দাদীমা আমার ক্ষুদ্র জীবনের খুবই প্রভাববিস্তারকারী একটি অধ্যায়। আমার শৈশব তার দ্বারা দারুণ প্রভাবিত হয়েছিল। এমনকি আমার সবসময়ই একটা চেষ্টা থাকত যেন আমাকে কিছুটা হলেও তার মতো দেখায়। এটা সম্ভব ছিলনা, কারণ তার মতো পিঠময় বিস্তৃত ঘন সাদা চুল আর কুঁচকানো ফর্সা-তামাটে চামড়া আমার ছিলনা। তার মতো হতে চাওয়ার বিষয়টা আমার মা-বাবার বেশ দুশ্চিন্তার কারণ ছিল। আমি ঐ ছোট্ট বয়সেই জানতাম, তারা দাদীমাকে ঠিক পছন্দ করতেন না। তবুও কেন তারা দাদীমার মৃত্যু অবধি তাকে নিজেদের সাথে রেখেছিলেন তার রহস্য আমার সামনে অনেক পরে অনাবৃত হয়েছে। আমি আগে জানতাম না যে দাদামশায়ের অর্থ-বিত্ত যা ছিল সবই দাদীমার নামে। অবশ্য জানার প্রয়োজনও কখনো পড়েনি। হঠাৎ জেনে ফেলেছি।
আমার দাদীমা কিন্তু খুবই ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মহিলা ছিলেন। শেষ দিন পর্যন্তও ব্যক্তিগত কোনো কাজে অন্য কাউকে হাত দিতে দেননি। যদিও তার খুব বয়স হয়ে গেছিল এবং দুর্বলতার দরুন একজন সাহায্যকারীরও তার দরকার ছিল, তবুও তিনি নিজের কাজগুলো নিজেই করতেন। বাড়ির গাছগুলোরও দেখাশোনা করতেন। শেষ দিকে তার নিশ্চয়ই খুব নিঃসঙ্গ বোধ হত। আমি তাকে সেই সময়ে গাছপালা এমনকি তার ঘরের চেয়ার-টেবিলগুলোর সাথেও কথা বলতে দেখেছি।
তিনি প্রচুর বই পড়তেন। আমাকেও গল্প পড়ে শোনাতেন। আমাকে তিনি যে খুব আদর-আহ্লাদ করতেন তা নয়, কিন্তু সম্পর্কটা বেশ সহজ-শান্ত ছিল।
দাদীমার মৃত্যু হয়েছিল খুব স্বাভাবিকভাবে। শুধু আগেরদিন রাত থেকে কোনো কিছু খেতে পারছিলেন না- এটুকু মনে আছে আমার। পরদিন সকালে আর ঘুম ভেঙে জেগে ওঠেননি। ব্যাস, এই তার মৃত্যু।
দাদীমার মৃত্যুর পর তার শূণ্য ঘরে গিয়ে আমি মাঝেমধ্যে বসে থাকতাম। বিকেলবেলা বড় জানালা গলে মিষ্টি রোদ্দুর দাদীমার বিছানায় এসে পড়ত, ঠিক তার মাথা রাখার জায়গাটাতে। বালিশদুটো সরিয়ে ফেলা হয়েছিল। আমি খালি বিছানায় ওই জায়গাটাতে মাথা রেখে শুয়ে পড়তাম। দাদীমার ঘর থেকে বাগানের একটা অংশ দেখা যেত। গাছপালাগুলোর যত্ন করত নতুন মালী। আমি গাছগুলোর দিকে চেয়ে প্রায় বিকেলেই ঘুমিয়ে পড়তাম। ঠিক যেভাবে পাশ ফিরে একহাতে মাথা রেখে দাদীমা ঘুমোতেন, সেভাবে। ব্যাপারটা কোন দিক থেকে মায়ের খুব অশুভ মনে হল বলতে পারবনা, কিন্তু কিছুদিনের মাঝেই দাদীমার ঘর তালাবন্ধ করে দেয়া হল। আমার শৈশবের অত গুরুত্বপূর্ণ একটা অধ্যায়ের ভীষণ যত্নসহকারে ইতি টানা হল। আমি শুধু বোবার মতো দেখলাম।
