লিসার চিত্রকল্প

লিসার চিত্রকল্প

উমর ফারুক

 

 

— লিসা আজ তোমাকে  এমন একটি গল্প শোনাব যা আগে কখনো শোনোনি।

— “কি গল্প বড়মা?” লিসা  কৌতূহলে জিজ্ঞেস করল। বাচ্চাদের এই অভ্যাস এখনো যায়নি।যেমনি  শুনেছে গল্পের কথা অমনি তারা নড়ে বসলো । তোমরা অবাক হতেই পারে সাত সকালে গপ্প?এটা গল্পের তুলনায় অনেটাই মজার খোরাক জোগাবে। লিসা আর মিনা দুই বোন। বৃদ্ধার মুখে গল্প শুনেই মিনা চুপটি করে এসে বসল।  বৃদ্ধা একটি সুপ্ত পাতার মলাট যুক্ত বই বের করে বলতে শুরু করলো । প্রথমে যা শুরু হলো এতে অবাক করার মত । সেই বইয়ের এক গুরু চরিত্রের জব্বারের ভাইয়ের নাম খলিল । পেশায় উকিল । তাদের জমি অধিগ্রহণ করা নিয়ে পাড়ায় একটি ঝলেমা পেকেছে তার জন্য এতদিন ধরে তারা মামলায় ঝুলে রয়েছে। এই কাহিনীর যেন শেষ নেই !! সেই ধীমান তালুকদার মস্ত জমিদার। তার আড়াই বীঘে জমির আলের পাশেই ছিল মনসুরের জমি এক বিঘা। সেখানে কোন রকম ফসলাদি উৎপন্ন করে রুটিরুজির ব্যবস্থা করত।

 

সম্বল বলতে একটি আম্রকানন ও এক বিঘা জমি। এটিই ভাত ভিক্ষে। অনেক কষ্ঠে ছেলেকে লেখাপড়া শিখিয়ে ওকালতি পেশায় নিয়োজিত করেছে মুনসুর।  তবু্ও যেন সংসারে টানাপোড়েন।  বাবার অনেক ছিলো। পদ্মার ভাঙনে সব তলিয়ে এখন ভিটে মাটি হারিয়ে একটি নিম্ন ভূমিতে ঠাঁই পেতেছে।  খোদার কি লীলা খেলা মানুষের জুলুম নির্যাতন অশান্তি সব কিছু মিলেমিশে একাকার আর সেই অভাগা পিতার দুই সন্তান কে নিয়ে সংসারে হিমসিম ।  জব্বারের বাবা মনসুর আলী অতি সাধারণ একজন মানুষ। ছোট থেকেই পরিবেশের সাথে যুদ্ধ করেই তিনি এতদূরে ঠেকেছে। একশ এক বছরের বৃদ্ধা মা এখনও দিব্যি বেঁচে আছে এবং চলা ফেরা করে। বানিয়ে বলা গল্প তার এক অভ্যাস বলা যায়। যদিও এই কাহিনীর সম্পূর্ণ তার বাস্তব জীবন অবলম্বনে নির্মিত হয়েছে। জব্বরের একমাত্র মেয়ে  লিসা ,দারুন অনুসন্ধিৎসু ও ভাবুক প্রকৃতির। আর মিনি খলিলের মেযে । বৃদ্ধা দাদীর মুখে অনেক গল্প শুনেছে খলিল। অনেক শিক্ষা সংগ্রহ করেচে। ছোটবেলায় দুই নতি কে পাশে নিয়ে ঘুমাত গল্প শোনাতে খুব ভালো বাসত বৃদ্ধা।

আরো পড়ুন – সাইদীর মুক্তি

সেইদিন কিছুটা শোনার পর লিসার মনে নানা প্রশ্ন জাগতে শুরু করলো।  লিসা একটু বেশি কৌতূহলী তবে মিনা ওর থেকে অনেক কম । চট করে বলেই ফেলল ” জবরের গ্রামবাসীরা কি সবাই তলিয়ে গেছে! এত বিষ্ময়কর জিজ্ঞাসায় বৃদ্ধাকে হতাশ করেছিল। তলিয়ে যাওয়া গ্রামবাসীদের মুখে তাকিয়ে নিজেকে লজ্জিত ও নতি স্বীকার করে উত্তর দিল  “আস্ত একটা গ্রাম কে গ্রাস করেছিল পদ্মা।”

যে গল্পটি বলা হচ্ছে তা নিশ্চই বুঝতে পারছ।হ্যা  বৃদ্ধার অবর্ণনীয় কষ্ট গুলো কাউকে বলার অপেক্ষা রাখেনা। নিরব হাসি কান্না থামাতে যে পারেনি তাদের কাছে তার গোপ্পোগুলো মূল্যহীন। একাকীবোধ আর বিষন্ন মন নির্বিকার ভাবে তার হৃদয়ে আঘাত লাগতে লাগতে দেহের আজ ভাঙন ধরলো।

 

কেউ হাত বাড়ায়নি । সে ১৯৪৫  এর ভয় সব কিছু ওলট পালট করে দ্যেছে। ১৯৪১ এর যুদ্ধের দামামা আর ভারতের স্বাধীনতা দাবী যেমন ব্রিটিশ সরকার মেনে নিতে পারেনি তেমনি ততদিন পর্যন্ত ভারতে শান্তি বিরাজ করেনি।

