পঙ্কিলতা থেকে জীবন শুদ্ধ হতে থাকে, অন্তর আল্লাহ তাআলার নূরে নূরান্বিত হয়ে ওঠে। সে আল্লাহর ঘনিষ্ঠ হতে থাকে ৷ প্রিয় নবীজী সাঃ হাদীস শরীফে অত্যন্ত সুন্দর উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়েছেন ৷ পড়ুন তার ভাষায়–
أَرَأَيْتُمْ لَوْ أَنَّ نَهْرًا بِبَابِ أَحَدِكُمْ يَغْتَسِلُ مِنْهُ كُلَّ يَوْمٍ خَمْسَ مَرَّاتٍ، هَلْ يَبْقَى مِنْ دَرَنِهِ شَيْءٌ؟ قَالُوا: لَا يَبْقَى مِنْ دَرَنِهِ شَيْءٌ، قَالَ: فَذَلِكَ مَثَلُ الصَّلَوَاتِ الْخَمْسِ، يَمْحُو اللهُ بِهِنَّ الْخَطَايَا

“বলো তো, তোমাদের কারো ঘরের পাশেই যদি নহরনালা বহমান থাকে, আর সে তাতে দিনে পাঁচবার গোসল করে, তাহলে কি তার শরীরে কোনো ময়লা থাকতে পারে? সাহাবারা বললেন, ইয়া রাসুল আল্লাহ! কোনো ময়লা থাকতে পারে না। নবীজী বললেন, পাঁচ ওয়াক্ত নামাযেরও উদাহরণ তেমন। এর বরকতে বান্দার গোনাহখাতা মাফ হয়ে যায়।” [সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৬৬৭]

জামায়াতে নামায পড়ার গুরুত্ব ফজীলত

জামাতে নামজ
জামায়াতে নামাজ পড়ছেন মুসল্লিরা

মুসলিম একটি উম্মাহ ৷ পাঁচ ওয়াক্ত সালাতে তারা জামায়াতবদ্ধ হয় ৷ এর মাধ্যমে সমাজজীবনে ঐক্যবদ্ধতার সবক নেয় ৷ এজন্য জামায়াতে নামাজের গুরুত্ব অত্যাধিক ৷ নামাজের প্রকৃত ফজীলত ও বরকত জামাতে নামাজ পড়ার দ্বারাই হাসিল হয়।

নবীজী সাঃ জামাতে নামাজ পড়ার উপর কঠিনভাবে গুরুত্ব আরোপ করেছেন। যারা অসতর্কতা ও অলসতার কারণে জামাতে শরিক হয় না, নবীজী একবার তাদের সম্পর্কে কঠিন হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন ৷ পড়ুন তার ভাষায়–

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم ‏ “‏ إِنَّ أَثْقَلَ صَلاَةٍ عَلَى الْمُنَافِقِينَ صَلاَةُ الْعِشَاءِ وَصَلاَةُ الْفَجْرِ وَلَوْ يَعْلَمُونَ مَا فِيهِمَا لأَتَوْهُمَا وَلَوْ حَبْوًا وَلَقَدْ هَمَمْتُ أَنْ آمُرَ بِالصَّلاَةِ فَتُقَامَ ثُمَّ آمُرَ رَجُلاً فَيُصَلِّيَ بِالنَّاسِ ثُمَّ أَنْطَلِقَ مَعِي بِرِجَالٍ مَعَهُمْ حُزَمٌ مِنْ حَطَبٍ إِلَى قَوْمٍ لاَ يَشْهَدُونَ الصَّلاَةَ فَأُحَرِّقَ عَلَيْهِمْ بُيُوتَهُمْ بِالنَّارِ ‏”‏ ‏.

আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ:

তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ “ইশা ও ফাজরের সলাত আদায় করা মুনাফিক্বদের সর্বাপেক্ষা কঠিন। তারা যদি জানত যে, এ দু’টি সলাতের পুরষ্কার বা সাওয়াব কত তাহলে হামাগুড়ি দিয়ে বুক হেঁচড়ে হলেও তারা এ দু’ওয়াক্ত জামাআতে উপস্থিত হত | আমি ইচ্ছা করেছি সলাত আদায় করার আদেশ দিয়ে কাউকে ইমামতি করতে বলি। আর আমি কিছু লোককে নিয়ে জ্বালানী কাঠের বোঝাসহ যারা সলাতের জামা‘আতে আসে না তাদের কাছে যাই এবং আগুন দিয়ে তাদের ঘর-বাড়ী জ্বালিয়ে দেই।”
[সহিহ মুসলিম, হাদিস নং ১৩৬৮]

সতর্ক হবার জন্য আর কোনো কথার প্রয়োজন পড়ে না ৷ বোঝার জন্য এই একটি হাদীসই যথেষ্ট যে, জামাত তরক করাটা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের নিকট কতটা অপছন্দীয় ছিলো। অপর এক হাদীসে এসেছে,

