ভালোবাসা ও ক্যারিয়ার দুটো এক জিনিস নয়।
লেখা – সৌরভ শেখ
তখন ২০১২ সাল।
সিয়াম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়।প্রথমদিন ক্লাশ করতে গিয়ে মিলির সাথে পরিচয় হয় সিয়ামের।মিলির কাজল কালো চোঁখ আর মিষ্টি কন্ঠ সিয়ামকে অদ্ভুত এক মায়ার জালে আটকে ফেলে।আস্তে আস্তে বন্ধুত্ব তারপর ভালোলাগা অবশেষে ভালোবাসায় পরিণত হয়।ছোট ছোট বিষয় নিয়েও খুনসুটিতে কাটতে থাকে দু’জনের সময়।
ক্যাম্পাসের সেরা জুটি বললে সবাই একনামে চিনে ফেলে সিয়াম আর মিলিকে।চেনারই কথা কারণ মিলি আর সিয়াম সকাল নাই দুপুর নাই ভার্সিটির পুকুরপাড়ে বসে গল্প করে।এমনকি মাঝে মাঝে ক্লাস ফাঁকি দিয়েও ওরা ঘুরে বেড়ায় ক্যাম্পাস দিয়ে।ঝাল চত্বরে মিলিকে নিয়ে ঝালমুড়ি খাওয়া আর ডায়না চত্বরে বাদাম চিবানো যেনো দুজনের প্রতিদিনের নিয়ম হয়ে দাড়ায়।আনন্দ ভরা জীবন উপভোগ করতে থাকে দুজন।
সিয়ামকে ওর ডিপার্টমেন্টের বড় ভাইয়েরা আমতলা ডেকে অনেক বুঝিয়েছে, অনেক কথা বলেছে।ভাইয়েরা সিয়ামকে এমনও বলেছে, ‘জীবনে প্রতিষ্ঠিত হলে অনেক ভালো মেয়ে পাবি কিন্তু প্রতিষ্ঠিত না হতে পারলে মিলিকেও পাবিনা।’
সিয়াম ভাইদের কোনো কথা আমলে নেয়নি বরং ক্লাস বাদ দিয়ে সকাল নাই দুপুর নাই মিলির সাথে আড্ডা দিয়েছে
আরো পড়ুন – তামিল নাইকা মনিকার ইসলাম গ্রহন
আজ সিয়াম আর মিলির ভালোবাসার চতুর্থ বছর পূর্ণ হয়েছে।মিলি আর সিয়ামও এবার চতুর্থ বর্ষে পড়ে।দুজনই দুজনের ভালোবাসার কথা তাদের বাড়িতে বলে দিয়েছে।সিয়ামের পরিবার যদিও মেনে নিয়েছে তবে মিলির বাবা মেনে নেননি।মিলির বাবার ইচ্ছা একজন প্রতিষ্ঠিত ছেলের হাতেই মিলিকে তুলে দিবে।মিলি সিয়ামের কাছে কথাটি গোপন করেছিল যে ওর বাবা এ সম্পর্কে রাজি না।
এদিকে সময় থেমে থাকে না।দেখতে দেখতে চতুর্থ বর্ষের পরীক্ষা চলে আসে।পরীক্ষা শেষ করে সব শিক্ষার্থীদের মতো মিলি আর সিয়ামকেও যার যার বাড়ি ফিরতে হয়।বাড়ি ফিরেও দুজনের ফোন আলাপের কোনো ঘাটতি থাকেনা।রাতকে দিন দুজনে ফোনে কথা বলতে থাকে।সবসময় মিলিই কল করতো সিয়ামকে।বাড়িতে দুজনের এমনই চলতে থাকে।
তার কয়েকমাস পর বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজাল্ট ঘোষণা হয়।সিয়াম সেকেন্ড ক্লাশে পাশ করে। মিলিও সেকেন্ড ক্লাশে পাশ করে।সেদিন সন্ধ্যায় মিলি সিয়ামকে ফোন করে একটু ভিন্ন ধরনের কথা বলে।সিয়ামকে চাকরি নেওয়ার কথা বলে।আরও বলে চাকরি পেলেই মিলি সিয়ামকে বিয়ে করবে নইলে করবেনা।মিলির কথা শুনে সিয়ামের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে।ভেঙ্গে পড়াটাই স্বাভাবিক কারন গত চার বছরে সিয়াম চাকরির জন্য কিছুই পড়েনি বরং মিলিকে পেছনে সময় পার করছে।
অন্যদিকে ফেসবুকে ঢুকলেই মিলি দেখতে পাচ্ছে ওদের একই ব্যাচের বন্ধুদের চাকরি পাওয়ার স্টাটাস।এসব দেখে মিলি সিয়ামকে আরও বেশি চাপ দিচ্ছে চাকরির জন্য।কিন্তু সিয়ামের কিছুই করার ছিলোনা।কারণ চাকরির প্রস্তুতি দু’এক মাসে নেওয়া সম্ভব নয়।
