হিন্দু হয়েও কেবল নামের কারণে পেলেন জানাজা ও দাফন এর সম্মান

বাবুল চন্দ্র দাস। বয়স ৫০ বছর। পেশায় দর্জিশ্রমিক। নারায়ণগঞ্জ শহরতলীর সৈয়দপুর এলাকায় গত ছয় বছর ধরে দর্জি দোকানে কাজ করেন। পরিবারের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার দোকানে তার খাওয়া দাওয়া, দোকানেই তার রাত কাটে। সম্প্রতি করোনায় আক্রান্ত হন বাবুল চন্দ্র দাস। স্থানীয়রা তাকে প্রথমে মহাখালী একটা হাসপাতালে চিকিৎসা করায়। পরে তাকে স্থানীয় ওয়ার্ড মেম্বারের সহায়তা ভর্তি করা নারায়ণগঞ্জ ৩০০ শ’ শয্যা হাসপাতালে। ভর্তি করার সময় বাবুল চন্দ্র দাসের নাম সংক্ষিপ্ত করে শুধু বাবুল লেখা হয়। শনিবার দুপুরে হাসপাতালে মারা যান বাবুল চন্দ্র দাস। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ার খবরে বাবুল চন্দ্র দাসের লাশ নিতে আসেনি কেউ। পরিবারে মুঠোফোনে খবর পাঠানোর পরও কেউ আসেনি লাশ নিতে।

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বাবুলের লাশ নিয়ে পড়ে বিপাকে। পরে স্থানীয় কাউন্সিলর শওকত হাসেম শকুকে জানানো হলে তিনি ও আরেক কাউন্সিলর আফরোজা হাসান বিভা লাশ গ্রহণ করেন। হাসপাতালে রেকর্ড অনুযায়ী মৃতের নাম বাবুল লেখা থাকায় এবং খতনা হওয়ায় তাকে মুসলিম মনে করে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনে দাফন টিম বাবুলের সৎকার না করে তার জানাজা এবং দাফন করে ফেলে।

এদিকে হিন্দু ধর্মালম্বী বাবুল চন্দ্র দাসের জানাজা ও দাফন করার খবরে তার পরিবার ও তার কর্মস্থল সৈয়দপুর এলাকায় তোলপাড় শুরু হয়। এনিয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে দোষারোপ করে তারা।

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব জ্ঞানহীন অবহেলায় ক্ষোভ প্রকাশ করে বাবুল চন্দ্র দাসকে হাসপাতালে নিয়ে আসা নারায়ণগঞ্জের গোগনগর ইউপি সদস্য সৈকত হোসেন রোববার রাতে জানান, বাবুল হিন্দু। তার মৃত্যুর পরপর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আমাদের জানালে আমরাই তার সৎকারের ব্যবস্থা করতাম।

হাসপাতালের সুপারইনটেনডেন্ট ডাঃ এম এ বাশার জানান, শনিবার সকালে হাসপাতালে আইসোলেশনে থাকা করোনা রোগী বাবুল মারা যান। শনিবার দুপুরে হাসপাতালের এন্ট্রি খাতার তথ্যানুযায়ী মৃত রোগীর নাম বাবুল। বয়স ৫০। সৈকত নামের একজন তাকে হাসপাতালে নিয়ে এসেছেন। সৈয়দপুর এলাকায় তার বাড়ি।

ওই সময় তিনি জানান, হাসপাতালে ভর্তির পর থেকে তার আত্মীয়রা কেউ খোঁজ নেয়নি। মৃত্যুর পর তার পরিবারকে জানানো হলেও করোনা রোগী হওয়ায় তারা লাশ নিতে চাচ্ছে না। তাই লাশ দাফনের জন্য নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের কাউন্সিলর শওকত হাশেম শকুকে জানানো হয়েছে।

হাসপাতাল সুপার খবর দেয়ার পর নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের কাউন্সিলর শওকত হাশেম শকু, সিটি কর্পোরেশনের দাফন টিম এসে লাশ দাফনের ব্যবস্থা করে। কাউন্সিলর শওকত হাশেম শকু জানান, যেহেতু হাসপাতালের নামের রেকর্ড মৃতের নাম বাবুল উল্লেখ করা হয়, তা-ই মুসলমান হিসেবে আমরা লাশ দাফনের ব্যবস্থা করি। এছাড়া গোসলের সময় মৃতকে খতনা করা দেখতে পাই।

