সুমাইয়া আজরিন শিমুর গল্প “নিতীনবাবু”

লেখা:সুমাইয়া আজরিন শিমু

নবম শ্রেণি,নড়াইল সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়।

ঠিকানা:কুড়িগ্রাম,নড়াইল।

নিতীনবাবু

সুমাইয়া আজরিন শিমু

 

 

‘আচ্ছা স্যার,আপনি কি অপ্রাকৃত জিনিসে বিশ্বাস করেন?’ ভদ্রলোক উৎসুক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন।নীল হাওয়াই শার্ট আর চোখে মোটা কালো ফ্রেমের চশমা ভদ্রলোকের। তিনি ভাবছেন আমি এ বিষয়ে অনেক জ্ঞানী কিছু কথা বলবো।কিংবা বলবো আমি এসব বিশ্বাস করিনা।বিজ্ঞানের যুগে সবকিছুরই ব্যাখ্যা আছে।আর যেগুলোর নেই সেগুলো কাকতালীয় ব্যাপার। আমার মাথা ঘামানোর জায়গা না।কিন্তু এসব ক্ষেত্রে কি উত্তর দিতে হয় তা আমি বুঝতে পারিনা।ভদ্রলোক কোন উত্তর শুনে খুশী হবে বোঝা যাচ্ছেনা।আমি বুঝতে ব্যর্থ।এসব ক্ষেত্রে আমার গিন্নী আমার অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেয়।কিন্তু এখন সে এই ভদ্রলোকের স্ত্রীকে নিয়ে ব্যস্ত।উল্লেখযোগ্য ভদ্রলোকের স্ত্রী আমার ধর্মপত্নীর বাল্যসখী।দীর্ঘ পনেরো বছর পর তাদের দেখা,ব্যস্ত থাকাটাই কি স্বাভাবিক না? নিজেকে বোকা মনে হচ্ছে।ভদ্রলোক কে কি বলবো বুঝতে পারছি না।ভদ্রলোক বলেই চলেছি,লোকটার নাম  নিতীন ভট্টাচার্য। আমার পত্নীর সাথে আমার বয়সের পার্থক্য তুলনামূলক ভাবে একটু বেশি।অত বেশিও না। সতেরো বছর।কিন্তু নিতীনবাবু আর তার স্ত্রী সুতপা ভট্টাচার্যের বয়সের পার্থক্য সর্বোচ্চ চার,পাঁচ বছরের হবে।দেখে যা মনে হচ্ছে।মধ্যবয়সী নিতীন বাবু কেন আমার কাছে অপ্রাকৃত ঘটনার কথা জানতে চাচ্ছে।কারণ একটা পেয়েছি।কঠিন কারণ।হয়তো তার কাছে কোনো ভালো গল্প আছে যার ব্যাখ্যা নেই।আমাকে শোনাতে চাচ্ছেন তার অতিপ্রাকৃত ঘটনাটি।ঘটনা শেষে হাসি মুখে বলবেন, গল্পটা কিন্তু সত্যি,আপনাদের মতো লেখকরা এসব সত্য ঘটনায় নাকি সাজিয়ে নিজেদের মত লেখে! আপনিও লিখতে পারেন। কিন্তু শেষে একটু লিখে দিবেন আপনার বিশেষ পরিচিত অমুক(গল্প বলা ব্যক্তিটি) আমাকে ঘটনাটি বলেছিলো।এমন ঘটনা আগে আট,দশ বার ঘটেছে।বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আমি একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়ি।