দাদীমার মৃত্যুর মাস তিনেক পর আমরা দাদামশায়ের ভিটা ছেড়ে শহরে চলে এলাম। মা কোনোমতেই চাননি আমি ওখানে বড় হই। জায়গাটা নাকি নোংরা আর অশুভ অস্তিত্বে ভর্তি। যদিও এর কোনোটাই কখনো আমার দুই চোখে ধরা দেয়নি, কোনোদিন জানতেও পারিনি আমার মায়ের চোখে কোনটা নোংরা, কোনটা অশুভ।
শৈশবের দীর্ঘ সময় ব্যয়িত জায়গাটা ছেড়ে আসতে আমার ভেতরে তোলপাড় হয়ে গেল। এমনিতেই আমি শান্ত প্রকৃতির ছিলাম, নতুন শহর আমাকে প্রায় পুরোপুরি নীরব করে দিল। আমার এই পরিবর্তনটা মা-বাবা খেয়াল করতে পেরেছিলেন এবং ধরেই নিয়েছিলেন কিছুদিনের মধ্যেই চঞ্চল শিশুচিত্ত শোক কাটিয়ে প্রাণোচ্ছল হয়ে উঠবে। নিঃসন্দেহে এটা তাদের ভুল ধারণা ছিল। নতুন শহরে আমি বেড়ে উঠছিলাম নির্লিপ্ততার সাথে। অশুভ অস্তিত্ব যে আসলে মানুষের মানসিকতার মাঝেই বাস করে, তা আমি ওটুকু থাকতেই বুঝে গেছিলাম। আর এও বুঝে ফেলেছিলাম যে এ নিয়ে বাকবিতণ্ডা করে কোনো লাভ নেই। তাই সব বিষয়ে চুপ থাকাই আমার কাছে শ্রেয় মনে হয়েছিল। আমি হয়তো আমার অনুভূতির প্রকাশ তখন দেখাতে পারিনি, কিন্তু আমার ভেতরের সত্ত্বায় তখন কী প্রচণ্ড উথালপাতাল ঝড় বয়ে গেছে, তা বাক্যে ব্যক্ত করার ক্ষমতা আমার আজও নেই। শিশুর কালো চোখের নীরব বিষাদ কেউ বুঝতে পারেনি, এলোমেলো রুক্ষ চুলে কত যে কথা জমা হয়ে থাকে তা কেউ জানবেও না। ভাষাহীনতার অতলস্পর্শী বেদনাও কেউ ছুঁতে পারবেনা নির্বাক শিশুর মতো।
সময়ের সাথে অনুভূতি হালকা হয়ে যায়, এটা চিরসত্য। কিন্তু সেই অনুভূতির তীব্রতা কত ছিল, যে অনুভব করেছে, তার মস্তিষ্কের স্মৃতিকুঠুরিতে তা যত্নে তোলা থাকে। তাই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কথা, প্রতিটা মানসিক আঘাতের কথা আমার মনে না থাকলেও, সেই তীব্র অনুভূতির স্মৃতি আমার মনে গেঁথে গেছে। আজ হয়তো যুক্তিতর্ক, বিবেক-বুদ্ধি আমাকে ঘটনার যৌক্তিকতা যাচাই করতে শেখাবে, ওগুলো যে নিতান্তই সাধারণ আটপৌরে ঘটনা তাই বোঝাবে, কিন্তু সেই অভেদ্য অভিমানকে ভাঙতে পারবেনা। শিশুর চাপা অভিমান খুব ঠুনকো বস্তু নয়।
