স্বামী-স্ত্রীর মাঝে ঝগড়া হলে করণীয় | দীদার মাহদী

একটি অপরিচিত মেয়ে বিয়ে করে আনার দিন থেকেই সে সবচেয়ে কাছের মানুষে পরিণত হয় পুরুষের ৷ তার সুখ দুঃখই যেনো স্বামীর সুখ দুঃখ ৷ স্ত্রীর কল্যাণ কামনাই তখন ব্রত হয়ে ওঠে ৷ এ সুখ সহ্য হয়না শয়তানের ৷ তাই আবার সংসার জীবন কারো কারো জন্য স্বর্গ না হয়ে, হতে পারে জ্বলন্ত জাহান্নাম। অনেক অনাস্থা ও দূরত্বের কারণে জীবনের কোনো স্বাদ উপভোগ করতে পারেন না। হাদিসের এ ব্যাপারেও বর্ণনা পাওয়া যায়। রাসূল (সা.) বলেন, দিন শেষে শয়তানের দল ইবলিসের কাছে নিজেদের অপকর্মের হিসেব দেয়। কেউ বলে, আমি এত জনকে বেঈমান করে রেখে এসেছি। সুদের লেনদেনে লিপ্ত করার বয়ান শোনায় কেউ কেউ। এভাবে বিভিন্ন অপকর্মের তালিকা তুলে ধরা হয়। শেষে একজন নিজের দুর্বলতা প্রকাশ করে বলে, আমি তেমন কিছুই করতে পারি নাই। তবে স্বামী-স্ত্রীর মাঝে ঝগড়া লাগিয়ে এসেছি। ইবলিস এই অপকর্মে এত বেশি খুশি হয় যে, ওই শয়তানকে নিয়ে নাচতে থাকে।’

এর দ্বারা বুঝা যায় স্বামী-স্ত্রীর মাঝে ঝগড়া কত সুদূর প্রসারী খারাপ পরিণতি বয়ে আনতে পারে।
বিশ্বনবী সাঃ আমাদের জানান,
‘স্বামী-স্ত্রীর মাঝে শয়তানে ঝগড়া লাগিয়ে দেয়, যাতে তারা একজন থেকে আরেকজন পৃথক হয়ে যায়।’

এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ হাদীস ৷ সংসারজীবনে এই হাদীসটি আপনাকে আলো দেখাবে ৷ সকল প্রকার মান অভিমান, ঝগড়া বিবাদ থেকে বাঁচাবে ৷ সুতরাং রাসূলুল্লাহ (সা.) এর উপরোক্ত হাদিসটি সবসময় মাথায় রাখুন। এবং ঝগড়া-বিবাদ এড়িয়ে চলে শয়তানকে পরাজিত করুন।

একসাথে থাকলে একটু মিষ্টি বা তেঁতো ঝগড়া বা তর্ক হতেই পারে ৷ হয়ও ৷ এতে যেমন ভালোবাসা বৃদ্ধি পায়, তেমন এ ঝগড়া স্থায়ী করলে সংসারে ভাঙন দেখা দিতে পারে ৷ কিন্তু আপনাকে ভালোবাসার ঘরটি টিকিয়ে রাখতে হবে ৷ ধৈর্যহারা হলে চলবে না ৷ আপনার স্ত্রী যদি কোনো কারণে আপনার প্রতি বিরক্ত বা রেগেই থাকে তাহলে আসুন তার রাগ ভাঙানোর কিছু কৌশল আয়ত্ব করা যাক ৷

