স্বপ্নভঙ্গ
জুবায়েদ মোস্তফা
—————————-
রিমি নিঃসন্দেহে একজন বুদ্ধিমতী মেয়ে।স্কুল জীবনে যত পাবলিক পরীক্ষায়
অংশগ্রহণ করেছে বার বারই দারুণ সাফল্যের ছোঁয়া পেয়েছে।
প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী,জেএসসি, এসএসসি প্রতিটি পরীক্ষায়
নিজের সক্ষমতা জানান দিয়েছেন।নাম উজ্জ্বল করেছেন স্বীয়
প্রতিষ্ঠানের।রিমি সবসময় পড়াশোনায় বেশ মনোযোগী।
সে মেয়ে হিসাবে বড়ই শান্তশিষ্ট। সে মা বাবার ২য় সন্তান, রিমির বড় একজন আপু এবং
ছোট ভাই রয়েছে।ছোট ভাই আরো তুখোড় মেধাবী। রিমির চেয়েও সে বেশি মেধার
স্বাক্ষর রেখেছে।রিমির বাবা মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকুরি করেন।
এই ভদ্রলোকের খুব ইচ্ছা মেয়ে রিমিকে ডাক্তার বানাবে।মেয়ে একদিন বড় ডাক্তার হবে,
দেশের মানুষের সেবায় নিয়োজিত হবে।সরকারী মেডিকেলে সুযোগ না পেলে প্রাইভেট
মেডিকেলে হলেও মেয়েকে পড়ানো, ভদ্রলোকের প্রখর জেদ।সেই প্রতীক্ষায় এইচএসসি
পরীক্ষা শেষ হতে না হতেই রিমিকে মেডিকেল কোচিংয়ে ভর্তি করানো হল।রিমিও লক্ষ্য
স্থির করে সে লক্ষ্যের দিকে অগ্রসর হতে লাগল।একনিষ্ঠ মন নিয়ে পড়াশোনায় মনোনিবেশ
করল।
কয়েক মাস পর রেজাল্ট দেয়ার দিন এগিয়ে আসল।রিমিকে নিয়ে সবাই প্রত্যাশার তুঙ্গে,
রিমি প্রতিবারের ন্যায় এইচএসসি পরীক্ষায় সেরা সাফল্য বয়ে আনবে।
কিন্তু এবার আর সেটা হয়ে ওঠল না।
ভাগ্যের চাকা উল্টো ঘুরলো সে মাত্র এ মাইনাস পেয়েছে।
রেজাল্ট শুনা মাত্রই রিমির মাথায় যেন মস্ত বড় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল।
কোন ভাবেই বুঝতে পারছে না এত বাজে রেজাল্ট কিভাবে করতে পারে।
তার বন্ধুরা তাকে ফোন করে গর্বের সহিত তাদের সাফল্য বলতে লাগল। রিমি নিশ্চুপ, নির্বাক।তার জবার দেয়ার মতো কিছু নেয়।
এমন অপ্রত্যাশিত রেজাল্ট মোটেও তার সাথে যায় না।
এক বন্ধু রিমিকে ফোন করল।
আরো পড়ুন – মোজাম্মেল হক সরদারের কবিতা ‘অসহায় তারা’
-কিরে রিমি তোর যে বেশ কিছুদিন ধরে একদম খোঁজ খবর নেয়?
-এমনি।
-বল তো রিমি তোর কি হয়ছে?কেমন যেন হয়ে যাচ্ছিস তুই?
-রিমি নিশ্চুম।কি বলবে উত্তর জানা নেই তার।
-একটু পর বন্ধু বলল,আরে রিমি তোর রেজাল্ট কি?বললি না তো একবার।
-হাতাশার সুরে বলল, বলার মতো হলে তো বলতামই।
-বলল না কি পেয়েছিস বন্ধু?
– আর বলিস না রে এ মাইনাস পেয়েছি।
– কি বলিস এসব?তুই এ মাইনাস পেয়েছিস কিভাবে সম্ভব?