তবে তখন যা ঘটেছিল তার সবটাই যে খারাপ ছিল তা নয়। তখন ঘটনাগুলো এভাবে ঘটেছিল বলেই হয়তো আমি একা একা শক্তভাবে বাঁচতে শিখেছি। আমার জীবনটা খানিকটা আমার ইচ্ছামতোই গুছিয়ে নিতে পেরেছি। তখন একা নিজের অন্ধকার ঘরে বসে বসে সময় কেটে যেত বলেই হয়তো অন্ধকার একদম ভয় পাইনা আমি। আমি ভীতু আর আহ্লাদি হয়ে বেড়ে উঠিনি। শুধু একটু পারিবারিক ব্যাপারগুলো থেকে দূরে সরে গেছি। সবচেয়ে বড় ক্ষতিটা এখানেই হয়েছে। পরিবারের প্রতি স্বাভাবিক টান আমি হারিয়ে ফেলেছি।
এই যেমন আমার বোন- তার সাথে আমার বলতে গেলে দূরদূরান্তের আত্মীয়ের মতো সম্পর্ক। দুটি বোনের সম্পর্ক যত সহজ হবার কথা তার কিছুই আমাদের মধ্যে নেই। তার জন্মই হয়েছে আমরা নতুন বাড়িতে আসার দুই বছর পর। তখন আমার বয়স দশ। একটা নতুন শিশুর আগমন একটা পরিবারে দারুণ উত্তেজনার ব্যাপার। সেই উত্তেজনায় মা-বাবার আমাকে ঠিক করার চেষ্টায় কিছুটা ভাটা পড়েছিল। যদিও আমাকে আর দশটা বাচ্চার মতো হাসিখুশি – স্বাভাবিক করার সব পূর্বপ্রয়াসই তাদের ব্যর্থ হয়েছিল। আমি তখন হাফ ছেড়েছিলাম, আর নিজেকে আরো একটু গুটিয়ে নিয়েছিলাম।
আমি খুব ভালোভাবে জানতাম যে, আমার মা-বাবা তাদের মা-বাবাদের খুব একটা পছন্দ করতেন না। তারা খুব উন্নত জীবন যাপন করতে চেয়েছিলেন এবং বেশিরভাগ আত্মীয়স্বজনের সাথেই যোগাযোগ ছিন্ন করেছিলেন। খুব অল্প কিছু আত্মীয় আমাদের বাড়িতে যাওয়া-আসা করতেন।
মা-বাবার সাথে এই বিষয়টায় আমার বেশ মিল রয়েছে। সত্যি বলতে, আমিও তো আমার মা-বাবাকে কখনো ঠিক পছন্দ করিনি। করার মতো কোনো কারণ বা পরিস্থিতি তারা তৈরিই করতে পারেননি।
* * *
পড়াশোনার কারণে খুব অল্প বয়সেই আমি পরিবারের থেকে দূরে থাকতে শুরু করেছিলাম। বাড়িতে যেতে ভালোলাগত না। ছুটিতে বেশিরভাগ সময়ই বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াতাম। একা একা একটা ছোট্ট বাসায় থাকতাম আমি। বাড়ির সাথে খুব বেশি যোগাযোগ ছিলনা।
এক বর্ষার দিনে হঠাৎ খবর পেলাম – সড়ক দূর্ঘটনায় আমার মা-বাবা মারা গেছেন। দূর্ঘটনায় আহত চারজন, নিহত তারা দুজন। আমি যদিও ধরে নিয়েছিলাম তাদের প্রতি আমার কোনো টান নেই, সেদিন বিস্ময়ের সাথে লক্ষ করলাম চোখের পাতা ভিজে আসছে।
এই ঘটনার পর আমার গতানুগতিক দিনাতিপাতে একটা বড় ধরণের পরিবর্তন আমাকে না চাইতেও আনতে হল। আমার মা-বাবা খুব স্বার্থপর মানুষ ছিলেন। তাদের প্রিয় আত্মীয়স্বজনরাও তাই। প্রয়োজনে তাদের কাউকেই আমি পাশে পেলাম না। তবে আমার পক্ষে পরিবারের দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব ছিলনা।
