হায়েজ অবস্থায় ইবাদত করার বিধান মাওলানা শরিফ আহমাদ

924

হায়েজ অবস্থায় ইবাদত  করার বিধান

 

 

সম্মানিত পাঠক-পাঠিকা । হায়েজ অবস্থায় কি কি ইবাদত করা যাবে‌ ? এ প্রশ্নটি হয়তো ঘুরেফিরে আপনাদের মাথায় আসে । কিন্তু লজ্জায় হয়তো‌ কাউকে জিজ্ঞেস করতে পারেন না । তাই আজ আমি আপনাদের জানাবো এ সংক্রান্ত তথ্যাদি । বাস্তবে এ বিষয়ে পর্যাপ্ত জ্ঞান রাখা নারী-পুরুষ সবার জন্য জরুরী ।

 

আপনি যদি‌ নারী হয়ে থাকেন এই লেখাটি আপনার জন্য । আপনি নিজে শিখে অন্য মা-বোনদের জানাতে পারবেন । আর যদি আপনি পুরুষ হয়ে থাকেন তাহলেও এটা আপনার জন্য । কেননা আপনার উক্ত বিষয়ে জানাশোনা থাকলে নারীদের শেখাতে পারবেন । নারীরাও সহজে সমাধান পেয়ে আমলে‌ যনোযোগী হতে পারবে ইনশাআল্লাহ ।

 

আর এজন্য আপনাকে ধৈর্য সহকারে পুরো লেখাটি পড়ুতে হবে । সুতরাং এবার পড়া শুরু করুন।

 

 

হায়েজ কি ?

 

গ্রাম-শহরের প্রাপ্তবয়স্ক প্রত্যেকটি নারী হায়েজ ( মাসিক ) এই শব্দটির সঙ্গে পরিচিত । তারা বাস্তবতার মুখোমুখি । আর পুরুষরা তেমন পরিচিত নয় । তাই একটু পরিচয় দিয়ে শুরু করছি ।‌ যেন আলোচনাটা বুঝতে সব বয়সী নারী-পুরুষ সকলের সুবিধা হয় ।

 

 

হায়েজ একটি আরবী শব্দ । শব্দটির অর্থ হলো প্রবাহিত হওয়া ।‌ শরীয়তের পরিভাষায় নির্দিষ্ট সময়ে নারীর জরায়ুর গভীর থেকে কোনো অসুখ ও আঘাত ব্যতিত যে রক্ত প্রবাহিত হয় তাকে হায়েজ বলা হয় ।

 

 

মহিলাদের হায়েজ কেন হয় ?

 

এবার জানাবো মহিলাদের হায়েজ হওয়া সম্পর্কিত তথ্য । মহান আল্লাহ তাআলা নারীদের ব্যতিক্রম করে সৃষ্টি করেছেন।‌ তাদের জীবন বৈচিত্রের মধ্যে সেটা স্পষ্ট । তিনি বিশেষ হেকমতের কারণে তাদেরকে হায়েজ দিয়েছেন । গর্ভস্থ সন্তান হায়েযের রক্ত খাবার হিসেবে গ্রহণ করে থাকে । প্রসবের পর এই রক্তই নারীর স্তনের দুধ হিসেবে রূপান্তরিত হতে সহায়ক হয় ।

 

 

নারী প্রেগন্যান্ট বা স্তন্যদানকারী না হলে গর্ভাশয়ে সৃষ্ট রক্ত ব্যবহৃত হওয়ার কোনো স্থান থাকে না ।‌ তাই তা প্রতিমাসে নির্দিষ্ট সময়ে জরায়ু দিয়ে নির্গত হয় ।

হায়েজের উপর নির্ভর করে নারীদের জীবনের উত্থান-পতন , সুস্থতা ,অসুস্থতা ইত্যাদি সবকিছু ।

 

 

হায়েজকে আমাদের দেশে ঋতু ,রজঃস্রাব , মাসিক পিরিয়ড ,মিনস ইত্যাদি নামেও অভিহিত করা হয় ।

 

 

হায়েজের সময় সীমা ?

