আফসোস
ফজলে রাব্বী দ্বীন
রাত তিনটা। ঘুম থেকে চমকে উঠলো মিথিয়া। বারান্দা থেকে কাঁচ ভাঙার শব্দ আসছে। একদিকে অসহ্য গরম অন্যদিকে এমন বিরক্তিকর শব্দ! মেজাজটা খিটখিটে হয়ে গেলো। দরজা খুলে বাইরে বের হতেই চলে গেলো ইলেক্ট্রিসিটি। টর্চ লাইট টা হাতে নিয়ে বারান্দায় উঁকি দিয়ে দেখলো কেউ নেই। বাইরে ঠান্ডা বাতাস বইছে। বাতাসের জোর এত বেশি নয় যে কোন কিছু ভেঙে ফেলতে পারে। তাহলে এতক্ষণ কিসের শব্দ হল? মনের ভুল ভেবে মিথিয়া ঘরের ভেতরে প্রবেশ করতে যাবে এমন সময় সিঁড়ি থেকে টুংটাং পায়ের আওয়াজ ভেসে এলো। বাড়ির ভেতর কেউ তো আছে! কিন্তু চোর ঢুকলে তো এভাবে শব্দ করে চলাচল করার কথা নয়। তাহলে কে হতে পারে? মিথিয়ার ভাবনা জুড়ে হঠাৎ আতঙ্ক এসে ভর করলো। ইচ্ছে করলো পাশের রুম থেকে বান্ধবীকে ডেকে তুলতে। দরজায় কড়া নাড়তে যাবে এমন সময় ছাঁদ থেকে কোন এক নারীর কান্নার মিহি আওয়াজ ভেসে এলো। দু’পা পিছিয়ে এসে শব্দ শোনার আবার চেষ্টা করলো। কান্নার আওয়াজ ক্রমশ বাড়ছে। মিথিয়া আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না। সে সিঁড়ি বেয়ে সরাসরি উপরে যেতে প্রস্তুত হলো।
জ্যোৎ¯œা আলোয় চারদিক থৈ থৈ করছে। ছাদের উপর এক পা রাখতেই একটা দমকা হাওয়া মিথিয়ার দেহটিকে শিহরিত করে তুললো। ছাদের এক কোণায় ওটা কে দাঁড়িয়ে আছে? ‘কে? কে কান্না করছে ওখানে?’- জোর গলায় আওয়াজ তুলতেই মেয়েটি কান্না বন্ধ করে মিথিয়ার দিকে মুখ করে দাঁড়ালো। মিথিয়া তার দিকে টর্চ লাইটটা তাক করতেই বুকের ভেতরটা ধড়াম করে নড়ে উঠলো। বিস্ফারিত চোখে রক্তাক্ত মেয়েটির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে তারপর আস্তে করে বললো ‘মৌমিতা’। মৌমিতা দু’পা এগিয়ে এসে একটা ডায়েরি জামার নিচ থেকে বের করে মিথিয়ার দিকে ছুঁড়ে মারলো। বাকরুদ্ধ মিথিয়া ডায়েরিটাকে উপুড় হয়ে তুলতে যাবে এমন সময় আকাশে গর্জন দিয়ে উঠলো মেঘ। বিজলী চমকানোর সাথে সাথে মৌমিতা এক চিৎকারে পেছন দিকে দৌড় শুরু করলো। তারপর সরাসরি পাঁচ তলা ছাদ থেকে লাফ। মিথিয়াও সঙ্গে সঙ্গে ছাদের উপর থেকে নিচের দিকে তাকালো। কিন্তু ততক্ষণে কেউ নেই।
মিথিয়া রাজশাহীতে ছয় মাস হলো একটানা থাকছে। আরএমসি তে চান্স পাওয়ার আগ পর্যন্ত যদিও সে সিরাজগঞ্জে পরিবারের সাথে ছিল তবুও রাজশাহীর আলো বাতাস একেবারে অপরিচিত নয়। তার বড় ভাইয়া রাহুল এই শহরে থেকেই পড়াশোনা করেছে। সেই সুবাদে আসা হয়েছে অনেকবার। এখনতো এ শহরের সে একজন স্থায়ী বাসিন্দা। বড় ভাইয়া রাজশাহী ইউনিভার্সিটির হলে থাকে। সামনেই বিসিএস রিটেন পরীক্ষা দিবে বলে সারাক্ষণ পড়াশোনায় ব্যস্ততা দেখায়। ফোনেও পাওয়া যায় না ঠিকমতো, সামনা সামনি হলে অল্পক্ষণের মধ্যেই বিদায়ের ঘন্টা বাজে। ইদানিং কেমন যেন বিশাল দূরত্ব তৈরি হয়েছে! অথচ এই ছেলেটিই তার বোনের জন্য কতটা পাগল ছিলো আগে। ভাবতে গেলে পাঁচে দুইয়ে কিছুতেই