খতমে খাজেগান পড়ার নিয়ম ও পদ্ধতি। খতমে শিফা পড়ার নিয়ম মাওলানা শরিফ আহমাদ

খতমে খাজেগান এর  (খতমে শিফার) সঠিক নিয়ম ও পদ্ধতি

 

 

সুপ্রিয় পাঠক বন্ধুরা । আজ আপনাদের সাথে খতমে খাজেগানের সঠিক নিয়ম ও পদ্ধতি সম্পর্কে আলোচনা করবো‌ ইনশাআল্লাহ ‌। উপকৃত হবেন হবেন বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস । মুনাজাতে দোয়ার দরখাস্ত রইল ।

 

 

খতমে খাজেগান কি ও কেন ?

 

পাঠক বন্ধুরা ! প্রথমে একটু খতমে খাজেগানের পরিচয় জেনে নিই । যদিও বা শব্দটির সঙ্গে সকলে কমবেশি পরিচিত আছেন। কিন্তু আজ আপনাদের অর্থ সহ জানাবো । তাহলে প্রতিটি আলোচনা বুঝতে সহজ হবে ইনশাআল্লাহ ।

 

খতম একটি আরবী শব্দ । অর্থ হচ্ছে পূর্ণ বা শেষ করা। আর খাজেগান একটি ফারসী শব্দ । এটি বহুবচন । একবচন হলো খাজা । অর্থ আকাঙ্ক্ষা বা মনোবাসনা ।

 

 

আরবী এবং ফার্সি মিলিয়ে হয়েছে খতমে খাজেগান । খতমে খাজেগানের ভাবার্থ এরকম বিশেষ উদ্দেশ্য পূর্ণ করার জন্য বিভিন্ন জিকিরের মাধ্যমে আল্লাহর নিকট দোয়া করা । এটি সাধারণত মানুষ ভয়ঙ্কর কোনো বিপদ বা কঠিন রোগ ব্যাধি থেকে বাঁচার জন্য পড়ে থাকে বা আয়োজন করা হয় ।

 

এগুলোর মাধ্যমে অনেক ক্ষেত্রে নগদ ফলাফলও পাওয়া যায় ‌।‌ এটি খতমে শিফা নামেও পরিচিত । খতমে খাজেগান‌ নামটি মূলত কোন পীর মাশায়েখ আলেম-ওলামা দিয়েছেন ।‌ সেটা থেকেই বোঝা যাচ্ছে এটি তাদের রচিত একটি বিশেষ কার্যকরী পদ্ধতি ।

 

খতমে খাজেগান পড়া কি জায়েজ আছে ?

 

ঠিক এরকম প্রশ্ন আপনাদের মনে জাগতে পারে । কিংবা কোথাও পড়তে গেলে যে কোন ব্যক্তি এই প্রশ্ন করতে পারে । উত্তর তো শিখে রাখা উচিত । জলদি শুনুন- খতমে খাজেগান পড়া জায়েজ । এটি কোন বিদআত কাজ নয় । বিদআত বললে তো কোরআন হাদীসের দলীল দেখাতে হবে ।‌ আর কোরআন ও হাদীসে কোথাও এই রকম খতম পড়া কিংবা না পড়ার নিষেধাজ্ঞা‌ আসেনি ।

 

খতম পড়া কি জায়েজ

উল্টো আরো যে দোয়া-দরুদগুলো পড়া হয় সবগুলো কোরআন ও হাদীসে বর্ণিত । সহজ করে এভাবে বলতে পারি অভিজ্ঞ ডাক্তারগণ যেমন বিভিন্ন রোগের ঔষধ দিয়ে থাকে সুস্থ হওয়ার জন্য তেমনি বুযুর্গানে দীন তাদের অভিজ্ঞতার মাধ্যমে জেনেছেন যে সুনির্দিষ্ট কিছু আয়াতের মাধ্যমে নির্দিষ্ট কিছু ফায়দা হাসিল হয় । আর সেই আয়াতগুলোর সম্মিলিত রূপ হচ্ছে খতমে খাজেগান ।

 

 

 

খতমে খাজেগানের জন্য কি প্রয়োজন ?