 

হায়েজের পরিচয় , হওয়ার কারণ তো জানা হলো এবার সময়সীমা জানালে ভালো হতো না ! জী হ্যাঁ এটা এবার শুনুন ।

হায়েজের সময় সীমা কমপক্ষে তিন দিন তিন রাত এবং সর্বোচ্চ সময়সীমা দশ দিন দশ রাত ।

 

হায়েজের সময়ে অর্থাৎ হায়েজের দিনগুলোতে সর্বক্ষণ রক্ত আসা জরুরী নয় বরং নিয়মমতো রক্ত আসার পর অভ্যাসের দিনগুলোতে বা দশ দিন দশ রাতের ভিতরে মাঝেমধ্যে দুই চার ঘণ্টা বা এক দিন , আধা দিন রক্ত বন্ধ থেকে আবার এলেও সেই মাঝখানের সময়কেও হায়েজের সময় ধরা হবে।

স্মরণ রাখবেন, সাধারণত ৯ বছর থেকে নিয়ে ৫৫ বছর পর্যন্ত সময়ে হায়েজ হয়ে থাকে ।

 

 

হায়েজ অবস্থায় ইবাদত করার হুকুম 

 

 

এখন আপনাদের জানাবো হায়েজ অবস্থায় ইবাদতের হুকুম । কথাগুলো মনে রাখতে হবে ।

হায়েজের সময়ে নামাজ পড়া ও রোজা রাখা নিষেধ । তবে নামাজ ও রোজার মধ্যে কিছুটা পার্থক্য আছে । নামাজ পরিপূর্ণরূপে মাফ হয়ে যায় । আর কখনো কাজা করতে হয় না । কিন্তু রোজা সাময়িক মাফ হয়, হায়েজ শেষে আবার রোজার কাজা করতে হয় ।

 

ফরয নামায পড়াকালে যদি হায়েজ দেখা দেয় তাহলে সেই নামাজ ফাসেদ হয়ে যাবে । সেই চলতি নামাজও মাফ হয়ে যাবে । হায়েজ শেষে এটার কাযা করতে হবে না ।

ওয়াক্তের নামাজ এখনো পড়েনি কিন্তু নামাজ পড়ার মতো সময় এখনো আছে । অর্থাৎ ওয়াক্তের শেষ অবস্থা, এমবস্থায় যদি হায়েজ শুরু হয় তাহলে সেই ওয়াক্তের নামাজ মাফ হয়ে যাবে । কাজা আর পড়তে হবে না । আর রোজা শুরু করার পর যদি হায়েজ দেখা দেয় তাহলে সেটার পরে কাযা করতে হবে । তাই সেটা ফরজ রোজা হোক বা নফল হোক ।

 

 

হায়েজ অবস্থায় কি কি ইবাদত করা যাবে ?

 

ইতোপূর্বে আপনাদের জানানো হলো হায়েজ অবস্থায় প্রধান ইবাদত নামাজকে আল্লাহ তাআলা অনুগ্রহ করে মাফ করে দিয়েছেন । তবে নামাজের অক্ত হলে অযু করে নামাজের স্থানে বসে থাকার জন্য পরামর্শ দেওয়া হয়েছে ।

 

যেন নামাজের অভ্যাস ঠিক থাকে । এটি পালন করা উত্তম । না করলে কোন গুনাহ নেই ।

কিন্তু রোজার ব্যাপারটা‌ আলাদা । পরবর্তীতে কাজা করতে হয় । এরপর অন্যান্য ইবাদাতের মধ্যে আসে কোরআন তেলাওয়াত । হায়েজ, নেফাস কিংবা

গোসল ফরজ থাকা অবস্থায় কুরআনে কারীম পড়া হারাম । গোসল আবশ্যকের সকল অবস্থার হুকুম একই। হাদীসটি দেখুন ।

হযরত আব্দুল্লাহ বিন ওমর রাদিআল্লাহু তাআলা আনহু থেকে বর্ণিত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-ঋতুবতী মহিলা এবং গোসল ফরজ হওয়া ব্যক্তি কোরআন পড়বে না।

 

 

( সুনানে তিরমিযী, হাদীস নং-১৩১,সুনানে দারেমী, হাদীস নং-৯৯১,মুসনাদুর রাবী, হাদীস নং-১১,

মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস নং-১০৯০,

মুসন্নাফে আব্দুর রাজ্জাক, হাদীস নং-৩৮২৩)

তবে কোরআন স্পর্শ না করে মুখস্ত করতে পারবে । শর্ত হলো পরিপূর্ণ আয়াত যেন না হয় । অর্থাৎ কোন শব্দ কিংবা আয়াতের অর্ধেক অর্ধেক করে পাঠ করা যাবে । আর যদি কোন মেয়ে হিফজ করা অবস্থায় হায়েজ এসে যায় এবং মুখস্ত করার জন্য তেলাওয়াতের প্রয়োজন দেখা দেয় বা কোন হাফেজা মেয়ে হায়েজ অবস্থায় কুরআন হিফয রাখার জন্য তেলাওয়াত জারি রাখতে চায় তাহলে তারা মনে মনে তেলাওয়াত করবে । মুপখে মুখে উচ্চারণ করে নয় ।

 

 

হায়েজ অবস্থায় সূরা ফাতিহা অথবা কুরআনে কারীমের অন্য কোন দোয়ার আয়াত যদি তেলাওয়াতের নিয়তে না পড়ে এবং দোয়ার নিয়তে পড়ে তাহলে কোনো গুনাহ নেই ।

