ফারহানা রাহমানের গল্প – সম্পর্ক

লেখা - ফারহানা রহমান

0 57

সর্ম্পক

ফারহানা রহমান

 

৬৭ বছরের হাবিব সাহেব একজন রিটায়ার্ড সরকারি কর্মকর্তা, এখন উনার সারাদিন অখন্ড অবসর। এক সময়ের প্রচন্ড দাপুটে এবং সদা ব্যস্ত মানুষের কাছে সময় কাটানোটাই এখন সবচেয়ে বড় সমস্যা। যৌবনে ক্ষমতা আর টাকার পিছনে ছুটতে ছুটতে কখন যে নিজের স্ত্রী-সন্তানের সাথে সূক্ষ্ম একটা দূরত্ব তৈরি হয়ে গেছে বুঝতেই পারেননি কখনো। আজ জীবনের অপরাহ্নে এসে বুঝতে পারছেন ক্ষমতা অথবা টাকা দুটোই একটা বয়সের পর আর রক্তে নেশা জাগাতে পারে না। তখন আপনজনদের ভালোবাসা-যত্নটাই সবচেয়ে মূল্যবান মনে হয়, সবাইকে পাশে পেলেই খুশিতে ভরে ওঠে হৃদয়। যৌবনে যেই উচ্চাকাঙ্ক্ষাগুলোকে পূরণ করতে গিয়ে আর সবকিছুকে উপেক্ষা করেছিলেন তিনি, আজ সেগুলোকেই খুব তুচ্ছ মনে হয় হাবিব সাহেবের কাছে। পার্থিব সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের দিকে ছুটতে গিয়ে না তিনি পরকালের কোনো পাথেয় জোগাড় করেছেন আর না নিজের পরিবারকে সময় দিয়েছেন। সন্তানরা এখন যে যার মতো ব্যস্ত, হাবিব সাহেবের স্ত্রীও ধর্মকর্ম আর নিজের বয়সজনিত অসুখ-ঔষধসহ তৈরি করে নিয়েছেন আলাদা জগত। হাবিব সাহেব তাই সবার মাঝে থেকেও নিজের বাড়িতে বড় একা। মাঝে মাঝেই অতীতের ঘটনাগুলোর স্মৃতিচারণ করে এক একা মুচকি হাসেন তিনি, হারিয়ে যাওয়া দিনগুলোর কথা মনে করতে ভালোই লাগে হাবিব সাহেবের।

আরো পড়ুন –  ভালো নেই পোশাক শিল্পের শ্রমিকরা 

নিজের বিয়ের ঘটনা মনে পড়লে এখনও অনেক হাসি পায় হাবিব সাহেবের, মনে হয় এইতো সেদিনের ঘটনা সব। হাবিব সাহেব যখন বিয়ে করেছিলেন তখন উনার বয়স প্রায় ২৫-২৬ আর অন্যদিকে উনার স্ত্রী ছিলেন নিতান্তই কিশোরী একটা মেয়ে, এই ১২-১৩ বছর বয়স হবে হয়তো। বিয়ের দিন তিনি শ্বশুর বাড়িতে পৌঁছানো মাত্রই ছোট্ট ছোট্ট বাচ্চার দল ” বর এসেছে, বর এসেছে ” বলে চিৎকার করতে করতে উনার দিকে এগিয়ে আসছিলো। হঠাৎ সকল বরযাত্রী অবাক হয়ে দেখলো বাচ্চাদের পিছনে একইভাবে বর দেখতে ছুটে আসছে বৌয়ের সাজে সজ্জিত এক কিশোরী। আর তাঁর পিছনে তাকে ধরতে প্রাণপণে ছুটছেন ২-৩ জন পুরুষ-মহিলা। সেদিন অনেক কষ্ট করে নিজের হাসি চেপে রাখলেও পরে নিজের স্ত্রীকে এই বিষয়টা নিয়ে খেপিয়েছেন বহুবার। কত সুন্দর ছিল সেসব দিন, হাসি-আনন্দে ভরা ছিল জীবনটা। হাবিব সাহেবের এখনো স্পষ্ট ভাবে মনে আছে প্রথম বাবা হবার অনূভুতি, সেই জান্নাতি সুখ কোনো ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয় কখনো। কত আদর-ভালোবাসায় কোলেপিঠে করে বড় করেছেন সন্তানদেরকে কিন্তু আজ তাদের দিনে একবারও সময় হয় না বৃদ্ধ বাবার খোঁজ নেওয়ার, বাবার সাথে দুদন্ড বসে কথা বলার। নিজের যৌবনকালে যে ভুল তিনি করেছিলেন সেই একই ভুল উনার ছেলেমেয়েরাও আজ করছে। বাবার দেখানো পথ আর যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলছে ওরা, তাই চুপ করে দেখা ছাড়া কোনো কিছুই করার নেই হাবিব সাহেবের।
জীবনে টাকার মূল্য কতোটা এটা তো বলার অপেক্ষা রাখে না তবে সুখে থাকতে হলে সত্যিই কি খুব বেশি অর্থ-বিত্তের প্রয়োজন? প্রশ্নের উত্তরটা অনেকে হয়তো হ্যাঁ বোধক দিবেন আবার অনেকে না বোধক। দুটির পক্ষেই অনেক যুক্তি-তর্ক উপস্থাপন করা সম্ভব কিন্তু জীবনের একটা পর্যায়ে এসে আরাম-আয়েশ করার জন্য জীবনের সিংহভাগ সময়টা ভূতের মতো পরিশ্রম করে কী লাভ? আর এক্ষেত্রে অসময়ে মৃত্যুর সম্ভাবনা নাহয় বাদই দিলাম। হাবিব সাহেবের মতো হাজার হাজার মানুষ শেষ বয়সে এসে দুঃখজনকভাবে প্রচন্ড একাকিত্বে ভোগেন। বছরের পর বছর নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকা মানুষটা এই সময়ে অগণিত মানুষের ভিড়ে হয়ে পড়েন একা, চাইলেও কিছুই আর ঠিক করা যায় না আগের মতো। অর্থের প্রয়োজন জীবনে যেমন আছে ঠিক তেমনই আছে সম্পর্কের মূল্য। তাই শত ব্যস্ততার মাঝেও যথাসম্ভব যত্নশীল হওয়া উচিত সম্পর্কের প্রতি যা কিনা কাজে আসবে আমাদের জীবনের সবচেয়ে কঠিনতম সময়গুলোতে।

- Advertisement -