শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলা সদরে তৈরি হচ্ছে ভাষাসৈনিক ডাঃ গোলাম মাওলা উড়াল সেতু

শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলা সদরে তৈরি হচ্ছে ভাষাসৈনিক ডাঃগোলাম মাওলা উড়াল সেতু

মুহাম্মাদ আবু সুফিয়ান আল মাহমুদ,নড়িয়া থেকে

শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলা সদরে তৈরী হচ্ছে ভাষা সৈনিকডাঃগোলাম মাওলা উড়াল সেতু।এসেতুটি নির্মাণের জন্য নতুন বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে প্রায় ৩২ কোটি টাকা। ঢাকার সঙ্গে সড়কপথে যোগাযোগ সহজ করতে ১৯৯৭-৯৮ অর্থবছরে কীর্তিনাশা নদীর ওপর ৯৯ মিটার দৈর্ঘ্যের একটি সেতু নির্মাণ করা হয়। যাতায়াতের পাশাপাশি পণ্য পরিবহনের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ ছিল এই সেতুটি। পদ্মা নদীর ভাঙনের কারণে সেতুটি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে। এ কারণে ২০১৫ সালে সেতু দিয়ে যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেয় স্থানীয় প্রশাসন। সেতু দিয়ে যাতায়াত করত নড়িয়া, জাজিরা ও ভেদরগঞ্জ উপজেলার কয়েক লাখ মানুষ। সেতু বন্ধ থাকায় চরম দুর্ভোগে পড়েছে তারা। ঐ সময় জনদুর্ভোগ কমাতে ঝুঁকিপূর্ণ সেতুটির পাশে নতুন একটি সেতু নির্মাণের জন্য বরাদ্দ হলেও ৩০ ভাগ নির্মাণ কাজ হওয়ার পর শেষ পর্যন্ত পূর্ণ নির্মাণ হয়নি। শরীয়তপুর-২ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য ও পানি সম্পদ উপমন্ত্রী, জননেতা এ কে এম এনামুল হক শামীম সেতুটি নির্মাণের জন্য ফের উদ্যোগ নেন। বৈঠক করেন স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) সাথে। মহামারী করোনার জন্য দীর্ঘদিন ধরে পিছিয়ে থাকা সেতুটি নির্মাণের জন্য নতুন করে বরাদ্দ হয়েছে প্রায় ৩২ কোটি টাকা। যার কাজ দ্রুত শুরু হবে বলে জানা যায়।
নড়িয়া উপজেলার স্থানীয় ক্কারী মুজিবুর রহমান বলেন, দীর্ঘদিন ধরে সেতু দিয়ে মানুষ চলাচল করতে পারলেও সব ধরণের গাড়ি চলাচল বন্ধ রয়েছে। যার কারণে দু পারের মানুষের পরিবহন ব্যবস্থা অনেক সমস্যা হচ্ছে। সেতুটি নির্মাণ হয়ে গেলে দীর্ঘদিনের সমস্যার সমাধান হবে। স্থানীয় এক ব্যবসায়ী মোঃআব্দুল হাকিম বলেন, নতুন সেতু তৈরি না হওয়ায় লোকজনকে কষ্ট করে যাতায়াত করতে হচ্ছে। ভোগান্তিতে পড়েছেন ব্যবসায়ীরাও। ঢাকা থেকে সড়ক পথে পণ্য আনানেওয়া করতে সেতুটি ব্যবহার করতে হয়। কিন্তু দীর্ঘ দিন ধরে এটা বন্ধ। সেতুটি বন্ধ থাকায় ১৫ কিলোমিটার ঘুরে চলাচল করতে হচ্ছে। এতে সময় ও অর্থ বেশি খরচ হচ্ছে। আশা করি এনামুল হক শামীম ভাই’র হাত ধরেই এবার সেতুটি নির্মাণ হবে।পানিসম্পদ উপমন্ত্রী এ কে এম এনামুল হক শামীম এমপি বলেন, আমি মন্ত্রী হওয়ার পরপরই স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) সাথে শরীয়তপুর জেলার চিহিৃত সমস্যা গুলো নিয়ে বৈঠক করি। তার মধ্যে ভাষা সৈনিক ডাঃগোলাম মাওলা সেতুটি ছিলো উল্লেখযোগ্য। করোনার কারণে কিছুটা দেরি হলেও সেতুটি নির্মাণের জন্য নতুন করে প্রায় ৩২ কোটি বরাদ্দ হয়েছে। খুব শীর্ঘই কাজ শুরু হবে। আশা করি আগামী ২ বছরের মধ্যে সেতু নির্মাণ কাজ শেষ হবে। আমি কৃতজ্ঞতা জানাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার প্রতি। ধন্যবাদ জানাই স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরকে (এলজিইডি)।
উল্লেখ্য, গোলাম মাওলা ১৯২০ সালের ২০ অক্টোবর শরীয়তপুর জেলার নড়িয়া থানার পোড়াগাছা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ছাত্রাবস্থায় গোলাম মাওলা কলকাতায় মুকুল ফৌজের অধিনায়ক ছিলেন। তিনি ছিলেন নিখিল ভারত ছাত্র ফেডারেশনের সক্রিয় কর্মী। ১৯৫২ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি এবং পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি ছিলেন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন। তিনি ঐ বছরের ৩১ জানুয়ারি ঢাকা বার লাইব্রেরিতে মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর সভাপতিত্বে গঠিত সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সদস্য ছিলেন। এ সময় তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজের রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহবায়ক ছিলেন। ১৯৫২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারিতে ১৫০ নম্বর মুগলটুলিস্থ পূর্ববঙ্গ কর্মশিবির অফিসে অনুষ্ঠিত সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সভায় ২১ ফেব্রুয়ারি হরতালের মাধ্যমে রাষ্ট্রভাষা দিবস পালন এবং ২১ ও ২৩ ফেব্রুয়ারি পতাকা দিবস পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণে গোলাম মাওলা বিশেষ ভূমিকা রাখেন। ১৯৫২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি থেকে সরকার এক মাসের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করে এবং সভা-সমাবেশ ও মিছিল নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এ ঘোষণার পরপরই গোলাম মাওলার নেতৃত্বে মেডিকেলের ছাত্ররা একত্রিত হয়ে তাৎক্ষণিকভাবে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার এবং আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্র মিছিলে গুলিবর্ষণের পর আন্দোলনের কৌশল নির্ধারণের জন্য আন্দোলনের অধিকাংশ নেতৃবৃন্দ রাতে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে মিলিত হন। এ বৈঠকে ছাত্র সংগ্রাম কমিটি নতুনভাবে গঠিত হলে গোলাম মাওলা কমিটির আহবায়ক নির্বাচিত হন। মেডিকেল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণের যে যায়গায় প্রথম গুলি হয়েছিল সে স্থানে ২৩ ফেব্রুয়ারি রাতে গোলাম মাওলার সার্বিক তত্ত্বাবধানে প্রথম শহীদ মিনার নির্মিত হয়। গোলাম মাওলা মাদারীপুর মহকুমা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন। তিনি ১৯৫৬ সালের উপ-নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তান আইন পরিষদের সদস্য এবং ১৯৬২ সালে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে বিরোধী দলের হুইপ ছিলেন। গোলাম মাওলা ১৯৬৭ সালের ২৯ মে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর স্মৃতি রক্ষার্থে নড়িয়া উপজেলায় কীর্তিনাশা নদীর উপর নির্মিত সেতুটির নামকরণ হয়েছে ডাঃগোলাম মাওলা উড়াল সেতু।