রোনক ব্যানার্জির লেখা গল্প – ইন্টারভিউ

ইন্টারভিউ

 

——————————
পৃথ্বীশ টেবিলের ওপর মাথা গুঁজে পড়ে আছে।কাল ওর ইন্টারভিউ। খুব আশঙ্কা হচ্ছে, যদি ইন্ট্রোডাকশন ঠিকঠাক না হয়,ইন্টারভিউয়ারের প্রশ্নের উত্তর যদি ঠিক মত না দিতে পারি তবে তো দীর্ঘলালিত স্বপ্ন চূরমার হয়ে ভেঙ্গে পড়বে এক লহমায়! নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানদের খুব কষ্ট করে বড়ো হতে হয়, ওদের কাছে সামান্য মাইনের চাকরিও ভগবানের আর্শীবাদস্বরূপ।পারিপার্শ্বিক পরিবেশের জড়তা ও ব্যঙ্গাত্মক বাচনভঙ্গি কাটিয়ে কীভাবে নিজের জীবনকে সূচারুরূপে পরিচালনা করবে এইসব আদ্যোপান্ত ভাবতে থাকে মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান পৃথ্বীশ।
        ঘড়িতে তখন রাত্রি সাড়ে বারোটা, আশেপাশের একটিও মানুষ জেগে নেই, শুধু ঝিঁঝিঁ পোকাগুলো ডেকে চলেছে। হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠলো, একটা অপরিচিত নাম্বার। কিঞ্চিৎ অপ্রস্তুত হয়ে পৃথ্বীশ ফোনটা রিসিভ করলো,ফোনের ওপাশ থেকে ভেসে এলো-“আমায় চিনতে পেরেছো পৃথ্বীশ?”; কন্ঠস্বরটা খুব পরিচিত, কিন্তু আজ তিন বছর হয়ে গেলো এই কন্ঠটা সে শোনেনি,মিলির কন্ঠটা দীর্ঘদিন পর শুনতে পেয়ে পৃথ্বীশ বললো,যার নিঃশ্বাসের শব্দটা চোখবুজে বুঝে চিনে নিতে পারি তার কন্ঠটা চিনবো না? তিন বছর চার মাস পনেরো দিন দুঘন্টা চার মিনিট সাতাশ সেকেন্ড পর হঠাৎ কি মনে করে আমার তলব করতে ইচ্ছে হলো। এখনও কি কোনো অপমান বাকি রয়ে গেছে নাকি গ্লাসকেসে অধিকারের ঘাটতি ঘটেছে! ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে মিলি বললো, তোমাকে ছাড়ার পর আমার জীবনে আকাশ এসেছিলো, কিছুদিন প্রেম চলার পর ও আমায় বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলো, দুই পরিবারের মত নিয়ে আমরা বিয়ের পিঁড়িতে বসি, বিবাহের পর আভিজাত্যের ছোঁয়ায় জীবন অতিবাহিত হতে থাকে, আমি প্রেগন্যান্ট হ‌ই, খুব যত্ন নিয়ে আমাদের পরিবারের নবাগত সদস্যের পরিচর্যা চলে,নয়মাস তিনদিন গর্ভে সন্তান ধারণ করে শেষমেষ হসপিটালে আমাকে নিয়ে যায় ওরা, আকাশ ও আমার একটি কন্যাসন্তান হয় কিন্তু শ্বশুরবাড়ির রোষ তখন আমার ওপর এসে পড়ে, আমার কন্যাসন্তান ও আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়, আমার বাবাও আমাকে অপবিত্র বলে তাড়িয়ে দেয়, আমি এখন অসহায় অপবিত্র নারী, দায়িত্বহীন জননী।”পৃথ্বীশ তুমি কি আমায় একটু আশ্রয় দেবে, আমাকে ও আমার সন্তানকে মায়ার চাদরে জড়িয়ে নেবে? সেদিন পরীক্ষার আগের রাতে তুমি মন দিয়ে পড়াশোনা করার জন্য আমার সঙ্গে কথা বলোনি, আমাকে সময় দাওনি , তাই ইগোতে তোমায় ছেড়ে গেছিলাম।দেখো আজ সন্ততির পরীক্ষায়, সংসারের পরীক্ষায়, ইজ্জতের পরীক্ষায় আমি আজ হেরে গেছি, আমি আজ বুঝি পরীক্ষায় সফল হতে হলে কতোটা অধ্যবসায় জরুরি, জীবনের পরীক্ষায় আমি ফেল করে গেছি, তুমি তো প্রতিশ্রুতিবদ্ধ সৈনিক, তোমার যুদ্ধে আমায় সামিল করবে প্লিজ, আরও একবার তোমার মিলিকে আপন করবে পৃথ্বীশ, আরও একবার চোখের জল মুছে বলবে এই জলটা অনেক দামি, এতো সহজে ঝরতে দিওনা।আজ তুমি আমার পরীক্ষক, তুমি চাইলে আমি বেঁচে থাকার পাশ টা পেতে পারি,ন‌ইলে পরাজিত সৈনিকের মতো মৃত্যুবরণ করতে পারি।” এই কথাগুলো বলে ফোনটা কেটে গেলো, পৃথ্বীশ যেনো পাথর হয়ে যেতে থাকলো, ইন্টারভিউয়ের টেনশন উবে গিয়ে,একটি বিপদগ্ৰস্ত মেয়েকে, পুরোনো প্রেমিকাকে উদ্ধার করতে তার মনটা আনচান করে উঠলো। মিলিকে উদ্ধার করার জন্য সে খুব সকালে উঠে পড়লো, হন্যে হয়ে খুঁজতেই হবে তাকে, ইন্টারভিউয়ের কথা প্রায় ভুলেই গেলো সে, চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে খবরের কাগজে চোখ বোলাতে গিয়ে চমকে উঠলো, কাগজের দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় লেখা রয়েছে- তুফানগঞ্জে কন্যাসন্তান জন্ম দেওয়ার জন্য এক নারীকে শ্বশুরবাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিলো, পরবর্তী সময়ে ওই নারী সন্ধ্যেবেলা একটি নির্জন স্থানে গিয়ে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করে, লোকমুখে শোনা যাচ্ছে মৃতার নাম মিলি চৌধুরী, বাড়ি রঘুনাথগঞ্জ।

Leave a Comment