মা-বাবার মৃত্যুর পর পুলিশি ঝামেলার নিষ্পত্তি করা, কবর দেয়ার ব্যবস্থা – সবই আমাকে একা করতে হল। সমস্ত কিছু মিটে যাবার পর একটি নিঃশ্বাস ফেলব- ঠিক তখন মনে হল দুটি অসহায় কালো চোখ অনেক শঙ্কা আর অনিশ্চয়তা নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
আমি নিজের কাছে খুব সংকুচিত হয়ে গেলাম। আমি স্বাভাবিকভাবেই ভেবেছি সবকিছু মিটিয়ে নিজের নির্দিষ্ট ঠিকানায় চলে যাব। কিন্তু আমার বিচ্ছিন্ন পরিবারের একটিমাত্র অবশিষ্ট সূত্র, অনাথা কিশোরী মেয়েটার কী হবে সে ব্যাপারে ভাবতেই ভুলে গেছি। আমাদের মা-বাবা আমাদের দুটি বোনের জন্য কোনো আশ্বাসের স্থল যে রেখে যাননি সে কথা আমার চেয়ে ভালো আর কে জানত!
মা-বাবার মতো জুনির সাথেও আমার তেমন যোগাযোগ ছিলনা। আমি যখন থেকে আলাদা থাকতে শুরু করেছিলাম তখন সে নিতান্তই শিশু। আমাদের অনেকবার দেখা হয়েছে। কিন্তু তাতে অল্প কিছু কথা ছাড়া, কোনো আবেগের আদানপ্রদান ছিলনা। অথচ ঐ মুহূর্তে আমি ছাড়া মেয়েটার আর কেউ ছিলনা।
আমাকে অনেক কিছু ভাবতে হল। আমি তাকে একা এই বাড়িতে ফেলে যেতে পারিনা- না না না। আমিও স্বার্থপর অবশ্যই ছিলাম, কিন্তু তাকে ফেলে চলে যাবার মতো নয়। সুতরাং সব ঝামেলা মিটে যাবার পর বর্ষারই এক সন্ধ্যায় আমি তার ঘরে উপস্থিত হলাম। সে চুপচাপ বসে ছিল। আমি দরজায় শব্দ করতেই নড়েচড়ে বসল। আমার দিকে তার তাকানোর মধ্যে একটা ভীত ভাব সবসময় থাকত। আমি সেটাকে কখনো পাত্তা দেইনি, কিন্তু সেদিন তার ভীতভাব দেখে আমার খুব খারাপ লেগেছিল। বিরাট পৃথিবীতে আমি তার একমাত্র আপনজন, আর সেই আমাকেই কিনা মেয়েটা ভয় পাচ্ছে! অবশ্য আমি কখনো তার আপনজন হওয়ার চেষ্টা করিনি।
আমার একটু বিব্রত লাগছিল কারণ গত কয়েকদিনে তার সাথে আমার তেমন কথাবার্তা হয়নি। সে ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া করেছে কিনা তাও জানিনা। বিব্রত স্বরেই তার নাম ধরে ডাকলাম, “জুনি।”
তাকে আলাদা করে ডাকার প্রয়োজন ছিলনা, সে আমার সামনেই বসা। আমার ডাকার ফলে তার চেহারায় তেমন ভাবান্তর হল না।
“আমি ফিরে যেতে চাই জুনি। এখানে বেশিদিন থাকা আমার পক্ষে সম্ভব না।”
সে একবার ঢোক গিলল। সে নিশ্চয়ই ধরেই নিয়েছিল তাকে আমি ফেলে চলে যেতে চাইছি। অথচ একবারও বলতে পারছিল না – “আমাকেও নিয়ে চলো।”
আমি জুনির সামনে চেয়ার টেনে বসলাম।
“দেখো, আমি বলছিলাম যে, এই শহরে তোমার তো একা থাকা সম্ভব না। তুমি কী করতে চাও?”