তোর চেয়ে অনেক অনেক বাজে শিক্ষার্থীরাও তো বেশ ভাল করেছে।
-কথাটি শুনে রিমি আরো হতাশায় ভেঙ্গে পড়ল।
রিমি ঠিক মতো খাওয়া দাওয়া করছে।ঘুমও যেন রিমির জন্য নিষ্ঠুর হয়ে গেল।
ঘুমও আসতে চায় না ঠিক মতো।কেমন এক অদ্ভুত পরিবর্তন ঘটল রিমির মধ্যে।
হতাশা চাদর একদমই ঢেকে দিয়েছে রিমিকে।
এমতাবস্থায় ফেসবুকে একজনের সাথে পরিচয় হল তার নাম রিমন।রিমনও সেবার এইচএসসি তে এ মাইনাস পেয়েছে।তাদের পয়েন্টও সমান।তারা দুজনই একই পথের পথিক।২ জন ২ জনকে বেশ বুঝে।
একে অপরের সাথে কথা বলেই তাদের দিন অতিবাহিত হয়।তারা এক জন অন্যজনের সাথে দুঃখ কষ্ট
শেয়ার করে।কষ্ট পেলে ভেঙ্গে না পড়তে সান্ত্বনা দেয়।একদিনও একে অপরের সাথে কথা না বলে থাকতে পারে না।
তাদের মধ্যে একটা আত্মার সম্পর্ক সৃষ্টি হল।তাদের মধ্যে অল্প দিনেই বেশ রসায়ন জমে ওঠেছে।
এতদিন ধরে রিমিকে নিয়ে তার বাবা মেডিকেলে পড়ানোর জন্য স্বপ্ন দেখতো।সমস্ত স্বপ্ন ভেস্তে গেল।
মুহূর্তেই ভেঙ্গে চূড়মার হয়ে গেল।স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে গেল,বাস্তবায়ন আর হলো না।
রিমির রেজাল্টের কারণে মেডিকেলে পরীক্ষা দেয়ার যোগ্যতাই হল না।
রিমি বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে শুরু করল।
সব ছাত্র ছাত্রীরই স্বপ্ন থাকে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ঘিরে।
কিন্তু রিমি হাঁটছে উল্টো পথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি তার কোন আগ্রহ নেয়।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর এবং আয়তনে দেশের চতুর্থ বৃহত্তম বিশ্ববিদ্যালয় জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া ছোটবেলার স্বপ্ন।বর্তমানে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাওয়া মনে হয় সবচেয়ে কঠিন।
এক আসনের বিপরীতে শত শত শিক্ষার্থী লড়াই করে।আসন সংখ্যাও নিতান্তই কম।
রিমি মন স্থির করল,হতাশা ভুলে আবার পড়ায় মন দিল।নিয়মিত পড়াশোনা করছে আগের মতো।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা সবার আগে শুরু হয়।তাদের প্রশ্ন পদ্ধতিও বেশ জটিল।
কারোরও তেমন ভাল ধারনা নেয় প্রশ্ন সম্পর্কে। আস্তে আস্তে জাহাঙ্গীরনগরের পরীক্ষা ঘনিয়ে আসতে লাগল।
রিমিও নিজেকে ভাল ভাবে প্রস্তুত করছে।সময়কে সঠিক ভাবে কাজে লাগাচ্ছে।
জাহাঙ্গীরনগর হাসি মুখে পরীক্ষা দিতে গেল।মুহূর্তেই দৃশ্যটা পাল্টে গেল।
মনে হল, এ যেন ক্ষনে ক্ষণে গিরগিটির মতোই রং পাল্টায়।
পরীক্ষার হলে ঢুকে রিমির মাথায় হাত।কি অদ্ভুত কিছুই যেন পারছেনা রিমি।বাসা থেকে এতোদিনে যা পড়ল
তার কিছুই তো এলো না।জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিফটে শিফটে পরীক্ষা।তাই পরের দিনেই রেজাল্ট
