কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা দাড়ি না রাখার পক্ষে যে অজুহাত দেয়



আমি ব্যক্তিগতভাবে এমন কতিপয় মানুষকে চিনি যারা ধর্মের যাবতীয় সবকিছুই বোঝেন, কিন্তু সবকিছু মানেন না। তাদের যদি বলি, ‘ভাই, দাড়ি রেখে দিলেই তো পারেন’, তারা প্রতি-উত্তরে বলেন-
‘আসলে, জানেন-ই তো, দাড়ি দেখলে মানুষ আজকাল সন্দেহ করে। এখন যা-ও টুকটাক দ্বীনের কাজ করতে পারছি, দাড়ি রাখলে তা একেবারেই করতে পারবো না।’

অথবা বলেন-
‘দাড়ি রাখলে ক্যাম্পাসে ঝামেলা হবে।’

কিংবা, ‘দাড়ি রাখলে চাকরি হবে না’।

তারা এটার সুন্দর একটা নাম দিয়েছে, হিকমাহ! আমি অবাক হয়ে যাই এটা ভেবে যে— হাজার হাজার বছর আগে এমন হিকমাহ অবলম্বনের কথা যদি আসহাবে কাহাফের ওই যুবকদল ভাবতো, তাহলে কী আদৌ তারা আল্লাহর কাছ থেকে কোন মর্যাদা লাভ করতে পারতো? অবশ্যই পারতো না।

তাদের সময়ে তারা যদি ভাবতো, ‘আহা! এদের সবাই তো বিভ্রান্ত হয়ে দেব-দেবিদের পূজায় লেগে গেল। আমরা নাহয় মন থেকে ওদের সাথে নাই-বা থাকলাম, কিন্তু ওদের সাথে আলোচনা করতে গেলে এটা বুঝতে দেব না যে, আমরা তাদের চেয়ে ভিন্ন কিছুতে বিশ্বাস করি। ওরা যদি আমাদের কাছে তাদের বিশ্বাসের কথা বলতে আসে, তখন আমরা বলবো ‘ও আচ্ছা, তাই না-কি? তা বেশ বেশ!’

ভাবুন তো, তারা চাইলে হিকমাহর দোহাই দিয়ে ব্যাপারটাকে এভাবে সামলাতে পারত না? কিন্তু, তারা তা করেনি। কঠিন ফিতনার মাঝে দাঁড়িয়ে, বুক উঁচু করে তারা বলেছিল, ‘নিশ্চয় আমাদের রব তো তিনিই যিনি আসমান এবং যমীনের রব। আমরা তাঁকে বাদ দিয়ে অন্য কাউকে ইলাহ হিশেবে গ্রহণ করবো না’- (আল কাহাফ-১৪)

ফিতনার দিনে মানুষ আপনার মুখে দাড়ি দেখলে দাওয়াত নিবে না বলে আপনি মুখে দাড়ি রাখছেন না। অথচ, আপনার উচিত ছিলো মুখে দাড়ি সহ দুয়ারে দুয়ারে দাওয়াত নিয়ে হাজির হওয়া। যারা দাড়ি দেখলেই আপনার কাছ থেকে পালাবে, তাদের বলা— ‘আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহ আমাকে দাড়ি রাখবার তাওফিক দিয়েছেন। এটা আমার নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহ। আমার নবি ছিলেন পৃথিবীতে পদচিহ্ন রাখা সবচাইতে সেরা, সুদর্শন মানুষ। তাঁর মুখে দাঁড়ি ছিল, আমার মুখেও আছে আলহামদুলিল্লাহ।’

দাড়ি ছেঁটে আপনি তাদের কাছে এমন একজন নবির দাওয়াত নিয়ে যাচ্ছেন যার মুখ ভর্তি দাড়ি ছিল। ব্যাপারটা কেমন না?

দাড়ি আপনার ক্যাম্পাসে ঝামেলা বাড়িয়ে দিতে পারে— এমন ভাবনার আগে আপনি কী তাঁর কথা ভুলে যাচ্ছেন যিনি আপনার জীবন থেকে সকল ঝামেলাকে এক মুহূর্তে বিদেয় করে দিতে পারেন?

দাড়ি আপনার চাকরির পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারে— এমন ভাবনার আগে আপনি কী তাঁর কথা ভুলে যাচ্ছেন যিনি আর-রাযযাক তথা সর্বশ্রেষ্ঠ রিযিকদাতা? যিনি চাইলেই আপনাকে আরো উত্তম জায়গা থেকে, উত্তম উৎস থেকে রিযিক দিতে পারেন?

আসহাবে কাহাফের ওই যুবকেরা ফিতনাকে ‘হিকমাহ’ দিয়ে মোকাবেলা করেনি, করেছিল তাকওয়া দিয়ে। আপনি হিকমাহর নাম করে নিজের নফসকে প্রাধান্য দিচ্ছেন না তো?