কিন্তু গিন্নী জিনিষগুলো বেস ভালোভাবেই  সামলায়।লেখকদের আসলে বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞার অভাব থাকে।তারা সবসময় কল্পনার জীবন সৃষ্টিতে ব্যস্ত থাকে।’কি হলো অনিন্দ্য স্যার? বলুন বিশ্বাস করেন কি না? আপনি কি কখনো এমন ঘটনা অবসার্ভ করেছেন যার কোনো ব্যাখ্যা দাঁড়াতে পারেননি?’ আমি কথা বলার সিদ্ধান্ত নিলাম।নিতীনবাবু কি বলতে চাচ্ছে শোনা যাক। ‘আজ্ঞে,আমার আসলে ঘরকুনো স্বভাব।এত ঘটনা বাচবিচার করার সুযোগ হয়ে ওঠেনা।’ বেশ নরম গলায় বললাম।নিতীনবাবু মনযোগী শ্রোতা,বেশ বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে আছেন।আমার কথা যেন নয়,আমি বিরাট বড় কোনো ভাষণ দিচ্ছি যার উপর জাতীর ভবিষ্যৎ নির্ভরশীল। ‘আসলে,আমাদের জীবনের বেশ বড় অংশেরই কিন্তু কোনো ব্যাখ্যা নেই।ভেবে দেখুন এসব ঘটনায় কিন্তু অপ্রাকৃত।’ আমি বুঝতে পারছি ভদ্রলোক লম্বা কোনো ঘটনা বলবেন।কিন্তু আজকে আমার শুনতে হবে।আর কোনো কাজ নেই।গিন্নী একটু ব্যক্তিগত সময় কাটাক।বাড়ির কাজ থেকে শুরু করে সে আমার সকল কাজ করে।মেয়েটা কিছুই বলেনা।ওর পৃথিবীতে আমি ছাড়া আর কোনো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি নেই।এতদিন পরে একজন সাথী পেয়েছে যার সাথে দুদণ্ড নিজের মনের কথা বলতে পারবে তা আমি কিভাবে কেড়ে নেই? নেওয়া উচিৎ নয় আমার।’আচ্ছা?এভাবে আমি কখনোই চিন্তা করিনি।একটু গুছিয়ে বলেন যদি!’ উৎসাহ দিলাম নিতীনবাবুকে।নিতীনবাবু বলুক আমি শুনি। ‘আসলে স্যার আমি বোঝাতে চাচ্ছি যে আমরা কিন্তু অনেক অন্ধকারে আছি এখনো।বিজ্ঞানের অগ্রগতি আমাদের অনেক বিষয়ে সঠিক ব্যাখ্যা এনে দিতে পারিনি।যেমন ধরুন ঈশ্বর,ভূত বা আত্মা,এলিয়েন।বিজ্ঞান কিন্তু প্রমাণ পারিনি যে ঈশ্বর সত্যি আছে নাকি নেই।’একটু খারাপ লাগলো শুনতে।অনেক বিজ্ঞানী আছে যারা ধর্মে বিশ্বাসী।যেমন হাসান ইবনে আল-হাইসাম,ইবনে যুহর,আহমেদ এইচ. জেইয়েল,আবদুল কাদের খান,নাসির আল-দিনা আল-তুসি,হরগোবিন্দ খুরানা,প্রশান্তচন্দ্র মহালানবীশ আরো অগণিত নাম বলা যাবে। আমি বললাম,’ঈশ্বর,আল্লাগ,গড,অল মাইটি আছে  সেটা বিজ্ঞান অস্বীকার করেনি কখনোই।