حَدَّثَنَا يَحْيَى بْنُ يَحْيَى، قَالَ قَرَأْتُ عَلَى مَالِكٍ عَنْ نَافِعٍ، عَنِ ابْنِ عُمَرَ، أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ ‏ “‏ صَلاَةُ الْجَمَاعَةِ أَفْضَلُ مِنْ صَلاَةِ الْفَذِّ بِسَبْعٍ وَعِشْرِينَ دَرَجَةً ‏”‏ ‏.‏

‘আবদুল্লাহ ইবনু উমার (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ:

রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ “জামা‘আতের সাথে সলাত আদায় করা সলাত একাকী আদায় করা সলাত থেকে সাতাশ গুণ অধিক মর্যাদা সম্পন্ন।”
[সহিহ মুসলিম, হাদিস নং ১৩৬৩]

একাকী নামাজের তুলনায় জামায়াতে সালাত আদায়ে বহুবিধ ফায়দা রয়েছে ৷ আখিরাতের কল্যাণ তো আছেই ৷ দুনিয়াতেও এর প্রভাব উল্লেখযোগ্য ৷

এর মাধ্যমে মানুষের মাঝে সময়ানুবর্তিতা সৃষ্টি হয়। যথা সময়ে যে কোনো কাজ করার প্রেরণা জাগে ৷ দৈনিক পাঁচবার এলাকার দ্বীনদার ভাইদের সঙ্গে একত্র হওয়ার দ্বারা বড় বড় কাজের সুযোগ লাভ হয়।

দূর থেকে বাড়ি এলে সবার সাথে দেখা করা হয়ে ওঠে না ৷ কিন্তু জামায়াতে এলে এলাকার সবথেকে ভালো মানুষগুলোর সাথে সাক্ষাত হয়ে যায় ৷ জামাতের পাবন্দীর দ্বারা খোদ নামাজের উপর পাবন্দী নসীব হয়। অভিজ্ঞতায় বলে, যারা জামাতের পাবন্দী করে না, প্রায়ই তাদের নামাজ কাজা হয়ে যায়।

এমনিভাবে বড় ফায়দা হলো, যারা জামাতে শরিক হয়, তাদের প্রত্যেকের নামায পুরো মসজিদের জামাতের একটি অংশ হয়ে যায়। মসজিদের সেই জামাতে আল্লাহ তাআলার কতক নেককার বান্দাও থাকেন, যাদের নামায খুশুখুজু পূর্ণ হয়।

তাদের নামায যখন আল্লাহ তাআলা কবুল করেন, তখন আল্লাহ পাকের দয়া ও করুণার সামনে এ আশাই হয় যে, এই নামাজীদের ওসিলায় আমার নামাযও আল্লাহ তাআলা কবুল করবেন, যদিও আমার নামায সেই মানের নামায নয়। আমার নামাজ কবুল হওয়ার মত নয়।
সুতরাং, একান্ত অপারগতা ব্যতীত জামাত ছেড়ে দিলে কী পরিমাণ ছওয়াব ও বরকত থেকে আমরা বঞ্চিত হবো তা ভেবে দেখা উচিৎ।

উল্লেখ্য যে, জামাআতে নামাজ পড়ার এই ফযীলত শুধু পুরুষের জন্য। হাদীস শরীফে স্পষ্ট এসেছে, মহিলার জন্য মসজিদে নামায পড়ার চেয়ে ঘরে নামায পড়া অধিক উত্তম ও ফযীলতপূর্ণ।

আরো পড়ুন –যে গোনাহ আমল নামায় লেখা হয় না

নামাজে একাগ্রতার গুরুত্ব

নামাজে একাগ্রতা

একজন নামাজী নামাজে দাঁড়ালে দুনিয়ার সব চিন্তা তার মাথায় এসে ভর করে ৷ শয়তান নামাজে অমনযোগী করার যারপরনাই চেষ্টা করা ৷ যারা শয়তানের ফাঁদে পা দিয়ে গড্ডাপ্রবাহিকায় মনকে ছেড়ে দেয়, তার মন পাগলা ঘোড়ার মতো ছুটতে থাকে ৷

নামাজে মনযোগী হওয়ার উপায়

কেরাত কী পড়ছে, তাও মনে থাকে না ৷ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাশাহহুদও পড়ে ফেলে কেউ কেউ ৷ রাকাত ঠিক থাকে না ৷ এই মনকে নিয়ন্ত্রণ করা ও ধীরস্থীরের সাথে সালাত আদায়কে খুশুখুজু বলে ৷ যার গুরুত্ব অপরিসীম ৷

খুশুখুজুর সঙ্গে নামাজ পড়ার মতলব হলো, যখন নামাযে দাঁড়াবে তখন আল্লাহ তাআলাকে বিশেষভাবে হাজির নাযির জ্ঞান করবে।