সে কিছু বলতে পারলনা।
আমিই আবার কথা বললাম, “তুমি কী করবে সে ব্যাপারে কিছু ভেবেছ?”
সে একটু অবাক স্বরেই বলল, “না-তো!”
তার এই দুটো শব্দই আমার বোঝার জন্য যথেষ্ট ছিল যে, ওরকম ভাবনা ভাবার বয়স বা মানসিক ক্ষমতা তার এখনো হয়নি। ওরকম কঠিন কোনো পরিস্থিতিতে সে আগে কখনো পড়েনি। এত বড় ধাক্কার সম্মুখীন যে সে হতে পারে কখনো, এ ধারণাও তার ছিলনা। তার চোখেমুখে শোকের চেয়ে বেশি ছিল বিস্ময়, ছিল হতবিহ্বলতা। নিজের সম্পর্কে সে অসহায় বোধ করছিল। কিন্তু একথা বলার জন্য কাউকে কাছে পাচ্ছিল না। তাই তার শোকটুকু তখনো ফুঁসে ওঠেনি। হয়তো শুধু বিশ্বাস-অবিশ্বাসের টানাপোড়েনেই সে দগ্ধ হচ্ছিল তখন। আমার ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। দাদীমার মৃত্যুটা আমাকে খুব একা করে দিয়েছিল। আমাকে বদলেও দিয়েছিল। আমি হয়তো একা বেঁচে থাকতে শিখেছি, প্রতিকূলতায় কঠিন থাকতে শিখেছি, কিন্তু আমার ভেতরে অনেক কিছু খালি হয়ে গেছিল। আমার ভেতরের সেই খালি জায়গা থেকেই একটা আওয়াজ উঠে এলো – এই মেয়েটাকে আমি কিছুতেই আমার মতো একা-একা খালি-খালি ভাবে বেড়ে উঠতে দেবনা।
আমার ইচ্ছে করছিল তাকে খুব আদর করে সান্ত্বনার কিছু কথা বলি। তাকে বলি যে সে এই পৃথিবীতে একা না। আমি আছি তার সাথে। কিন্তু সেটা কিভাবে বলতে হয় আমার জানা ছিল না। আমি শুধু একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বলেছিলাম, “তুমি আমার সাথে চলো বরং। আমরা একসাথে থাকব। তোমার কোনো সমস্যা আছে?”
“না,” সে মাথা দোলালো, “তোমাকে থ্যাংকস।”
তার কথা স্পষ্ট হলেও কণ্ঠে একটা জড়ানো ভাব। দৃষ্টি অবনত। আমার কষ্ট হলো। সে আমাকে ভদ্রতার স্বরে থ্যাংকস জানাচ্ছে। সে যে আমার সাথে সহজ হতে পারছেনা, এটা তার চেহারায় পরিষ্কারভাবে ফুটে ছিল।
আর এতদিন পর আমার মনে হল, একটা সহজ পারিবারিক সম্পর্ক আমার খুব দরকার।
* * *
সবকিছু গোছগাছ করে, জুনির স্কুল থেকে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র তুলে, স্থায়ীভাবে তাকে নিয়ে আমার শহরে ফেরার ব্যবস্থা করতে আমার আরো কিছুদিন সময় লাগল। এই কদিনে আমি জুনির সাথে টুকটাক কথা বলেছি। সে খেয়েছে কিনা জিজ্ঞাসা করেছি, তার কী কী লাগবে জানতে চেয়েছি। জুনিও আগের তুলনায় সহজ হয়েছে, আমার দিকে ভয়-ভয় চোখে তাকায় না। সে খুবই গোছানো স্বভাবের। বেশ গুছিয়েই সে আমার সাথে চলে আসার প্রস্তুতি নিল। তার মধ্যে শোকের ছায়া প্রবলভাবে থাকলেও সে আমার সামনে কান্নাকাটি করেনি। করলে আমি খুব বিপদে পড়ে যেতাম। আমি সান্ত্বনা দিতে পারিনা।
আমাদের ট্রেন ছিল বিকেলে। সকালবেলা জুনি কাচুমাচু হয়ে এসে আমাকে বলল যে সে তার বন্ধুদের সাথে একবার দেখা করে আসতে চায়। আমি তাকে স্কুলে যেতে বললাম। ঘণ্টাদুয়েক পর যখন সে লাল চোখ আর কান্নার দাগ বসা গাল নিয়ে ফিরল তখন আমার খুব কষ্ট হল। আহারে বেচারি! এত শোকের মধ্যেও তাকে ব্যক্তিগত পর্যায়ে না জানি কত ঝামেলা সামলাতে হচ্ছে!