 

 

এতক্ষণ খতমে খাজেগান কি ও কেন পাঠ করার বৈধতা সম্পর্কে জেনেছেন । এবার জানাবো খতমে খাজেগান পড়ার জন্য কি কি জিনিসের দরকার ।

প্রথমেই কয়েকজন আমলী আলেম-ওলামা প্রয়োজন ‌।‌

সাধারণ মানুষ দিয়ে পড়া বৈধ হলেও তারা আলেমদের মত শুদ্ধ করে সুরা কেরাত কিংবা দোয়া গুলো পড়তে পারবেনা ।‌ এজন্য আলেম-ওলামাকে অগ্রাধিকার দেওয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ । আলেম-ওলামার সংখ্যা কম করে ৫ থেকে ৬ জন কিংবা আরো বেশিও হতে পারে । সংখ্যা যত বেশি হবে তত দ্রুত খতম শেষ হবে ‌।

 

 

এরপরে প্রয়োজন সামান্য চিনি এবং এক গ্লাস/ জগ পানি ।‌ বাকি কাজ আলেম ওলামারা করবেন ।

 

খতমে খাজেগান পরার নিয়ম

 

সম্মানিত আলেম-ওলামাগণ তাসবী সাথে নিয়ে আসতে পারেন । কিংবা সহজে হিসাব রাখার জন্য ছোট ছোট বিচি রাখতে পারেন । উপরন্ত না পেলে ছোলা বুটও রাখতে পারেন ।‌ সেগুলোকে গুনে গুনে ১১০ টি আমীর অর্থাৎ যিনি খতম পরিচালনা করবেন তার হাতে দিবেন‌ । কোন দোয়া-দরুদ কতবার পড়তে হবে তিনি বলবেন ।

 

আর তিনি উচ্চস্বরে এগুলো পড়বেন । যেন অন্যরা সহজে স্মরণ করে বলতে পারেন ।‌ পড়ার আগে অবশ্যই তাওবা ইস্তেগফার করে নেবেন । যে উদ্দেশ্যে খতম পড়া হচ্ছে তার দিকে একটা ধ্যান খেয়াল রাখবেন ‌।‌ সবচেয়ে ভালো হয় খতম শুরু করার পূর্বে একজন- দুই রাকাত সালাতুল হাজত পড়া । আর এই নামায কিন্তু হাদীস থেকে প্রমাণিত ।

 

ইত্যাদি বিষয়গুলো হয়ে গেলে আয়োজক‌ ও আলেম-ওলামাগণ এবার খতম শুরু করতে পারেন ।

 

খতমে খাজেগান পড়ার নিয়ম

 

এবার আপনাদের জানাব মূল পয়েন্ট অর্থাৎ খতমে খাজেগান পড়ার বিস্তারিত নিয়ম । চারটি অংশে ভাগ করছি ।‌ শুধু আপনাদের বোঝার জন্য । ভালো করে পড়ুন । প্রয়োজনে নোট করুন ।

 

প্রথম অংশে যা পড়বেন

 

 খতমে খাজেগান পড়ার নিয়ম

১. ইস্তেগফার পড়ুন ১১ বার ।

اَسْتَغْفِرُ اللهَ رَبِّيْ مِنْ كُلِّ ذَنْبٍ وَّاَ تُوْبُ اِلَيْهِ

অর্থ: আমি আমার রবের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করছি সর্বপ্রকার গুনাহ থেকে এবং আমি তাঁর নিকট তওবা করছি। (আউনুল মা’বূদ)

২. সুরা ফাতিহা ৭ বার ।

৩. দরুদ শরীফ ১০০ বার ।

৪. সূরা আলাম নাশরাহ ৭৯ বার ।

৫. দরুদ শরীফ ১০০ বার ।

৬. সূরা ইখলাস ১০০০ বার ।

৭. সূরা ফাতিহা ৭ বার ।

৮. দরুদ শরীফ ১০০ বার ।

 

নোট: যেকোনো ইস্তেগফার , যেকোনো দরুদ পাঠ করা যাবে । তবে হাদীসে বর্ণিত ইস্তেগফার ও দরুদ পড়া উত্তম ।

আপনারা পড়ছেন খতমে শিফা পড়ার নিয়ম 

 

দ্বিতীয় অংশে যা পড়বেন

 

১.

فَسَهِّلْ يَا اِلٰهِىْ كُلَّ صَعْبٍ بِحُرْ مَتِ سَيِّدِ الْاَ بْرَارِ .

বাংলা উচ্চারণ: ফাসাহহিল ইয়া ইলাহি কুল্লা সাবিন

বিহুরমাতি সাইয়্যেদুল আবরার ।‌

 

২. سَهِّلْ بِفَضْلِكَ يَاعَزِيْزُ

বাংলা উচ্চারণ: সাহহিল বিফাদলিকা ইয়া আজীজু ।

৩.

يَا قَاضِىَ الْحَاجَاتْ

বাংলা উচ্চারণ: ইয়া কাযিয়াল হাজাত ।

৪.

 

يَا كَفِىَ الْمُهِمَّاتْ

বাংলা উচ্চারণ: ইয়া কাফিয়াল মুহিম্মাত ।

৫.