প্রকাশ করতে পারল।নিয়মানুযায়ী পরদিন রেজাল্ট দিল,রিমি আহামরি কোন ভাল রেজাল্ট করতে পারে নি।
রিমির পরিবার পরহেজগার প্রকৃতির। তারা মেয়েরা ভার্সিটিতে পড়াশুনা করানোর পক্ষপাতিত্ব না।
তাই মেয়েকে হাত ছাড়া করতে চায় না,হাতের মুঠোয় রাখতে চায়।মানুষ পরিবেশে দাস।
দেখতে দেখতে অনেক কিছুই অভ্যাসে পরিণত হয়ে যায়।
রিমির পরিবার দৃঢ় মনে বিশ্বাস করে,ভার্সিটিতে পড়াশোনা করার ফলে স্বভাব,চাল -চলন, আচার- আচরণে
প্রভাব পড়বে।এ কথা মনে ধারণ করে তারা কোথাও রিমিকে পরীক্ষা দিতে দেয় নি।
পরে তারা ভাবল,তাদের নিজ জেলায় বাড়ির পাশে একটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে।এই খানে
রিমিকে পরীক্ষা দেওয়াবে।পরিকল্পনা মোতাবেক রিমিকে পরীক্ষাও দেয়ানো হল।
প্রত্যাশা অনুযায়ী কোন ভাল রেজাল্ট করতে পারে নি।
মেডিকেলে পড়ানোর আশায় অনেক আগে ধূলিসাৎ হয়ে যাওয়ায় রিমির বাবার ইচ্ছা
রিমিকে নার্সিংয়ে পড়ানো।এজন্য রিমিকে নার্সিংয়ে এপ্লাই করাইছে।
মনে স্থির করে শেষ ভরসা হিসাবে নার্সিংয়ে পরীক্ষা দেওয়ার জন্য রওয়ানা হল।
মাঝ পথে গিয়ে হঠাৎ দেখে এডমিট তুলে নি।
এখন এডমিট কার্ড তুলার জন্য আর সময়ও নেই।কি আর করার মন খারাপ
করে হতশ্রী মুখ নিয়েই বাড়ি ফিরলো।
রিমি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার স্বপ্ন দেখে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয় নি।
এক বছর রিমির জীবন হতে হারিয়ে গেল।
রিমি নতুন করে আবার ভর্তি পরীক্ষা দেবে বলে মন স্থির করল।দিনে দিনে রিমির
পড়ার গতি বেড়েই চলছে।সাফল্য আসতে হবে, এটাই এখন রিমির একমাত্র লক্ষ্য।
রিমি এবং রিমন একে অপরকে অনেক বুঝে।অনায়াসে মনের সকল দুঃখ কষ্ট
একে অপরের সাথে শেয়ার করতে পারে।রিমি এবং রিমন একে অপরের সাথে
পরামর্শ করে পড়াশোনা করছে।রিমি কিছু না বুঝলে রিমনকে বললে রিমন
খুশি মনে সলভ করে দেয়।রিমির পড়াশোনায় যে ঘাটতি ছিল
তা আস্তে আস্তে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠছে।এবার ভাল কিছুর প্রত্যাশা রিমির মনে।
রিমির চিন্তাধারা গত বার ২ টি বিশ্ববিদ্যালয়ে দিলেও এবার বেশ কিছু
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দেবে।মেয়ে মানুষ একা যেতে সমস্যা দেশের
নানা প্রান্তে। তাই এবার আগে থেকেই রিমি বান্ধবীদের সাথে কথা
বলে রাখছে।যাতে যাওয়া আসার কোন অসুবিধা না হয়।
এডমিশনের সময় ঘনিয়ে আসছে।জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে
সার্কুলার প্রকাশ হয়েছে।প্রকাশ হওয়া মাত্রই রিমন রিমিকে
ফোন দিল।তাকে সার্কুলার প্রকাশের কথা জানালো।সেই সাথে
বললো,রিমন আর রিমি একসাথে আবেদন করবে।
তারা ২ জন যেন একসাথে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারে।