আমি তাকে যথাসম্ভব নরম গলায় বললাম, ” জুনি, তুমি এখান থেকে চলে যাচ্ছ মানে কিন্তু এই না যে আর কখনো এখানে আসবেনা। তোমার যখন ইচ্ছে হবে এখানে এসে থাকবে। বন্ধুদের সাথে ঘুরবে। নতুন শহরে গিয়ে তোমাকে নতুন মানুষ হতে হবেনা। তাছাড়া খুব দূর তো না। যখনই মন খারাপ হবে চলে আসবে। তুমি কষ্ট পাচ্ছ বুঝতে পারছি , কিন্তু হতাশ হোয়োনা।”
আমার কথা শেষ হলে জুনি কৃতজ্ঞ চোখে আমার দিকে তাকাল। মনে হল এই প্রথম সে আমাকে গ্রহণ করল। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম তার গোছগাছ শেষ কিনা। সে হ্যাঁ-সূচক মাথা নেড়ে তার ঘরে চলে গেল। সে নিশ্চয়ই এখন আরো কিছুক্ষণ কাঁদবে। আমি মায়ের আরামকেদারায় গা এলিয়ে দিলাম। আমার অধিকারে কান্না ছিলনা, তাই চোখ বন্ধ করলাম।
একটা গুণগুণ আওয়াজ পাচ্ছি। জুনি বোধহয় সত্যিই কাঁদছে।
* * *
আমার বাসায় ঢুকে জুনি কিছুক্ষণ থমকে দাঁড়িয়ে থাকল। সম্ভবত জায়গা পছন্দ হয়নি। এতদিনকার আবাসের সাথে এটাকে মিলিয়ে দেখলে তার হতাশ হবারই কথা। আমি বাসাটাকে খুব সাজিয়ে গুছিয়ে রাখিনা। যেভাবে রাখলে একজন মানুষের থাকতে কোনো অসুবিধা হয়না সেভাবে রাখি।
“জুনি।” আমার ডাকে সম্বিৎ ফিরে পেল সে।
“আমি কোথায় থাকব?” প্রায় আসবাবহীন বসার ঘরে নিজের ব্যাগটা রেখে বলল জুনি। রোগা-পাতলা শরীরে মেয়েটা এত ভারী ব্যাগ কিভাবে বয়ে নেয় কে জানে।
“এখানে দুটো ঘর। একটা তো খালিই। তুমি ওখানে থাকবে। “
ঘরে ঢুকে বেচারি আরেকবার ধাক্কা খেল। কারণ খালি ঘর পুরোপুরি খালি। একটা ছোট বইয়ের তাক আগে ছিল। সেটাও আমি আমার ঘরে সরিয়ে ফেলেছি।
“এখানে কিভাবে থাকব?” প্রশ্নটা করে একটু লজ্জা পেয়ে গেল সে।
আমি তাকে বিছানা-বালিশ এনে দিলাম। আশ্বাস দিলাম যে তার খাট আর টেবিলের ব্যবস্থা দ্রুত হয়ে যাবে। জুনি বিস্মিত চোখে বাসা ঘুরে দেখতে লাগল। এই বাসায় জিনিসপত্র এত কম যে বাহুল্য জিনিসে ভরা বাড়িতে বেড়ে ওঠা জুনির কাছে সেটা অত্যন্ত আশ্চর্যের ব্যাপার।
রাত বেশি হয়নি। আমরা বাইরে খেতে গেলাম। দেখলাম সে রেস্টুরেন্টে খাবারের অর্ডার করতে পারেনা। অত্যন্ত আদর-আহ্লাদে মানুষ হয়েছে সে, তার দোষ নেই।