হটাৎ মিলির মামা মিলিদের বাড়িতে মিলির বিয়ের সম্বন্ধ নিয়ে আসে।ছেলে ইঞ্জিনিয়ার।ঢাকাতে বাড়ি, গাড়ি সবকিছু আছে।মিলির বাবা রাজি হয়ে যায় কিন্তু মিলি রাজি হয়না।মিলি মামাকে সিয়ামের কথা সব বলে।কিন্তু মামা মিলিকে অন্য বুঝ দেয়।মামা মিলিকে ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে বলে। আরও বলে সিয়াম চাকরি না পেলে কিভাবে চলবে মিলি,কিভাবে সংসারিক জীবনে ছেলে মেয়েদের বড় করবে।তখন মিলি বাস্তবতা অনুভব করতে থাকে।মিলি মামার কথাগুলো ভাবতে থাকে সত্যই মিলির যদি সিয়ামের সাথে বিয়ে হয় আর সিয়ামের চাকরি না হয় তাহলে সংসার জীবনে কিভাবে চলবে।আরও ভাবতে থাকে এই ইঞ্জিনিয়ার ছেলের সাথে ওর বিয়ে হলে গাড়িতে চড়বে,দশ তলা ফ্লাটে থাকবে।সংসার অনেক সুখের হবে।এসব ভেবে মিলি ইঞ্জিনিয়ার ছেলের সাথে বিয়েতে রাজি হয়ে যায়।মিলি একবারও সিয়ামকে বিয়ের খবর জানানোর প্রয়োজন অনুভব করেনা কারন মিলি জানে সিয়ামের যে রেজাল্ট তা দিয়ে সিয়াম কখনই ভালো চাকরি পাবে না।
এদিকে সিয়াম মিলির ফোন বন্ধ পেয়ে পাগলের মতো হয়ে যায়।যে মিলি ২ টা ব্যাটারি চার্জ করে রাখে সিয়ামের সাথে কথা বলার জন্য সেই মিলির ফোন ৫ ঘন্টা অফ।সিয়ামের আর বুজতে বাকি থাকেনা যে মিলির কিছু একটা হয়েছে।
এভাবে একটা রাত চিন্তা করতে করতে কেটে যায়।সকালে সিয়ামের বাসায় চিঠি নিয়ে আসে পোষ্টম্যান।সিয়ামের মা চিঠিটা নিয়ে সিয়ামকে দেয় আর পড়তে বলে।সিয়াম চিঠিটা বের করেই দেখতে পায় মিলি পাঠিয়েছে।এটা মিলির বিয়ের নিমন্ত্রণ পত্র।সিয়াম মায়ের সামনে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে রাখলেও ওর চোঁখ দিয়ে দু’ফোটা পানি পড়ে।মা সিয়ামের কাছে জানতে চায় চিঠিতে কি লেখা। সিয়াম মাকে ভিন্নকথা বলে দেয় যে এটা ওর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এসেছে।
তারপর সিয়াম ব্যাগ গুছিয়ে রওনা হয় মিলির বাসা কাঞ্চনপুরে।যেতেই একদিন লাগবে।মিলির বিয়েও আগামীকাল।তাই সিয়াম খুব চিন্তায় থাকে।
আরো পড়ুন – কিভাবে আল্লাহর ওলি হবেন
এদিকে ২৮ তারিখ শুক্রবারে মিলির বিয়ের বরযাত্রী এসে যায়।ধুমধাম আয়োজন করে মিলির বিয়ে হয়।মিলির স্বামী মিলিকে অনেক গহনা দিয়েছে।বিয়েতে নিজের প্রাইভেট গাড়ি নিয়ে এসেছে।ভুরি ভুরি গহনা, দামী গাড়ি আর বরের ক্যারিয়ার মিলিকে অনেক আনন্দ দেয়।স্বার্থপর মিলির মনে সিয়ামের কোনো অস্তিত্বই থাকে না।একপর্যায়ে বিকাল ৫ টা বাজে।মিলিকে নিয়ে চলে যাবার পালা।বাবা, মায়ের পায়ে সালাম করে গাড়িতে উঠবে মিলি এমন মুহূর্তে সিয়াম মিলিদের বাড়ির রাস্তায় পৌছে যায়।
মিলি সিয়ামকে দেখে না কিন্তু সিয়াম মিলিকে দেখে।পেছন থেকে মিলির দিকে তাকিয়ে থাকে একধ্যানে।মিলি তার বরের হাত ধরে গাড়িতে উঠছে।সিয়ামের চোঁখে এই দৃশ্য পৃথিবীর সবচাইতে নিষ্ঠুর দৃশ্যের একটি।বরের গাড়ি আস্তে আস্তে করে চলতে শুরু করছে।
সিয়ামের চোঁখ দিয়ে দু’এক ফোটা পানি গড়িয়ে পড়ছে।সিয়ামের সেই দিনটার কথা মনে পড়ে যাচ্ছে যেদিন আমতলা ডেকে বড় ভাইয়েরা সিয়ামকে বলেছিলো ‘জীবনে প্রতিষ্ঠিত হলে অনেক ভালো মেয়ে পাবি কিন্তু প্রতিষ্ঠিত না হতে পারলে মিলিকেও পাবিনা।’
#গল্প_থেকে_শিক্ষা
কাউকে ভালোবেসে নিজের ক্যারিয়ারকে নষ্ট করে দিলে একদিন সেই ক্যারিয়ার না থাকার কারনে ভালোবাসার মানুষটিকেই হারাতে হয়।
সৌরভ শেখ
বি.এ (সম্মান) ২য় বর্ষ
ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া