তাছাড়া প্রত্যেকটা ধর্মের মুলকথা হলো বিশ্বাস। বিজ্ঞানের মানে হলো শতভাগ নিশ্চিত হয়ে বিশ্বাস।আপনি একটা জিনিস না মানলে বা অস্বীকার করলে যে সেটা নেই হয়ে যাবে, এটা তো হবেনা।’ নিতীনবাবু আগ্রহ নিয়েই শুনছেন।’আচ্ছা,আমি কিছু ঘটনা বলি আপনাকে স্যার।আপনি অবশ্যি বুঝবেন কেন বিজ্ঞানের ব্যাখ্যা বিরোধী আমি।’ আমি মনে মনে হাসলাম।গল্পবলার লাইনে নিতীনবাবু এসেছেন।আমার ধারণা ঠিক হলো একভাবে।আমিও মাথা নেড়ে সম্মতি দিলাম।নিতীনবাবু তার ঝোলা থেকে প্রথম অপ্রাকৃত ঘটনাটা বের করলেন।’তখন দেশ সবে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়েছে।বুঝতে পারছেন হিন্দুদের অবস্থা তখন কেমন?কেউ ভারত যাচ্ছে তো কেউ গ্রামে।অনেকে আবার মুসলমান সাজছে।আমার বয়স তখন পাঁচ  কি সাড়ে পাঁচ।আমার বাবা বিষম দেশপ্রেমিতা দেখিয়ে বলেছেন,’যদি মরণ থাকে তাহলে সেটা নিজ দেশেই হোক।আমি বা আমার পরিবারের কেউ এ ভিটে ছেড়ে যাচ্ছিনা।’ যেমন কথা তেমন কাজ।বাবা আমাদেরসহ কাকা,পিসিদেরও একপ্রকার জোর করে বাড়িতে আটকে রাখলেন।কিন্তু এদিকে বাজারে আগুন,বাড়িঘর পোড়ানো চলছে।মিলিটারিরা গ্রামের পরে গ্রাম পোড়াচ্ছে।হিন্দু বাড়ি জানতে পারলে নির্যাতন কয়েকগুন বেশি।তো একদিন আমাদের বাড়িতে দুইজন মিলিটারি আসলো।সাথে একটু সুন্দরী অল্পবয়স্ক মেয়ে।আমাদের বাড়ি ছিলো পুরানো ধাচের জমিদারি বাড়ি।অনেকগুলো কামরার একতলা বাড়ি।আমরা দিনের বেলা সবাই বাড়ির পিছনদিকে জংগলের সাথে লাগা ঘরটায় থাকতাম।কিন্তু ঐদিন যখন মিলিটারি আসে আমি আর আমার বড় বোন যার বয়স তখন দশ/এগারো বছর বাড়ির সামনের দিকে বসে খেলা করছিলাম।মিলিটারি দ্রুত হেটে আমাদের বাড়ির দিকে আসছে দেখে আমার বড় বোন আমাকে হ্যাঁচকা টান দিয়ে ঘরে নিয়ে যায়।কিন্তু আমরা বড়  দরজা পেরিয়ে ঘরে ঢোকা মাত্রই বাড়ির বারান্দায় প্রথম মিলিটারি পা রাখে।আমরা দৌড়ালে শব্দ হতে পারে আর পিছন ঘরে যাওয়া আরো ভয়াবহ হতে পারে ভেবে দিদি আমাকে নিয়ে বড় আলমারির পাশে আড়সাড় হয়ে বসে।মজার ব্যাপার কি জানেন? মিলিটারি দুটো ঐ ঘরেরই মেয়েটাকে নিয়ে ঢোকে।