মিলাতে পারে না মিথিয়া। মৌমিতা তার সবচেয়ে কাছের একজন বান্ধবী। মেডিকেল ভর্তি কোচিং করতে এসে প্রথম পরিচয়। মেয়েটি পড়াশোনায় যেমন দক্ষ তার চেয়েও বেশি দক্ষ কথাবার্তায়। কোচিং শেষে মিথিয়া যখন বাড়ি ফিরছিল হঠাৎ একদিন রাস্তায় মাথা ঘুরিয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ে। চোখ খুলে নিজেকে মৌমিতার বাসায় আবিষ্কার করে। রাস্তা থেকে উঠিয়ে এনে টানা দুইদিন নিজের কাছে রেখে সেবা করেছে এই মেয়েটি। দু’চোখের কয়েক ফোঁটা অশ্রু ছাড়া সেই বার প্রতিদান স্বরূপ আর কিছুই দিতে পারেনি মিথিয়া।
তখন শ্রাবণ এর মাঝামাঝি সময়। এক সন্ধ্যায় কোচিং শেষ করে বাড়ি ফিরছিল মৌমিতা। হঠাৎ রাস্তা থেকে নিখোঁজ। তিনদিন পর খবর আসে শহরের এক বিখ্যাত হোটেলের ছয় তলা থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করেছে এই মেয়েটি। ঘটনাটি শুনে মিথিয়ার সামান্য পরিমাণও বিশ্বাস না হলেও নিজের চোখে মৌমিতার মৃতদেহটি দেখে আঁতকে উঠেছিল শতবার। এখনো সেই স্মৃতি মনে পড়লে মাথা ঘুরিয়ে অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার ভয়ানক রোগটি আবারও নাড়াচাড়া দিয়ে ওঠে। ডাক্তার বলেছে সতর্ক থাকতে। তার মাথার ক্ষতটি কোন সাধারন ক্ষত নয়। সেখান থেকে নিঃসৃত রস সারা দেহে এমন ভাবে ছড়িয়ে পড়ে যে মিথিয়া সাময়িক সময়ের জন্য সেন্সলেস হয়ে যায়। ঠিকমত ওষুধ না খেলে এ ক্ষতটি থেকে ক্যান্সার নামক ভয়াবহ রোগের সৃষ্টি হতে পারে। তাই সবসময় পজিটিভলি থাকতে এবং চিন্তা করতে বলা হয়েছে।
আরো পড়ুন – বাড়ি ফেরা হলো না মিন্নির
মৌমিতার ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহটি প্রশাসন কর্তৃক তার পরিবারের কাছে স্থানান্তর করা হয়। উল্লেখ করা হয় রাজশাহীতে আসার পর থেকেই প্রেমঘটিত কলহ ও আর্থিক অসচ্ছলতাই মেয়েটির আত্মহত্যার বড় কারণ। এ নিয়ে প্রশাসন বাহিনী আর সামনের দিকে এগোয়নি। এটি সাধারণ কোনো আত্মহত্যা নাকি হত্যা? পত্রিকার পাতায় টপ নিউজটিও একদিন সময়ের পাল্লায় গুম হয়ে যায়। শুধু গুম হয়ে যায়নি মিথিয়ার হৃদয় থেকে। সে জানে মৌমিতা আত্মহত্যা করার মত কোন মেয়ে নয়। তার হৃদয়ে যদিও কষ্টের পাহাড় ছিল তবুও সে স্বপ্ন দেখতো, এই কষ্টকে সে একদিন জয় করবে। উঁচু পর্যায়ের একজন ডাক্তার হয়ে যেদিন সে বেরুবে সেদিন তার পরিবারের মুখে যেমন হাসি ফুটবে তেমনি সমাজের সকল মানুষ অবাক হয়ে হাততালি দেবে। স্বপ্নচারিনী সেই পাখিটির প্রেমঘটিত কোন কলহে নয় বরং কারো ষড়যন্ত্রে ফেঁসে নিজের জীবনটা পর্যন্ত দিতে হলো। মিথিয়া বিশ্বাস করে সেই সত্য একদিন প্রকাশ পাবে। তার কিছুদিন পরেই মৌমিতার অসুস্থ ছোট ভাইটিও চিকিৎসার অভাবে পৃথিবী ছেড়ে বিদায় হয়। টিউশনির টাকা যুগিয়ে যে খরচ মৌমিতা নিজে বহন করতো তা হয়তো আর কোনদিন করার প্রয়োজন পড়বে না। ওপারে ভালো থাকুক আদরের ছোট ভাইটি।