 

 

হায়েজ অবস্থায় দোয়ার নিয়তে আয়াতুল কুরসী ও দোয়া কুনুত পড়া জায়েজ আছে ।

যদি কোন মহিলা বাচ্চাদেরকে কোরআন শিক্ষা দেন তাহলে তিনি বানান করে পড়াতে পারবেন । এবং রিডিং পড়ার সময় এক দুই শব্দ করে ভেঙ্গে আলাদা আলাদা করে পড়াতে পারবেন ।

 

 

হায়েজ অবস্থায় আমল

অবস্থায় আমল

হায়েজ অবস্থায় কালিমা সমূহ পড়া যায় । অর্থাৎ কালিমা তাইয়্যেবা, শাহাদাত ও তাওহীদ ইত্যাদি ।

দুরুদ শরীফ, ইস্তেগফার , চার কুল ( সূরা কাফিরুন, সূরা ইখলাস, সূরা ফালাক, সূরা নাস ) ও জিকির করা জায়েজ আছে । জিকিরের ক্ষেত্রে সাধারণত এগুলো পড়া হয়-

সুবহানাল্লাহ

আলহামদুলিল্লাহ

আল্লাহু আকবার

লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ

লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লাহ ।

উল্লেখিত আমলগুলো করা জায়েয আছে ।

 

হায়েজ অবস্থায় মহিলারা কি আযানের জবাব দিতে পারবে ?

 

চমৎকার এই প্রশ্নটি আপনাদের মাথায় হয়তো এসেছে । না এলেও সমস্যা নেই আমি জানিয়ে দিচ্ছি ।‌ আপনাদের উপকার হবে ইনশাআল্লাহ ।

আযানের জবাব দেওয়া কিন্তু খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি আমল । সহীহ মুসলিম ও‌ নাসায়ী শরীফে হযরত ওমর রাদিআল্লাহু তাআলা আনহু থেকে বর্ণিত আছে । নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন যে ব্যক্তি আযানের জবাব দিবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে ।

 

এবার আসুন হায়েজা নারীদের কথা । হায়েজ অবস্থায় তারা আযানের জবাব দিতে পারবে । দিলে কোন সমস্যা হবে না । ( ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/৩৮; আদ্দুররুল মুখতার ১/২৯৩)

 

 

হায়েজ অবস্থায় নিষিদ্ধ কাজ

 

সুপ্রিয় পাঠক পাঠিকা । হায়েজ সংক্রান্ত মোটামুটি কয়েকটি পয়েন্ট নিয়ে কথা হলো । আরো জানাবো যদি আপনারা কমেন্ট করে জানান । আজকে এখানেই বিদায় নেব । তবে বিদায় নেওয়ার পূর্বে হায়েজ অবস্থায় নিষিদ্ধ কাজ গুলো জেনে রাখুন ।

 

হায়েজ অবস্থায় নিষিদ্ধ কাজ

১ .কুরআনুল কারীম স্পর্শ করা ।

 

হযরত ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু তাআলা বলেন, পবিত্র না হয়ে কুরআন কারীম স্পর্শ করবে না। (দারা কুতনী: ৪৩১)

 

২. কোরআন তেলাওয়াত করা ।

 

হযরত আলী রাদিআল্লাহু তাআলা আনহু বলেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সদা সর্বদা আমাদেরকে কুরআন পড়িয়েছেন, তবে যখন বড় নাপাকি অবস্থায় থাকতেন সে সময় ছাড়া।‌ (তিরমিযী: ১৪৬, আহমদ: ১০১৪)

 

৩. মসজিদে অবস্থান

 

নাপাক অবস্থায় মসজিদে গমন বা মসজিদে অবস্থান করা ‌যাবে না । (আবু দাউদ: ২৩২)।

 

৪. কাবা ঘর তাওয়াফ করা ।

 

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, অর্থাৎ আল্লাহর ঘর কাবায় তাওয়াফ করা নামায আদায় তুল্য।‌ (সুনানে নাসাঈ: ২৯২০)

 

পড়ুন – হায়েজ অবস্থায় সহবাস করা যাবে কি?

 

সবাই ভাল থাকুন । সুস্থ থাকুন । শীর্ষবার্তার সঙ্গে থাকুন । আল্লাহ হাফেজ ।

 

লিখনে: মাওলানা শরিফ আহমাদ

ঢাকা, বাংলাদেশ ।

 

 

ট্যাগঃ হায়েজ অবস্থায় ইবাদত,হায়েজ অবস্থায় ইবাদত,হায়েজ অবস্থায় ইবাদত,হায়েজ অবস্থায় ইবাদত,

 

 

- Advertisement -