আরো পড়ুন  – কখন মিথ্যা বলা যাবে ?

দরজা দিয়ে ঢোকার সময় সহজেই আমাদের দেখা যাওয়ার কথা কিন্তু ওরা দুজনেই আমাদের দেখতে পাইনি।আমাদের সামনেই ওরা সজ্ঞানে পাশবিক নির্যাতন চালায় হাত পা বাধা মেয়েটার উপর।আমরা প্রায়ই ওদের সামনে বসা।দিদি তার হাত দিয়ে সজোরে আমার মুখ চেপে ধরেছেন।আমরা রীতিমত নিজেদের হৃদস্পন্দন শুনতে পাচ্ছি। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো প্রায় একঘন্টা আমরা ওভাবে ওদের সামনে বসে ছিলাম কিন্তু ওরা আমাদের অস্তিত্ব বুঝতে পারিনি।দেখতেই পায়নি আমাদের।এখন আপনি বলবেন মিলিটারিরা নেশা ভাং করেছিলো,মাতাল ছিলো,কিংবা মেয়েটার উপর নজর ছিলো এসব কারণে দেখতে পায়নি।কিন্তু ভাবুন,ওরা দুইজনের কেউই মাতাল ছিলোনা।আর মেয়েটাকে একজন নির্দয় ভাবে প্রহার করছিলো অন্যজন আরেকদিকে তাকিয়ে বসেছিলো।ওদের কথাবার্তা ছিলো স্বাভাবিক ও পরিকল্পিত।আমার বোঝার ক্ষমতা না থাকলেও আমার দিদি সবই দেখেছে বুঝেছে।আপনার কি মতামত?’ আমার দিকে তাকিয়ে আছেন নিতীনবাবু।’আসলে এ ঘটনার কি অন্য কোনো প্রত্যক্ষদর্শী আছে? মানে আপনি ছিলেন ছোটো আর আপনার দিদিরও বয়স বেশিনা।আমার মনে হয় আপনারা আলমারির মধ্যে ছিলেন।বুঝতে পারছেন।আর আলমারির মধ্যে বেশিক্ষণ থাকায় আপনাদের মস্তিষ্কে অক্সিজেনে সংকট হয় আর যে কারণে এই মিলিটারি সামনে দেখার হ্যালুসিনেশন হয়। আপনাদের কথা সত্যি প্রমাণের কিছুকি আছে আপনার কাছে?’ নিতীনবাবু হাসলেন।বললেন,’আপনি সে সাইকোলজি পড়েছেন জানতাম।আমি কিছু সাইকিয়াট্রিস এর কাছে গেছিলাম।বেশিরভাগ এই কথা বলেছে।কিন্তু এ ঘটনা সত্যি কেন জানেন? মেয়েটির লাশ আমাদের বাড়িতে রেখে মিলিটারিরা চলে যায়।আমরাই জংগলে লাশটা পুতে রাখি।আর আমাদের পাশ দিয়ে একজন মিলিটারি পাশের ঘরে যায়।তাও আমাদের দেখতে পায়নি।আমার মা কি বলেন জানেন স্যার?ভগবান নাকি আমাদের কিছু সময়ের জন্য অদৃশ্য করে দিয়েছিলেন। মিলিটারিদের হাত থেকে বাঁচাতে। ‘ আমি কিছুই বললাম না।কোনো মানুষই নিজেকে অন্যদের মত শুনতে পছন্দ করেনা।প্রত্যেকে নিজেকে বিশেষ চরিত্রের মানুষ ভাবে যে চরিত্র সবার থেকে আলাদা।নিজের একটা নিজস্ব সত্তা যেটা কারো সাথে মেলে না।নিতীনবাবু আমাকে অন্য সাইকিয়াট্রিসদের মত বলেছেন।যাইহোক।নিতীনবাবুর ঝুলি মাত্রই খুলেছে।আরো গল্প আছে নিশ্চয়। নিতীনবাবু আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি কৃতজ্ঞতার কণ্ঠে বললাম,’আপনি এইরকম একটিমাত্র ঘটনার সাক্ষী? ‘ যেন নিতীনবাবুর গল্প শোনার জন্য আমি অতি ব্যস্ত ও অত্যাধিক উৎসাহী।নিতীনবাবু হাল্কা মুচকি হাসলেন।বলতেই হবে নিতীনবাবুর হাসি সুন্দর। নিতীনবাবু বলা শুরু করলেন,’আমার দিদি কিন্তু ঐ ঘটনা কাউকে বলেনি।মিলিটারি চলে যাওয়ার পর দিদি কেমন যেন পরিবর্তন হয়ে যায়।আমি মা,বাবা সহ সবাইকে জানাই ঘটনাটি। কিন্তু দিদি চুপ।এর পর থেকেই দিদির মধ্যে অস্বাভাবিকতা দেখা যায়। যেমন সবসময় চুপচাপ থাকা,ঠিকমতো না খাওয়া,একাএকা কথা বলা ইত্যাদি ইত্যাদি।কিছুটা পাগলামি ভাব চলে আসে দিদির মধ্যে।এভাবে ছয় বছর কেটে যায়।আমি তখন বেশ বুঝতে শিখেছি।