ছাদের উপরে পড়ে থাকা ডায়েরিটা তুলতে গিয়ে থর থর করে কাঁপছে মিথিয়া। সে কি স্বপ্ন দেখছে নাকি ওই মেয়েটি সত্যি সত্যি মৌমিতা ছিল না? সবকিছু যদি বিভ্রম হয়ে থাকে তাহলে এই ডায়েরিটা? আতঙ্ক বেড়েই চলেছে। মনে হচ্ছে আবারও সে অজ্ঞান হয়ে যাবে। ততক্ষণে ইলেক্ট্রিসিটিও চলে এসেছে। ছাদ থেকে দ্রুত নেমে এসে ঘরের ভেতরে প্রবেশ করল মিথিয়া। কপালের ঘাম চুয়ে চুয়ে যেন পা দিয়ে নামছে। সে আরও অবাক হলো যখন ডায়েরির পৃষ্ঠাটা উল্টাতেই চোখে পড়লো মৌমিতার হাতের লেখা।
“তোরা মানুষ না, জানোয়ার। পৃথিবীতে যে সমস্ত জঘন্য প্রাণীর জন্ম হয়েছে তাদের থেকেও তোরা অধম। তোদের বিচার আল্লাহ করবে। একটা অসহায় মেয়েকে এভাবে রাস্তা থেকে উঠিয়ে এনে দুইদিন যাবত হোটেলের রুমে আটকে রেখে ধর্ষণ করছিস, নির্যাতন চালাচ্ছিস। রাহুল, মিথিয়ার বড় ভাই তুই। আমারতো কোন বড় ভাই নেই। এতটাই তোকে বিশ্বাস করতাম যে মিথিয়ার সঙ্গে মিলে পিঠা বানিয়ে তোকে খাইয়েছি। আর সেই তুই কি না ঐ সব জানোয়ারদের সাথে মিশে….ছিঃ , পৃথিবীর আর কোন বোন যেন তাদের মতো ভাইকে বিশ্বাস না করে।
আজ তৃতীয় দিন। আবারো ধর্ষণ, নির্যাতন। আর কতটা কষ্ট দিয়ে আমার প্রানটাকে ছিঁড়ে বের করবি? আমিও তো একটা মানুষ। অন্তত আমার অসুস্থ ছোট ভাইটির জন্য হলেও আমাকে ছেড়ে দে। কথা দিচ্ছি মুখ খোলবো না। তোর বোনকে কিচ্ছু বলবো না রাহুল। তোর পায়ে ধরছি অন্তত একটি বারের জন্য হলেও আমাকে মুক্তি দে। আমাকে মেরে ফেলিস না। আমি এমনিতেই মরে গেছি।
আমি জানি তোরা আমাকে মেরে ফেলার প্লেন করছিস। হয়তো আর কিছুক্ষণ পরেই ছাদ থেকে লাত্থি দিয়ে ফেলে দিবি। তারপর এই হত্যাকে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দিবি। টাকা উড়িয়ে মুখ বন্ধ করে দিবি সবার। এটাও জানি দুনিয়ায় তোদের বিচার হবে না। কার সাহস হবে এই বিচার করার? তবে মনে রাখিস, তোরা জাহান্নামে পঁচে মরবি। তোদের কপালেও এমন দিন আসবে যেদিন আমার চেয়েও ভয়ানক মৃত্যু হবে তোদের। আফসোস! সেই দিনটি দেখে যেতে পারবো না…..।”
ডায়েরির পৃষ্ঠাগুলো পড়ে শেষ করতে না করতেই ফোন বেজে উঠলো মিথিয়ার। ফোনটা ধরতেই ওপাশ থেকে কে যেন বলছে, ‘আপনি কি রাহুল কে চিনেন? কে হয় আপনার?’
‘চিনি। তবে আমার কেউ হয় না।’
‘কিছুক্ষণ আগে একটা মারাত্মক অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। রাহুলের সারা শরীরে রড ঢুকে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। মাথার মস্তক বের হয়ে গেছে। কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে ছেলেটি এখনও মরে নি। শুধু ব্যথায় কাতরাচ্ছে। আমরা তাকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছি আপনিও আসুন।’
শিক্ষার্থী,
ইলেক্ট্রিক্যাল এন্ড ইলেক্ট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং,
ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (ডুয়েট)।
মোবাইল: ০১৭৯১৪৮৭২১৮