আল্লাহ তাআলার মুহাব্বতে দেহমন আপ্লুত করে তুলবে এবং অন্তরাত্মায় তাঁর বড়ত্ব ও মহত্বের সম্মুখে নিজেকে মিটিয়ে দেয়ার অনুভূতি জাগ্রত রাখবে। যেন আমি এক মহা অপরাধে অপরাধী, ধৃত হয়ে কোনো মহা প্রতাপের অধিকারী বাদশার সম্মুখে দাঁড়িয়ে আছি! নামাজে দাঁড়িয়ে কল্পনা করবে, আমি মহামহীয়ান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের সম্মুখে তাঁরই সম্মানে দাঁড়িয়ে আছি। রুকু করার সময় ভাববে, আমি অবনতশির হচ্ছি আল্লাহ পাকের জালাল ও মহিমার সামনে। নিজেকে সিজদায় নিক্ষেপ করার সময় অনুভবের চেষ্টা করবে, আল্লাহ জাল্লা জালালুহুর অশেষ অসীম কুদরত ও ইজ্জতের সামনে আমি আমার অস্তিত্বের সমস্ত অপারগতা ও অপদস্ততার বহিঃপ্রকাশ ঘটাচ্ছি।

অমনযোগিতার নামাজ কোনো কাজে আসে না ৷ এদের সম্পর্কে আল্লাহ কঠোর হুঁশিয়ারি করেছেন ৷ কুরআন বলছে—

فَوَیۡلٌ  لِّلۡمُصَلِّیۡنَ ۙ﴿۴﴾
অতএব সেই সালাত আদায়কারীদের জন্য দুর্ভোগ,

الَّذِیۡنَ ہُمۡ عَنۡ صَلَاتِہِمۡ سَاہُوۡنَ ۙ﴿۵﴾

যারা নিজদের সালাতে অমনোযোগী,

[সূরা মাউন, আয়াত নং ৪-৫]

নামাজে মনযোগ আনার সহজ কৌশলঃ

নামাজে যা কিছু পড়া হয়, তা বুঝে বুঝে পড়তে পারলে খুবই ভালো। এতে নামাজের আসল স্বাদ অনুভব করা সহজ হয়, খুশুখুজু পয়দা হয়। নামাজের রূহ বা প্রাণ হলো হৃদয়ের আল্লাহমুখিতা ও খুশুখুজু। এমন নামাজ যে বান্দার নসীব হবে, সে সুনিশ্চিতভাবে কামিয়াব ও সফল। আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন,

قَدْ أَفْلَحَ الْمُؤْمِنُونَ. الَّذِينَ هُمْ فِي صَلَاتِهِمْ خَاشِعُونَ

ঐ সকল মুমিন সফল ও কামিয়াব, যারা খুশুখুজুর সঙ্গে নিয়মিত নামায আদায় করে। [সূরা মুমিন আয়াত ১-২]

এক হাদীসে নবীজি ইরশাদ করেন-

خَمْسُ صَلَوَاتٍ افْتَرَضَهُنَّ اللَّهُ تَعَالَى مَنْ أَحْسَنَ وُضُوءَهُنَّ وَصَلَّاهُنَّ لِوَقْتِهِنَّ وَأَتَمَّ رُكُوعَهُنَّ وَخُشُوعَهُنَّ كَانَ لَهُ عَلَى اللَّهِ عَهْدٌ أَنْ يَغْفِرَ لَهُ، وَمَنْ لَمْ يَفْعَلْ فَلَيْسَ لَهُ عَلَى اللَّهِ عَهْدٌ، إِنْ شَاءَ غَفَرَ لَهُ وَإِنْ شَاءَ عَذَّبَهُ

পাঁচটি নামায আল্লাহ ফরজ করেছেন। যে ব্যক্তি যথানিয়মে ওজু করবে এবং যথাসময়ে নামায আদায় করবে, উত্তমরূপে রুকু সিজদা করবে এবং খুশুখুজুর সঙ্গে নামযগুলি পড়ে যাবে, তার জন্য আল্লাহ তাআলার ওয়াদা রয়েছে, তিনি অবশ্যই তাকে ক্ষমা করে দিবেন। কিন্তু যে ব্যক্তি যথাযথভাবে নামায আদায় করবে না তার জন্য আল্লাহ পাকের কোনো ওয়াদা নেই। চাইলে তাকে তিনি শাস্তি দিতে পারেন, ক্ষমাও করতে পারেন। [সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নং ৪২৫]

শেষকথাঃ

আমরা যদি আল্লাহ পাকের ক্ষমা পেতে চাই, আখেরাতের শাস্তি থেকে বাঁচতে চাই, তাহলে উত্তম থেকে উত্তমরূপে নামায আদায় করা আমাদের একান্ত কর্তব্য ৷ আল্লাহ আমাদের পাঁচ ওয়াক্ত সালাত গুরুত্বসহকারে আদায় করার তাওফিক দান করুন ৷

আরো পড়ুন – ঘরে বসে আয় করার সহজ উপায়  অনলাইনে ইনকাম ২০২১

লেখকঃ

হাফেজ মাওলানা দীদার মাহদী

ভাইস প্রিন্সিপ্যাল, দারুলহুদা মডেল মাদরাসা

কোদালপুর, গোসাইরহাট, শরীয়তপুর ৷

 

 

 

7 thoughts on “নামাজের গুরুত্ব ও ফজীলত”

Leave a Comment