আশেপাশের পরিবেশ সম্পর্কে আমার ধারণা আছে। আমার নিজের গোপন কথা আছে।যুদ্ধ শুরুর দুইমাস পরেই আমরা বাড়ি ছেড়েছিলাম কেননা ঐ দুই মিলিটারি আমাদের বাড়িটা পছন্দ করে তাদের ক্যাম্প হিসাবে।যুদ্ধ শেষে তিন চারমাস পরেই আমরা ফিরে আসি নিজের বাড়িতে।যা বলছিলাম,দিদির অবস্থা তখন বেশ খারাপ,মানে না খেতে খেতে শুকিয়ে কাঠ বল্লেও কাঠ মোটা হবে দিদির থেকে।তো দিদি প্রচুর অসুস্থ ছিলো।ঐদিন সকালে দিদিকে বেশ উৎফুল্ল্য দেখাচ্ছিলো।দুপুরের একটু আগে  দিদি বেশ স্বাভাবিক সুরে আমাকে ডাকে।আমি দিদির ঘরে গেলে দিদি আমার দিকে তাকিয়ে বলে ‘ছোটন,বোস।আমার কিছু কথা আছে তোর সাথে।’ আমি চুপচাপ বসে পড়ি দিদির পাশে। দিদির চোখ গুলো জ্বলজ্বল করছিলো যেন এক্ষুণি কাঁদবে।আমি দিদির পাশে বসামাত্র দিদি আমার ডান হাত ধরলেন। দিদি বললেন,’জানিস,মিলিটারিদের থেকে আমাদের বাচানোর জন্য কে এসেছিলো? অশোক বাঁচিয়েছিলো আমাদের। তুই অশোককে চিনিস না।কেউই চেনেনা।অবশ্য এতে অশোক কিছু মনে করেনা।তোকে আমি কিছু কথা বলবো খুব গুরুত্বপূর্ণ। অশোক আমাকে ওর সাথে নিয়ে যেতে চাই।আমি অনেক না করেছি,অনেক বোঝাবার চেষ্টা করেছি,রাগ করে না খেয়ে থেকেছি। আমার অবস্থা দেখ।কিন্তু অশোক এইবার আমাকে নিয়েই যাবে।আমার ইচ্ছে না থাকলেও আমার যেতে হবে।অশোক কি করবে জানিস?একটু পর ঐযে ঐ কোণার কাপড়ে আগুন লাগিয়ে দিবে।আমি মুক্ত হয়ে যাবো আর অশোকের সাথে চলে যাবো।তুই কি রাগ করবি এতে?’ আমি বুঝতে পারছিলাম না আমার কি বলা উচিৎ। পাগল হয়ে গেছে দিদি।আর এটা পাগলের প্রলাপ ছাড়া আর কিছুনা।দিদি এত অসুস্থ যে দিদির পক্ষে বিছানা থেকে ওঠা সম্ভব না। আমি বললাম,’না দিদি।মা মনে হয় ডাকছে।আমি শুনে আসি।’ বলেই আমি দিদির ঘর থেকে বের হলাম।আমি বের হওয়া মাত্রই দিদির কথা ভুলে গেলাম। কেননা বন্ধু সৌমিত্রের সাথে আমার বড়পুকুরে মাছ ধরতে যাওয়ার কথা।আমি বড়শি টোপ নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।এর প্রায় আধাঘণ্টা পরেই আমাদের গৃহভৃত্য চিৎকার করতে করতে পুকুরপাড়ে এসে আমাকে খবর দিলো দিদির ঘরে আগুন লেগেছে।’ঘটনার এ পর্যায়ে নিতীনবাবু থামলেন। কষ্টের ছায়া পড়েছে নিতীনবাবুর মুখে চোখে।আমার কি এখন তাকে সান্ত্বনাজনক কিছু কথা বলা উচিৎ?  জানিনা।নিতীনবাবু আবার বলা শুরু করলেন,’দিদি কিন্তু ঐদিন মারা যায়।’ আমি একটু নড়ে বসলাম।Dr. Joseph Murphy র লেখা বিখ্যাত বই “The Power of Subconscious Mind”এর কথাই আমার মনে আসছে।বইটার একটা বিষয় ছিলো, লেখক Dr. Joseph Murphy বলেন – পুরনো যুগের মানুষ অসুস্থ হলে মন্দির, মসজিদ বা চার্চে যেতেন, সাধু, সুফী, সন্তদের কাছে যেতেন, যারা তাদের বিভিন্ন ধরনের তাবিজ, আংটি দিতেন এবং বলতেন এগুলো ব্যবহার করলে তারা সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যাবে।আশ্চর্যজনক ভাবে তারা সুস্থ হয়ে উঠত।সাধু-সন্তরা রোগীদের মনে এই কথাটা গেছে দিতেন যে এই তাবিজ ব্যবহার করলে তারা সুস্থ হয়ে যাবে।এই সুস্থ হয়ে ওঠার ব্যাপারে কোন ম্যাজিক নেই। এই কথাগুলো কেবলমাত্র তাদের অবচেতন মনকে শেখানোর জন্য বলা হত এবং অবচেতন মন তা মেনে নিয়ে তাদের সুস্থ করে তুলত।