প্রথমে স্ত্রীর রাগ-অভিমানের কারণ নির্ণয় করুন। স্ত্রীর রাগারাগির সময় সঙ্গে সঙ্গে প্রতিউত্তর করে ঝগড়া না বাড়িয়ে বরং ধৈর্য্যশীলতার পরিচয় দিয়ে চুপ থাকুন। সেখান থেকে তা সম্ভব না হলে, অন্য ঘরে চলে যান। এরপর স্ত্রীর মেজাজ ঠান্ডা হওয়ার পর দরদের সঙ্গে বাস্তব অবস্থা বুঝিয়ে তার মান-অভিমান বা রাগ ভেঙ্গে দিন।
পরিস্থিতি যদি সীমার বাইরে চলে যায়, স্ত্রীর রাগ সামাল দেয়ার মত স্বামীর সামর্থ্য আর না থাকে, তাহলে স্ত্রীর নিকটস্থ ঘনিষ্টজনদের ডেকে তাদের মাধ্যমে সমস্যা নিষ্পত্তি করতে হবে। (সূরা নিসা : ৩৫)

স্বামীর উচিত স্ত্রী’র সাধারণ ভুলগুলো ক্ষমা করা এবং পরবর্তীতে না করার জন্য হাসিমুখে শুধরে দেয়া। স্ত্রী দোষ করে থাকলে বার বার তার দোষগুলো না বলাই উত্তম। অন্যথায় সমস্যা আরো প্রকট হতে পারে।

স্ত্রীকে তার পছন্দের হাদিয়া-উপঢৌকন দেয়া যেতে পারে। একান্ত মুহূর্তে ইসলামের কথা, হেদায়াতের কথা বোঝানো যেতে পারে এবং স্ত্রীকে ইসলাম ভালোভাবে বুঝার জন্য বই-পত্র কিনে এনে দেয়া যেতে পারে।

এভাবে কৌশলের মাধ্যমে স্ত্রী’র রাগ প্রশমিত করার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে এবং এক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি না করাই স্বামীর কর্তব্য।

কেননা রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘হে পুরুষেরা! তোমরা নারীদেরকে সর্বদা সদুপদেশ দাও। কেননা তাদেরকে সৃষ্টি করা হয়েছে বাম পাঁজরের বাঁকা হাড় দিয়ে। তুমি যদি তাকে সোজা করতে চাও, তাহলে তা ভেঙ্গে যাবে। আর যদি একেবারে ছেড়ে দাও তাহলে সে বাঁকাই থাকবে।’ (বুখারি : ৫১৮৬)

তাহলে হাদিসের ভাষ্য অনুযায়ী স্ত্রীলোকদেরকে সৃষ্টি করা হয়েছে বাম পাঁজরের বাঁকা হাড় দিয়ে (রূপকার্থে)। তাদের আচরণের মাঝে কিছুটা বক্রতা থাকবেই। অপরদিকে কেউ সেই বক্রতাকে একেবারে সোজা করার কল্পনা করা নিষ্ফল ও অলীক ধারণা। সেরকম কিছুতে তা ভেঙ্গে যাওয়ার আশংকা আছে বলে হাদিসে সতর্ক করা হয়েছে।

তাই নারী তথা স্ত্রী’র বক্রতাকে মেনে নিয়েই হেকমত ও কৌশলের সঙ্গে ঠান্ডা মাথায় বুঝিয়ে তাদেরকে মানিয়ে নিয়ে ঘর সংসার চালিয়ে যাওয়াই স্বামীর কর্তব্য।

আর মনে রাখা বাঞ্ছনীয় যে, আপনার স্ত্রীও একজন মানুষ। ভালোলাগা, খারাপলাগা তারও থাকতে পারে। সবার বুঝ একই রকম হয় না। অনেকেই মনে করে, আরেকটা বিয়ে করলে শান্তি পাবো। মূলত সেইখানেও শান্তি মিলে না। শান্তি বিবাহে নয়, শান্তি থাকে মনে, বন্ধুত্বময় সম্পর্কে, নিজের সুখের চেয়ে অন্যকে সুখে রাখার মাঝে। অন্যায়ভাবে জুলুমকারী কখনোই রেহাই পাবে না। অবশ্যই স্বামীকে এর কঠিন জবাবদিহিতা করতে হবে আল্লাহর সামনে।