তবে খতনার বিষয়ে হিন্দু ধর্মালম্বী গৌতম সাহা রোববার রাতে মিডিয়াকে জানান, বাবুল চন্দ্র দাস হিন্দু ধর্মালম্বী। এলাকার লোকজনের সাথে কথা বলে জেনেছি। আর অনেক সময় অসুস্থতার কারণে অনেক হিন্দু ধর্মালম্বীর খতনা করা হয়। বাবুল ধর্মান্তরিত হয়েছে এমন কোনো তথ্য নেই বলে জানান তিনি।

বাবুল দাসকে হাসপাতালে নিয়ে আসা নারায়ণগঞ্জের গোগনগর ইউপি’র ৪ নং ওয়ার্ড সদস্য সৈকত হোসেন জানান, বাবুল চন্দ্র দাস ছয় বছর ধরে আমাদের এলাকার খোকন মন্ডল খোকার দোকানে দর্জি হিসেবে কাজ করতেন। নিজ পরিবারের সাথে তার যোগাযোগ নেই বললেই চলে। তাই তিনি দোকানেই ঘুমাতেন। হোটেলে খেতেন। গত বুধবার তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে আমরা তাকে মহাখালি নিয়ে যাই চিকিৎসা করাতে। সেখানে তাকে পরীক্ষা করে দেখে যে তার করোনা পজিটিভ। এরপর তাকে গত ১৫ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ তিন শ’ শয্যা হাসপাতালে এনে ভর্তি করি। ভর্তির সময়ই আমরা তার নাম বাবুল চন্দ্র দাস বললেও তার পুরো নাম লেখা হয়নি।

তার মৃত্যুর পর পরই যদি আমাদের ফোন দিতো তাহলে আমরা হাসপাতালে গেলে লাশ হিন্দু না মুসলিম তা শনাক্ত হতো। আর তার লাশ সৎকারের ব্যবস্থা আমরাই করতাম। বাবুলের খতনা করা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, তিনি হিন্দু হলেও তার খতনা করা ছিল।

মৃত বাবুল দাসের সাথে তার স্ত্রীর ১০-১৫ বছর ধরে সম্পর্ক নেই বলে জানান তার মেয়ে কৃষ্ণা রানী দাস। তিনি চাঁদপুরের মতলব উপজেলার লবারকান্দিতে থাকেন। টেলিফোনে তিনি জানান, অন্তর নামের তার এক ভাই রয়েছে। তার বাবা যার দোকানে কাজ করতেন ওই খোকন মন্ডলের কাছ থেকেই তিনি তার বাবার মৃত্যুর খবর পান। হাসপাতালের কেউ তাকে তার বাবার মৃত্যুর খবর জানায়নি।

তিনি জানান, লকডাউনের কারণে তার পক্ষে নারায়ণগঞ্জ আসা সম্ভব না। তার বাবা যে এলাকায় থাকতেন তিনিও সেখানকার সবার সহায়তা নিয়েই সৎকারের ব্যবস্থা করতেন।

রোববার বিকেলে হাসপাতাল সুপার ডাঃ বাশার বলেন, বাবুল করোনা পজিটিভ এটি জানার পর থেকেই তার পরিবার যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। যেদিন বাবুল মারা যান ওই দিন বারবার তার পরিবারকে ফোন দেয়া হয়। কিন্তু তাদের সাথে যোগাযোগ করা যায়নি। তারা লাশ গ্রহণ না করায় পরে সিটি কর্পোরেশনের তার দাফনের ব্যবস্থা করা হয়। হাসপাতালে তার নাম বাবুল রেকর্ড করা হয়। স্বাভাবিকভাবে ধরে নেয়া হয় তিনি মুসলিম।

তিনি আরো বলেন, তার পরিবারের সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি বলেই এ কনফিউশন তৈরী হয়েছে। হাসাপাতাল থেকে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়নি- এমন অভিযোগের ব্যপারে তিনি বলেন, আমাদের নার্স ডাক্তাররা বারবার যোগাযোগের চেষ্টা করেছে।

তথ্যসূত্রঃ নয়া দিগন্ত