আরো পড়ুন – পুরুষ ও মহিলাদের সমকামিতা নিয়ে কিছু কথা

নিতীনবাবুর দিদি দীর্ঘদিন অসুস্থ থেকে একটা জিনিস বুঝতে পেরেছিলেন তিনি মারা যাবেন আর এমন কিছু আন্দাজ করেছিলেন।কিন্তু আমি এসব বলে নিতীনবাবুর ধারণা ভুল প্রমাণ করবো না।বিশ্বাস ভাঙা মন ভাঙার মতোই কষ্টের।নিতীনবাবু একটু হালকা গলায় কাশি দিলেন।আমার দিকে তার উজ্জ্বল বাদামী কালো চোখ দিয়ে তাকিয়ে আছেন।নিতীনবাবু বলা শুরু করলেন,”স্যার,আপনি হয়তো ভাববেন এটাও কাকতালীয় ব্যাপার আর এমন অনেক উদাহরণ আছে যেখানে মৃত ব্যক্তি মৃত্যুর পূর্বে তার মৃত্যুর কথা জানিয়েছে।আমি এসব শুনতে বা বলতে চাচ্ছিনা।এর পরের দু একটা ঘটনা বলি।আমার মা মারা যাওয়ার একমাস পরে আমার বাবাও মারা যায়।এটা ১৯৮৭ সালের দিকের কথা। আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের ছাত্র।মা কিভাবে মারা যায় জানেন? আমাদের বাড়ির পিছনের বড় পুকুরে ডুবে।আমার মা কিন্ত সাঁতরে নদী পার হওয়া মেয়েদের একজন ছিলেন। আর বাবা মারা যায় নিজ ঘরে ঘুমন্ত অবস্থায়।বাবা মারা যাওয়ার আগে আমাকে চিঠিতে বলেছেন ‘তোর দিদি আর মা বেশ সুখে আর আনন্দে আছে।মেয়ে মানুষ তো,একা ছেড়ে দেওয়া কি উচিৎ? আমি কোনো রাস্তা দেখছিনা।তোর শরীর কেমন আছে?’ মা মারা যাওয়ার পনেরো দিন পরেই ঢাকা চলে গেছিলাম পরীক্ষার জন্য।আর বাবা মারা গেলে একই দিনে মাত্র ৩০ দিনের পার্থক্যে আবার বাড়ি আসি।দুইবারই একই কারণে! মৃত্যু।বুঝতে পারছেন স্যার?” নিতীনবাবু মেঝের দিকে তাকিয়ে কথা বলেছেন।এজন্যই বেঁচে গেছি।আমার ভ্রু কুঞ্চিত আর চোখে অবিশ্বাস লেগে আছে যা নিতীনবাবুর না দেখাই ভালো।এত নাটকীয়তা বাস্তবজীবনে।হতেও পারে।তবে হ্যাঁ সৃষ্টিকর্তা আমাদের জীবন নানা বিচিত্র ঘটনাবলি দিয়ে সাজিয়েছেন।যাইহোক,নিতীনবাবু কখন শেষ করবেন কে জানে।নিতীনবাবু বলছেন,”আপনাকে এসব কথা বলার কোনো উদ্দেশ্য নেই।আমার কিছু জিনিষ জানার ইচ্ছা স্যার।আমার জীবন এমন অপ্রাকৃত ঘটনায় পরিপূর্ণ। কিন্তু এই বর্তমান সময়ে মানে এখন যে অপ্রাকৃত ঘটনা ঘটছে সেটা আমি আপনাকে বলবো।এরপর আপনিই বিবেচনা করবেন।আমার স্ত্রীর সাথে পরিচয় হয় হাসপাতালে।আমার এক কাকীমা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলো আর আমার স্ত্রী,সুতপা ঐ হাসপাতালের নার্স ছিলো।মোটকথা এক মৃত্যু পথযাত্রী মানুষের মাধ্যমে আমাদের পরিচয়।আমাদের বিয়ে হয়েছে বছর দুই।আট মাস আগে আমার স্ত্রীর গ্রামের বাড়ি নারায়ণগঞ্জ থেকে ফেরার সময় আমার স্ত্রী সড়ক দূর্ঘটনার কবলে পড়ে।ওর মাথায় বারোটা সেলাই লেগেছে।কিন্তু আজব ব্যাপার হলো দূর্ঘটনার পর থেকে অনেক কিছু ভুলে গেছে।বিগত বছর দুয়েকের হালকা স্মৃতি আছে ওর।যেমন ওর ছোটোবেলার কথা,স্কুল কলেজ,এমনি হাসপাতালেও জয়েন করেনি।ওর কিছু বান্ধবী এসেছিলো ছোটোবেলার।বিশ্বাস করবেন কি না জানিনা, একজন কেউও চিনতে পারেনি ও।এমনকি আমাকেও মাঝে মাঝে চিনতে পারেনা।বুঝতে পারছেন? কিন্তু আপনার স্ত্রীকে দেখা মাত্রই সে নাম ধরে ডেকেছে,আপনার বাড়িতে এসেছে এমনকি সে আপনার স্ত্রীর সাথে কথা বলছে।আমি নিশ্চিত আপনার স্ত্রী ওর অ্যাক্সিডেন্টের কথা কিছুই জানেনা।এমন ঘটনা আজকে আমি প্রথম দেখলাম।এটা কি স্বাভাবিক? অনেকের সাথে দেখা,পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়েছে ওকে।কাউকে ও নিজে থেকে চিনতে পারেনি।আর আমার মনে ক্ষীন সম্ভাবনা আছে পরিচয়ের পরেও কি ও চিনতে পেরেছে ওদের।”