মহান রাব্বুল আলামিন আল্লাহ তায়ালার দরবারে দোয়া করি সুন্দর হোক, ভালো থাকুক প্রতিটি সম্পর্ক।

আর যদি আপনিই রেগে থাকেন, তখন নিম্নোক্ত পদক্ষেপ নিন ৷
১. স্ত্রী কোনো কথা বললে তা ধৈর্য ধরে শোনার অভ্যাস করুন। প্রথমে শুনুন, এর পর ভালোভাবে বুঝে উত্তর দিন।

২. রাগের মাথায় কখনও কোনো সিদ্ধান্ত নেবেন না। কারণ রাগের মাথায় সিদ্ধান্ত আপনার বড় ধরনের ক্ষতি হতে পারে। সবসময় মাথা ঠাণ্ডা করে সিদ্ধান্ত নিন।

৩. মাথা গরম হলে স্ত্রী আপনাকে দোষারোপ করবেন, এটিই স্বাভাবিক। চুপচাপ সব দোষারোপ মেনে নেবেন না। পরিস্থিতি একটু শান্ত হলে বোঝান, তার রাগের সব দায় আপনার নয় এবং সাংসারিক সব ত্রুটিবিচ্যুতির দায়ও আপনি নেবেন না।

৪. সবরকম আলাপ-আলোচনা, বোঝানোর চেষ্টা ব্যর্থ হলে পেশাদার কাউন্সেলিং ছাড়া উপায় নেই। আর উনি যদি থেরাপির সাহায্য নিতে সম্মত না হন, তা হলে সম্পর্কের ভবিষ্যৎ নিয়ে আপনাকেই ভাবনাচিন্তা শুরু করতে হবে।

৫. রাগ নিয়ন্ত্রণের জন্য ঘোরাঘুরি বেশ ভালো একটি মাধ্যম। রাগ হোক আর মন খারাপ হোক- ঘুরতে যান প্রিয় কোনো জায়গায়। হারিয়ে যান প্রকৃতির মাঝে। দেখুন রাগ কমবে মনও ভালো থাকবে।

সবসময় সম্পর্ককে টিকিয়ে এগিয়ে নেয়ার দায়িত্ব স্বামী হিসেবে আপনার ৷ একান্ত অপারগ হলে ইসলাম সে বিধান আপনাকে দিয়েছে ৷

কুরআন বলছে-

وَ اِنۡ خِفۡتُمۡ شِقَاقَ بَیۡنِہِمَا فَابۡعَثُوۡا حَکَمًا مِّنۡ اَہۡلِہٖ وَ حَکَمًا مِّنۡ اَہۡلِہَا ۚ اِنۡ یُّرِیۡدَاۤ اِصۡلَاحًا یُّوَفِّقِ اللّٰہُ بَیۡنَہُمَا ؕ اِنَّ اللّٰہَ کَانَ عَلِیۡمًا خَبِیۡرًا ﴿۳۵﴾

আর যদি তোমরা তাদের উভয়ের মধ্যে বিচ্ছেদের আশঙ্কা কর তাহলে স্বামীর পরিবার থেকে একজন বিচারক এবং স্ত্রীর পরিবার থেকে একজন বিচারক পাঠাও। যদি তারা মীমাংসা চায় তাহলে আল্লাহ উভয়ের মধ্যে মিল করে দেবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বজ্ঞানী, সম্যক অবগত।
[সূরা নিসা, আয়াত ৩৫]

আল্লাহ আমাদের ভালোবাসা অটুট রাখুন ৷ প্রতিটি দাম্পত্যি সুখে থাকুক ৷ আমীন ৷

লেখক
দীদার মাহদী
ভাইস প্রিন্সিপ্যাল
দারুলহুদা মডেল মাদরাসা
কোদালপুর, গোসাইরহাট, শরীয়তপুর

Leave a Comment