রাস্তায় বের হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম আইসক্রিম খাবে কিনা। জানতে পারলাম সে আইসক্রিম খায়না। ঠাণ্ডা কিছু খেলেই তার গলা বসে যায়। এদিকে আমি প্রায় প্রতিদিনই আইসক্রিম খাই। তার জন্যে চকলেট কিনলাম।
খেয়াল করলাম জুনি আমার সাথে অনেকটা সহজ হয়ে এসেছে। যদিও এটা আরো অনেক আগেই হবার কথা ছিল, সহজাতভাবে।
* * *
রাত জাগার কু-অভ্যাস আমার আছে। অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থাকার পর যখন চোখ জ্বালা করতে শুরু করল তখন চোখেমুখে পানি দিয়ে আলসেভাবে জুনির ঘরের সামনে গেলাম আমি। নতুন স্কুলে সে ভালোই মানিয়ে নিচ্ছে। সমস্যা হচ্ছে আগে তার স্কুল ছিল দুপুরে। এখন সকালে। মাঝেমধ্যে বেশ দেরি করে ফেলে। তার ঘরে তার পছন্দমতো হালকা নীল ফিকে-বাতি লাগিয়ে দিয়েছি। জুনি ঘুমোচ্ছে খুবই শিশুসুলভ ভঙ্গিতে। তার মাথার কাছে একটা ফটোফ্রেম। এতখানি দূর থেকেও ফ্রেমটা চিনতে পারলাম আমি। ছবিটা তোলা হয়েছিল জুনির জন্মের মাস কয়েক পর। মা-বাবার মাঝে আমি আর মায়ের কোলে ছোট্ট জুনি। আমার হাতে জড়িয়ে রাখা পুরনো কিন্তু স্পষ্ট আরেকটা ফটোগ্রাফ, দাদামশাই আর দাদীমার। এই ছবিটা নিয়ে ছবি তুলতে এসেছিলাম বলে মা-বাবা একটু বিরক্ত হয়েছিলেন, কিন্তু নিষেধ করেননি। আমাকে প্রায় কোনোকিছুতেই তারা নিষেধ করতেন না।
একটা পুরনো ছবি দেখে স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ার কোনো মানে হয়না। তবুও ছবিটা দেখার জন্য আমি জুনির ঘরের তীব্র বাতিটা জ্বেলে দিলাম। ঘুমন্ত জুনির পাশে বসে ছবিটা দেখতে লাগলাম আমি- ছবির মানুষগুলোকে আঙুল দিয়ে ছুঁয়ে দেখতে লাগলাম।
বাবার হাসিটা গর্বিত হাসি, সুখী মানুষের হাসি। মা ছোট্ট জুনির মুখটা নিজের গালের সাথে ছুঁইয়ে রেখেছেন। জুনি ঘুমোচ্ছে। নিরানন্দ নিরুৎসাহী চোখে আমি ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে। অথচ আমার হাতে ধরা ছবির দুই বৃদ্ধ-বৃদ্ধা কী সুন্দর করে হাসছেন! বাবার একটা হাত রাখা আমার কাঁধে।
আমার ঠোঁটে যে একটা হাসি ফুটে উঠেছিল তা আমি বুঝতে পারলাম হাসিটা হঠাৎ মিলিয়ে যাবার পর। কিছু একটা হল আমার মধ্যে, একটা উপলব্ধি , প্রকাশের অসাধ্য, দুর্বোধ্য। এই ভাবনাটা আমার মধ্যে হঠাৎ এবং তীব্রভাবে উদিত হল যে এখন আর আমার কাঁধে হাত রাখার কেউ নেই। আমাকে দুপাশ থেকে ঘিরে রাখার কোনো মানুষ আর নেই।