يَا دَافِعَ الْبَلِيَّاتْ

বাংলা উচ্চারণ: ইয়া দাফিয়াল বালিয়্যাত ‌।

৬.

 

يَا مُجِيْبَ الدَّعْوَاتْ

বাংলা উচ্চারণ: ইয়া মুযিবাত দাওয়াত।

৭.

يَا رَافِعَ الدَّرَجَاتْ

বাংলা উচ্চারণ: ইয়া রাফিয়াদ দারাযাত ।

৮. يَا حَلَّالَ الْمُشْكِلَاتْ

বাংলা উচ্চারণ: ইয়া হাল্লালাল মুশকিলাত ।

৯.

يَا مُسَبِّبَ الْاَسْبَابْ

বাংলা উচ্চারণ: ইয়া মুসাব্বিবাল আসবাব ।

১০.

يَا شَافِعَ الْاَمْرَاضْ

বাংলা উচ্চারণ: ইয়া শাফিয়াল আমরাজ ।

১১.

يَا مُفَتِّحَ الْاَبْوَابْ

বাংলা উচ্চারণ: ইয়া মুফাত্তিহাল আবওয়াব ।

১২.

رَبِّ اِنِّىْ مَغْلُوْبٌ فَانْتَصِرْ

বাংলা উচ্চারণ: রাব্বি আন্নি মাগলুবুন ফানতাসির ।

১৩. يَا غَوْثُ اَغِثْنِىْ وَاَمْدُدْنِىْ

বাংলা উচ্চারণ: ইয়া গাউসু আগিসনি ওয়া আমদুদনি ।

১৪.

اِنَّالِلّٰهِ وَاِنَّااِلَيْهِ رَاجِعُوْنْ

বাংলা উচ্চারণ: ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন ।

১৫.

لَااِلٰهَ اِلَّاۤ اَنْتَ سُبْحَانَكَ اِنِّىْ كُنْتُ مِنَ الظّٰلِمِيْنْ

বাংলা উচ্চারণ: লা ইলাহা ইল্লা আনতা সুবহানাকা ইন্নি কুনতু মিনাজ জোয়ালিমিন ।

১৬.

فَاسْتَجَبْنَا لَهٗ وَنَجَّيْنٰهُ مِنَ الْغَمِّ وَكَذٰ لِكَ نُنْجِى الْمُؤْمِنِيْنْ

বাংলা উচ্চারণ: ফাসতাজাবনা লাহু ওয়া নাজ্জায় নাহু

ওয়া কাযালিকা নুনজিল মুমিনীন ।

১৭. يَا اَرْ حَمَ الرَّحِمِيْنْ

বাংলা উচ্চারণ: ইয়া আরহামার রাহিমীন

১৮. يا احد يا صمد يا غفور يا الله

 

বাংলা উচ্চারণ: ইয়া আহাদু ইয়া সমাদু ইয়া গফুরু ইয়া আল্লাহ ।

১৯. يا حافظ يا ناصر يا الله

বাংলা উচ্চারণ: ইয়া হাফিজু ইয়া নাসিরু ইয়া আল্লাহ।

২০. اللهم يا ارحم الراحمين

বাংলা উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা ইয়া আরহামার রহিমীন।

২১.نصر من الله وفتح قريب وبشر المؤمنين

বাংলা উচ্চারণ: নাসরুন‌ মিনাল্লাহি ওয়া ফাতহুন করীবু ওয়া বাশশিরিল মুমিনীন ।

২২. ربي اني مسني الضر وانت ارحم الراحمين

বাংলা উচ্চারণ:

রব্বি আন্নি মাসসানিয়াত দুররু ওয়া আনতা আর হামার রহিমীন ।

২৩. فالله خيرا حافظا وهو ارحم الراحمين

বাংলা উচ্চারণ:

ফাল্লাহু খয়রান হাফিজা ওয়া হু ওয়া আরহামার রহিমীন।‌

২৪.سبحان الله والحمد لله ولا اله الا الله الله اكبر

বাংলা উচ্চারণ: সুবহানাল্লাহি ওয়াল হামদুলিল্লাহি ওয়া লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু আল্লাহু আকবার ।

 

২৫. ويشفي صدور قوم مؤمنين

বাংলা উচ্চারণ: ওয়া ইয়াশফি সুদুরা কওমিন মুমিনীন।

২৬. وشفاء لما في الصدور

বাংলা উচ্চারণ:

ওয়া শিফাউন লিমা ফিস সুদুরি।

২৭. وننزل من القران ما هو شفاء ورحمة للمؤمنين

বাংলা উচ্চারণ:

