ভালো নেই পোশাকশিল্পের শ্রমিকরা

ফাহিম জাহেদ, শিল্পাঞ্চল প্রতিনিধিঃ

.
দেশের সর্ববৃহৎ শিল্পখাত পোশাক শিল্পের শ্রমীকরা ভালো নেই। করোনার প্রাদুর্ভাবে চাকরি চলে যাওয়া, বেতন ভাতা সময় মত না পাওয়া, অনিয়ন্ত্রিত শ্রমিক ছাটাই সহ নানা অনিয়মের কারনে দুর্বিসহ জীবন যাপন করছেন এই সেক্টরের ৪০ লাখ শ্রমীক।

বাংলাদেশ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক দেশ। এক সময় আমাদের দেশে ব্যক্তি উদ্যোগে পোশাক তৈরি করা হতো। ষাটের দশকের শুরুতে বাণিজ্যিকভাবে তৈরি পোশাক শিল্পকারখানা গড়ে উঠল। শুরু হলো নতুন বিপ্লব। ধীরে ধীরে দেশের চাহিদা পূরণ করে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আধিপত্য বিস্তার করতে সক্ষম হলো। মানসম্মত পোশাক রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে নন্দিত হলো সারাবিশ্বে। বর্তমানে তৈরি পোশাক বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য। আমাদের রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮৩ শতাংশ আসে তৈরি পোশাক শিল্প থেকে। প্রতি বছর প্রায় ৩০ হাজার মিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্জিত হচ্ছে এ খাত থেকে। আমাদের জিডিপিতে পোশাক শিল্পের অবদান ৩৩ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। বর্তমানে প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক এ সেক্টরে নিযুক্ত রয়েছে। যার ৮০ শতাংশ নারী শ্রমিক। যারা নিরলসভাবে শ্রম দিয়ে যাচ্ছে পোশাক শিল্পের উন্নতির লক্ষ্যে।
দৈনিক ১২ থেকে ১৬ ঘণ্টা একাধারে শ্রম দিয়ে যাচ্ছে। বহির্বিশ্বে আমাদের পোশাক শিল্পের জনপ্রিয়তা এবং গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি হচ্ছে। কিন্তু আজ অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলো যারা এই মহান সেক্টরের প্রাণ, যাদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে আমরা বিশ্ববাজারে শক্তিশালী অবস্থান গড়তে সক্ষম হয়েছি, তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছি, প্রতি বছর মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার বৈদেশিক মুদ্রা আয় হচ্ছে সেই মহান শ্রমিকরা আজ ভালো নেই।
.
করোনার কারনে চাকুরী চলে গেছে অনেকের, অনেকর চাকরি আছে তবে বেতন পাচ্ছে না, কেউ আবার কিছু বেতন পেলেও তাও পাচ্ছে অনিয়মিত ভাবে। আবার যারা ভালোভাবে বেতন পাচ্ছেন তারাও কাজ না থাকায় ওভারটাইম হচ্ছে না, এতে যা বেতন আসে তাতে ঘর ভাড়া বিদ্যুৎ বিল দিয়ে সারামাস সংসার চলা খুব কষ্টের।
শাহানা খাতুন নামের এক শ্রমীক বলেন, করোনার আগে আমরা স্বামী স্ত্রী চাকরি করে দুই সন্তান নিয়ে ভালই চলতো আমাদের, হঠাৎ করোনা ভাইরাসের প্রদুর্ভাব বাড়াতে আমার স্বামীর চাকরি চলে যায়। এখনো সে কোন কাজ না পেয়ে বেকার বসে আছে। এদিকে আমাদের কারখানায় কাজ কম থাকায় ওভারটাইম হচ্ছে না তাতে আমি মাসিক বেতন পাচ্ছি ৯৫০০ টাকা, এই সামান্য টাকা দিয়ে কিভাবে যে ৪জন মানুষ চলতেছি তা বোঝাতে পারবো না। শুধু শাহানা খাতুন নয়, জসিম, আসমা, সাবিনা, ফজলু সহ আরো বেশ কিছু পোষাক শ্রমীকের সাথে কথা হয় শীর্ষবার্তা প্রতিবেদকের। সকলেরই একই অবস্থা অনেকেই না খেয়ে আছে, অনেকে আবার পেশা বদল করে কোনমতে টিকে আছে। অনেকে ঘরভাড়া না দিতে পেরে বাড়িওয়ালার পাওনা মেটাতে ঘরের জিনিসপত্র সব রেখে বাড়ি চলে গেছে। এই সংকট থেকে উত্তরনের জন্য শ্রমীকরা মালিক এবং সরকারের সুদৃষ্টি কামনা করেছেন। তারা বলেন, আমারা এতদিন কাজ করেছি মালিকদের জন্য কিন্তু মালিকরা আমাদের এই দুঃসময়ে পাশে না থেকে বিভিন্ন অজুহাতে পাওনাকড়ি না দিয়েই ছাটাই করে দিচ্ছে। এটা পুরপুরি অন্যায়। আমরা এর অনিয়মের বিচার আল্লাহর কাছে দিলাম।