এবং আমার নির্লিপ্ততা তছনছ হয়ে গেল কিছু নিরীহ প্রশ্নের আঘাতে। তারা কি আমাকে ভালোবাসতেন? তারা ভালো মানুষ ছিলেন না, কিন্তু সেটা বিচার করার মতো ভালো মানুষ কি আমি নিজে হতে পেরেছি? যে দুজন মানুষ কিছুদিন আগে মারা গেলেন, তারা আমার মা-বাবা! স্বার্থপর এবং লোভী মানুষ, অকৃতজ্ঞ সন্তান, কিন্তু মা-বাবা হিসেবে তারা কেমন ছিলেন? আমিতো এগুলো আর কখনোই জানার সুযোগ পাব না!
আমার নিঃশ্বাস গাঢ় হয়ে উঠছিল, টের পাচ্ছিলাম। অবন্যস্ত চুলে ঘুমিয়ে থাকা জুনিকে দেখে আমার খুব মায়া করছিল। আমি ওর মাথায় হাত রাখলাম, চুলে হাত বুলিয়ে দিতে থাকলাম। আমার একটুও মনে হল না আমি অনধিকারচর্চা করছি।
জুনির নিশ্চয়ই ঘুম গাঢ় ছিলনা। আমি তার চুলে হাত বুলাতে বুলাতেই সে জেগে উঠল এবং উঠে বসল। আমি তার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে ছিলাম। আমি জানি, যেই নিরাপত্তা আর ভালোবাসা তাকে আমি দেব বলে নিজের কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম তা আমার চোখে সে দেখতে পেয়েছিল। কিছুক্ষণ ওভাবে বসে থেকে জুনি আমার কোলে মাথা রেখে আমাকে আঁকড়ে ধরল। আস্তে আস্তে তার শরীরটা কাঁপতে শুরু করল। তারপর সে শব্দ করেই কেঁদে ফেলল। যে শোক একজন আপনজনের অভাবে সে চেপে রেখে দিয়েছিল তা হঠাৎ আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের মতো বেরিয়ে এলো। আমিও পৃথিবীতে আমার নিজের বলে অনুভব করার জন্যে একজনকে পেলাম। তাকে আঁকড়ে ধরে নিজেকে একটা উত্তর আমি খুঁজে দিলাম। আমার একটা পরিবার আছে, আর সেই পরিবারে ভালোবাসাও আছে। জুনি আমার বোন- আমার একদম নিজের। যেরকম করে আমি এতদিন বেঁচে ছিলাম সেভাবে আমি তাকে বাঁচতে দেব না। আমি ওর আশ্বাসের স্থল হব, যা আমার কাছে থেকেও ছিলনা। ফ্যামিলি ফটোগ্রাফের মধ্যে মা-বাবার হাসিমুখ দেখা যাচ্ছে। দাদামশাই আর দাদীমার হাসিমুখ দেখা যাচ্ছে। এদিকে আমরা দু’বোন কেঁদে যাচ্ছি।
আমরা পুরো পরিবার একসাথে হাসি-কান্নায় মাখামাখি হয়ে যাচ্ছি। এই পরিবারে মা-বাবা, দাদামশাই-দাদীমা যেমন আছেন, আমি আর জুনিও আছি। সবাই আছি এই ছোট্ট শব্দটার মধ্যে।