আসহাবে কাহাফের ওই সকল যুবকেরা আমাকে স্রোতে গা না ভাসাতে উদ্বুদ্ধ করে। তাদের জনপদের সকলে স্রোতের তালে পড়ে বিভ্রান্ত হলেও, তারা তাদেরকে স্রোতের বিপরীতে ধরে রাখতে পেরেছিল।

আমার সমাজটা নাহয় পঁচেই গেল, কিন্তু তাই বলে কি আমিও পঁচে যাবো? আমার সমাজের সবাই যদি থার্টি ফার্স্ট নাইট উদযাপন করে, আমাকেও তা করতে হবে? আমার সমমনা সকল বন্ধুদের গার্লফ্রেণ্ড আছে বলে কি আমারও একটা গার্লফ্রেণ্ড থাকতে হবে? আমার বন্ধুদের সবাই মুভি দেখে, গান শুনে বলে কি আমাকেও সেসব দেখতে হবে? আমার সমাজে যৌতুক-প্রথা প্রচলিত বলে কি আমাকেও যৌতুক নিয়ে বিয়ে করতে হবে?

না, আসহাবে কাহাফের ওই যুবকেরা তা করেনি। পুরো সমাজ রসাতলে চলে গেলেও তারা তাদের ঈমান ঠিক রাখতে পেরেছিল। সমাজ আর চারপাশ গোল্লায় যাক, কিন্তু আপনাকে দৃঢ় থাকতে হবে আল্লাহর রাস্তায়।

আসহাবে কাহাফের যুবকেরা আমাকে আরও শেখায়— দুনিয়ার খ্যাতির কোন মূল্য আল্লাহর কাছে নেই।

আচ্ছা ভাবুন তো, তাদের সময়ে কতজন মানুষ তাদের চিনতো বা তাদের সম্পর্কে জানত? আর, কতজন মানুষ ওই অত্যাচারী সম্প্রদায়কে চিনত যারা আসহাবে-কাহাফের যুবকদের হত্যা করতে চেয়েছিল?



দুনিয়ার দৃষ্টিতে এখানে ওই সম্প্রদায়টাই এগিয়ে। তাদের হাতেই ছিল কর্তৃত্ব আর ক্ষমতা। কিন্তু আজকের সময়ে বসে দেখুন, ওই সম্প্রদায়টাকে এখন দুনিয়ার ক’জন মানুষ চেনে বা তাদের সম্পর্কে জানে আর কতজন মানুষ আসহাবে কাহাফের ওই যুবকদের চেনে? দিনশেষে সম্প্রদায়টা আমাদের কাছে বিস্মৃত, কিন্তু আমরা গভীর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি ওইসকল যুবকদের।

দুনিয়ায় আপনার মর্যাদা বাড়ছে কি বাড়ছে না তা কখনই বিবেচ্য নয়। দুনিয়াতে কতজন মানুষ আপনার কথা শুনছে, কতজন আপনার দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে, কতজন আপনাকে আইডল মানছে এসবের কোনকিছুই সত্যিকার অর্থে গুরুত্ব বহন করে না। আসহাবে কাহাফের ওই যুবকদের একজনও অনুসরণকারী ছিল না। তাদের কোন জনপ্রিয়তা ছিল না। কিন্তু দেখুন যাদের অনুসারী ছিল, জনপ্রিয়তা ছিল তারা আজ হারিয়ে গেছে কালের গহ্বরে। কিন্তু জনপ্রিয়তা-বিহীন, অনুসারী-বিহীন ওই যুবকদল কী মহিমায় ভাস্বর আমাদের কাছে!

মানুষ আপনার কথা না শুনুক, আপনাকে পাত্তা না দিক, গনায় না ধরুক কিংবা মান-মর্যাদা না দিক বিশ্বাস করুন তাতে আপনার কিচ্ছু যায় আসে না। আল্লাহর কাছে নিজের মর্যাদা বাড়ান, তাহলে তিনি আসহাবে কাহাফের ওই যুবকদের মত আপনাকে নিরাপত্তা দেবেন, রিযিক দেবেন এবং হতে পারে বহু প্রজন্ম পরে তিনি এমন এক প্রজন্মের উত্থান ঘটাবেন যে প্রজন্ম আপনাকে মূল্যায়ণ করবে, মর্যাদা দেবে। আপনি বেঁচে না থাকলেও তারা আপনার কাজকে গুরুত্ব দিয়ে দেখবে, গুরুত্ব দিয়ে পাঠ করবে যেভাবে এখন আমরা সূরা আল-কাহাফ থেকে যুবকদের ঘটনা পড়ি।

সুতরাং, মানুষের চোখে নিজেকে মাপতে নেই। নিজেকে মাপতে হয় আসমানের আয়নায়।

(আরিফ আজাদের লেখা থেকে)