আরো পড়ুন – স্বপ্নভঙ্গ 

 

পরিশিষ্ট :

নিতীনবাবু ও তার স্ত্রী ঘণ্টা দুয়েক আগে চলে গেছেন।আমার ধর্মপত্নী চা বানিয়ে আনতে গেছে।আমি নিতীনবাবুর স্ত্রীর কথা শুনেছি একটু আগে তার কাছে।যা জানতে পেরেছি তার সাথে আমার বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারার উপর বিশ্বাসটা পুনঃরুদ্ধার হয়েছে।তিন মাস আগে মানসিক হাসপাতাল থেকে বাড়ি এসেছেন নিতীনবাবু। তার বাবা,মা এবং বোন জীবিত।বছর দুয়েক আগে বন্ধুদের সাথে বাজি ধরে একা একরাত বড়,ফাকা শ্মশানে কাটানোর পরে তার চরিত্রে কিছু পরিবর্তন দেখা যায়।মাঝে এত ভায়োলেন্ট হয়ে ওঠেন যে মানসিক হাসপাতালে পাঠাতে বাধ্য হয় তার পরিবারবর্গ।সকল পরিক্ষায় প্রায় প্রমাণিত তিনি সুস্থ।শুধু অন্য এক জগতে বাস করেন যেখানে তার বাবা,মা,বোন মৃত আর তার স্ত্রী অসুস্থ। বিলি মিলিগান নামে এক আমেরিকান ব্যক্তির মানসিক চিকিৎসায় উঠে এসেছিলো তিনি একসাথে আরো চব্বিশটি চরিত্রের অধিকারী।মাল্টিপল পারসোনালিটি ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত এ ব্যক্তি একাধিক ধর্ষণ এর অপরাধে গ্রেফতার হলে মনোবিজ্ঞানীদের পরীক্ষায় চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসে। নিতীনবাবুর মতোই বলতে ইচ্ছে করছে ” বুঝতে পারছেন স্যার।”

 

Leave a Comment