কত বার তাকে ভিটে ছাড়া হতে হলো তার ঠিক নেই। এই মানুষটার জিবনে যে সাইক্লোন বয়ে গেছে তা ,যে ক্ষতি সাধিত হয়েছে তার শূন্যস্থান পাঁচ যুগেও বোধকরি পূরণ হবেনা। এজন্য কষ্ট গুলো চাপা দিয়ে এতদিন অর্ধ ভগ্ন স্বাস্থ্য নিয়ে বেঁচে আছে। একখানি মোটা গল্প গ্রন্থ শোনাতে খুব উৎসুক। গল্পের সূচনা নিজের জীবনে এক অংশ শেষ না হতেই  লিসা প্রতিটা পর্বে বিস্মিত হয়। ইতিহাসের সাথে অনেক কথা মিল করে গল্পের ও বাস্তবের সঙ্গে।

সেই বছরের পদ্মা  ভাঙনের বিবরণ শুনে  ব্রিটিশ সরকারের উদ্যোগের কথা জানায়? এটি কোন বয়সে এত কিছু ভেবে তো সত্যিই অবাক করার মত। তবুও বুড়ি ভীটি হারিয়ে এখনো নিঃস্ব তার তলিয়ে যাওয়া জমির কিছু অংশ উঠেছে কেউ না কেউ করে খাচ্ছ। এখনো আশাবাদী ।

 

এতে কোন দুঃখ নেই দুঃখ তখনই নিজের দুঃখ গুলো কারো সাথে ভাগ করার সৌভাগ্য হয়নি। যে জাতির মানুষ ছিলেন বৃদ্ধা সেই জাতি ছিল অসংখ্য লঘু ও বিক্ষিপ্ত। সেই গল্পের পথে হঠাৎ করে বুড়ি থামলো। বোঝা গেল বড়োই দুঃখ বোধ করছেন। চোখে একরাশ পানি ও ভালোবাসার বস্তু গুলো কুরবানী দেওয়ার কথা ভুলেন নি। কড়া মলাট আবৃত গল্পের বইয়ের কয়েক পৃষ্ঠা শেষ হলো। এরপরেই পৃস্ঠা থেকে নীল আকাশ নিয়ে নানান বৈচিত্রের বর্ণনা , সবুজ প্রকৃতি ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা সংক্রান্ত নানান ভঙ্গিতে গল্প লেখা রয়েছে। পূর্বের  তুলনায় এই পৃষ্ঠার প্রতি বেশী আগ্রহী লিসা আর মিনি। এতদূর শুনে থমকে দাঁড়ায়। বাড়ি থেকে আম্মুর ডাক শুনে জানালার বাঁ পাশে একটি দড়ির খাটিয়া থেকে দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস নিয়ে আকাশের দিকে তাকাতেই গল্পের মুখ খানা ভেসে উঠেছে  ।

 আরো পড়ুন – জান্নাতী দল কোনটি ?

এত কম বয়সি বাচ্চাদের মস্তিষ্কে এমন  কাল্পনিক  ইমেজ তৈরি হয়েচে যা একজন সাহিত্যিক করতে পারেন। সত্যই ভারী অবাক করা ঘটনা। লিসা এবার মিনি কে ডেকে দেখালেও মিনি সকল বিষয় টা বুজলনা। এইভাবে এক মনে আকাশের দিকে তাকায় ছবি আঁকে কাল্পনিক প্রেম বিরহ সবুজ প্রকৃতি ও পরিবেশের চিত্র ভাসিয়ে তোলে । দেখতে দেখতে এক বেলা কেটে গেল ।

 

দুপুর গড়িয়ে বিকেলের ছায়া নেমে আসলো । বারানদার বৈঠখানার চালার ওপর প্রপিতার লাঠি টা এখনো  তোলা আছে।  চশমার ফ্রেম এ যেন নানান স্মৃতি কথা মনে পড়ছে। লিসা নড়াচরা করতে লাগলো ও তার কল্পনার জগতে প্রোপিতামহের জীবন প্রণালী বড়োমা কে শুনালো।

 

বড়মা চমকে উঠলো! আরে লিসা ” এটা  কি করে বলতে পারলি” আমি কল্প চিত্রের দ্বারা।

— কেমন কল্প চিত্র ?

—এটা তোমার গল্প শুনেই এমন একটি চিত্র এঁকেছি।

তবুও যেন সোনালী রঙের ঊষা সন্ধ্যের ঝুলন্ত আকাশে ঢলে পড়ল। এই ঊষা কে কেন্দ্র করে লিসার আরেকটি নতুন কল্পচিত্রের আবিষ্কার করার ইচ্ছা জন্মালো এবং ঠিক পরের দিন সকালে বাড়ির সামনে এসে দাড়ালো। বৃদ্ধা বড়মার হাতে একটি আর্ট পেপার দিয়ে বলল এই নাও আমার আরেকটি কল্প চিত্র। বৃদ্ধা আবার একবার লিসাকে বাহবা দিয়ে বললো

—”অপূর্ব সুন্দর!”!!!

 

Leave a Comment