এই বিষয়ে জানতে চাইলে ” বাংলাদেশ গার্মেন্টস শ্রমীক কর্মচারী ঐক্য ফেডারেশনের”    সাবেক সাভার অঞ্চল পরিচালক প্রকৌশলী মুজাহিদুল ইসলাম আক্ষেপের সুরে বলেন, কি বলবো ভাই, গার্মেন্টস শ্রমীকদের মালিকরা মানুষ মনে করে না। তাদের বেঁচে থাকার নূন্যতম অধিকার মালিকরা দিতে চায় না। শুধু করোনার কারনে নয় মালিকরা তাদের ব্যাবসা ভালো চলার সময়ও শ্রমীকদের অধিকার নিয়ে টালবাহানা করেছে। তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে বিভিন্ন অজুহাতে। তিনি কথায় কথায় শ্রমীক ছাঁটাই বন্ধ করা, শ্রমীকদের বেতন ভাতা বৃদ্ধি সহ সরকার নির্ধারিত সকল সুযোগ সুবিধা দিতে মালিকদের আহ্বান জানান।
.
৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮ দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় ‘জোড়াতালির জীবন শ্রমিকের’ নামে একটি প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে তৈরি পোশাক শ্রমিকদের জীবনের করুণ কাহিনী। প্রতি মাসের পারিবারিক ব্যয়, বাসা ভাড়া, গ্যাস বিল, বিদ্যুৎ বিল, ছেলেমেয়ের পড়ার ব্যয়ভার বহন করা একজন তৈরি পোশাক শ্রমিকের জন্য অসম্ভব হয়ে পড়েছে। পোশাক শিল্পে শ্রমিকরা পান মাত্র ৮০০০ টাকা
অক্সফামের গবেষণায় বাংলাদেশে একজন মানুষের সাধারণভাবে খেয়ে পরে বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজন ২৫২ ডলার। অথচ বাংলাদেশের তার এক-পঞ্চমাংশ বিদ্যমান। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) প্রতিবেদনে দেখা যায়, চীনে শ্রমিকদের ন্যূনতন মজুরি ১৫৫ ডলার, ভিয়েতনামে ১০০ ডলার, ভারতে ৭৮ ডলার, কম্বোডিয়ায় ১২৮ ডলার, পাকিস্তানে ৯৯ ডলার এবং বিশ্বের দ্বিতীয় তৈরি পোশাক রপ্তানিকারী দেশ বাংলাদেশে তা মাত্র ৬৮ ডলার। উপরের প্রতিবেদনে প্রতীয়মান হয়, বাংলাদেশি তৈরি পোশাক শ্রমিকদের প্রতি বৈষম্যের চিত্র।

Leave a Comment