ওয়ানু নাযযিলু মিনাল কুরআনী মা হু ওয়া শিফাউন ওয়া রহমাতুন‌ লিল মুমিনীন।

২৮. يخرج من بطونها شراب مختلف الوانه فيه شفاء اللناس

বাংলা উচ্চারণ:

২৯.واذا مرضت فهو يشفين

বাংলা উচ্চারণ: ওয়া ইজা মারীতু ফাহু ওয়া ওয়াশফিন।

৩০. امن يجيب المضطر اذا دعاه ويكشف السوء

বাংলা উচ্চারণ:

আম মাই ইজিবুল মুদতুররা ইজা দাআয়ু ওয়াকশিফুস সু।

৩১. قل هو للذين امنوا هدى وشفاء

বাংলা উচ্চারণ:

কুল হুয়া লিল্লাজিনা আমানু হুদান ওয়া শিফাউন ।

 

নোট: উল্লেখিত প্রত্যেকটা ইসম বা আয়াত ১০০ বার করে পড়তে হবে । ভুল যেন না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে । যিনি পরিচালনা করবেন তিনি সবার দিকে নজর দিবেন মাঝে মধ্যে । প্রত্যেকটি আয়াত পরে চিনি এবং পানিতে ফু দিবেন ।

 

তৃতীয় অংশে যা পড়বেন

 

 

১. سلام قولا من رب الرحيم

বাংলা উচ্চারণ: সালামুন কাওলান মির রাব্বির রহিমু ।

২. سلام على نوح في العالمين

বাংলা উচ্চারণ: সালামুন আলা নুহুন ফিল আলামিন।

৩. سلام على الياسين

বাংলা উচ্চারণ: সালামুন আলা ইলয়াসিন ।

৪. سلام على موسى وهارون

বাংলা উচ্চারণ: সালামুন মুসা ও হারুন ।

৫. سلام على ابراهيم

সালামুন আলা ইব্রাহিম ।

৬. سلام عليكم طبتم فادخلوها خالدين

বাংলা উচ্চারণ:

সালামুন আলাইকুম তিবতুম ফাদ খুলুহা খলিদীন।

৭. سلام هي حتى مطلع الفجر

বাংলা উচ্চারণ:

সালামুন হিয়া হাত্তা মাতলায়িল ফজর ।

৮. দরুদ শরীফ ১ বার ।

৯. দরুদে নারীয়া ১ বার ।

নোট: উল্লেখিত প্রত্যেকটি সাত সালাম ১০০ বার করে পড়তে হবে । আরবী দেখে দেখে পড়বেন ‌। শুদ্ধ উচ্চারণ করার চেষ্টা করবেন । বাংলা দেওয়া হয়েছে সাধারণ মুসলমানদের সহজের লক্ষ্যে ।

 

আপনার জন্য 

 

 

চতুর্থ অংশে মুনাজাত

 

 

খতমে খাজেগানের নিয়ম কানুন দোয়া-দরুদ সবকিছু উল্লেখ করা হয়েছে ‌। এগুলো সঠিকভাবে আদায় করা হলে মুনাজাত করা প্রয়োজন । মুরুব্বী আলেম দোয়া করবেন । আর সঙ্গে থাকা আলেম-উলামা এবং আয়োজকরা শামিল হবেন ‌। মুনাজাতে মূল সমস্যাবলীর কথা চোখের পানি ফেলে বলবেন । আশা করি আল্লাহ তাআলা মুশকিল হাসান করে দিবেন । বিপদ দূর করে দেবেন । শান্তি নাযিল করবেন ।

বিশেষ দ্রষ্টব্য: ওই পানি এবং চিনি পড়া সকলে খেতে পারবে।

 

শেষ কথা:

 

আবারো বলছি খতমে খাজেগানের নিয়ম-নীতিগুলো বুজুর্গ আলেমদের তৈরি । যদি এগুলো কেউ পাঠ করাকে বাধ্যতামূলক মনে করে কিংবা কোরআন সুন্নাহ ভিত্তিক বর্ণিত আমল মনে করে তাহলে এটা বাড়াবাড়ি হবে । বিদআত হবে । আর যদি বুজুর্গদের আমল মনে করেই করে তাহলে সমস্যা নেই । এ বিষয়টা মাথায় রাখতে হবে। খতমে খাজেগান সম্পর্কে অনেক কথাই হল ।এবার বিদায় নেওয়ার পালা । যে যেখানে থাকেন ভাল থাকুন সুস্থ থাকুন । শীর্ষ বার্তার সঙ্গে থাকুন । আল্লাহ হাফেজ।

 

 

লিখনে: মাওলানা শরিফ আহমাদ

ঢাকা, বাংলাদেশ ।