রিমন মনের তীব্র বাসনা রিমির সাথে একই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে
অধ্যয়ন করা।রিমিকে প্রয়োজনে সর্বোচ্চ সাহায্য করবে পরীক্ষার হলে।
তবু রিমিকে রিমনের সাথে সঙ্গী হিসাবে চায়।রিমি বলল, আমার সাথে আবেদন
করতে হলে কয়েকদিন অপেক্ষা করতে হবে।রিমন সে কথার ওপর
ভিত্তি করে অনেকদিন অপেক্ষা করলো।রিমির বাবা আবেদন করতে রাজি
হচ্ছিল না।তবু রিমন দৃঢ় প্রতিক্ষায় আছে রিমির সাথে আবেদন করবে।
অপেক্ষা করতে করতে সময় ঘনিয়ে আসছে, রিমিও রিমনের কাছে
অপারগতা প্রকাশ করলো।বাধ্য হয়ে রিমন একাই ভর্তিযুদ্ধের যাত্রী হল।
হঠাৎ ৩ দিন ধরে রিমির কোন খোঁজখবর নেয়।রিমির ফোন বন্ধ
ফেসবুকেও নেয়।রিমনের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে।রিমিকে
ছাড়া তার এক মুহূর্তও কাটেনি।রিমিকে ছাড়া সে বিকল্প কিছু ভাবতেও
পারে না, দম যেন বন্ধ হয়ে আসে। কখনো ১ দিনের বেশি যোগাযোগ
বন্ধ থাকে নি।
কয়েকদিন পর রিমির সাথে যোগাযোগ হল।প্রথমে সে বলতে চাইলো না,
পরে বাধ্য হয়ে বলল তার বিয়ে হয়ে গেছে।রিমনের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে
পড়ল।কোন ভাবেই যেন মাথা কাজ করছে না।পরদিন ফোন দিয়ে অঝোর কান্না।
রিমিকে জোর করে তার বাবা বিয়ে দিয়ে দিলো।রিমি রিমনকে ছাড়া অন্য কাউকে
মেনে নিতে পারছে না।কোনদিনও সে তার স্বামী মেনে নিতে পারবে না।
রিমির পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় পড়ার স্বপ্ন অংকুরে বিনাশ হয়ে গেল।রিমির স্বামী এবং
বাবা চায় না সে পাবলিকে পড়াশোনা করুক।সে এবার জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত বিভাগ
পেয়েছে।তাই তার বাবা সান্ত্বনা দিয়ে বলল,গণিত না পেলে না কি তাকে পাবলিকে পরীক্ষা
দেওয়ার সুযোগ দিতো।রিমন পাবলিকে ভর্তির পর হতেই চাইতেছে রিমি যেন নার্সিংয়ে
ভর্তি হয়।পাবলিকের সুযোগ হওয়ায় নার্সিংয়ের দিকে ঝুকতে হয়েছে।
নার্সিংয়ে পরীক্ষা দিলো পরিবারকে না জানিয়ে,এতে রিমন বেশ সাহায্য করেছিল।
বিধাতার অশেষ কৃপা ছিলো ফলশ্রুতিতে চান্স পেল।সে ভাবছে কিভাবে ভর্তির টাকা
ব্যবস্থা করবে।আর রিমন খবর নিল ভর্তি হতে কি কি কাগজপত্র লাগে।ভর্তির দিন
সব ঠিকঠাক কিন্তু তার পরিবার জেনে গেল লুকিয়ে পরীক্ষার কথা।
তারা তাকে ভর্তি হতে দিলো না।সফলতার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেও স্বপ্ন ছোঁয়ে দেখা হয় নি।
স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে গেল বাস্তবে রূপ নিলো না।জানা নেয় আবার কতো বার বুকে ক্ষত জমা রাখতে হবে
আবার কতোবার স্বপ্ন ভঙ্গ হবে।
লেখকঃ জুবায়েদ মোস্তফা
শিক্ষার্থী, লোকপ্রশাসন বিভাগ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।