শরীয়তপুরে এডভোকেট হাবিবুর রহমান খুনের মামলায় ৬ জনের ফাঁসী এবং ৪ জনের যাবজ্জীবন

শরীয়তপুরে এডভোকেট হাবিবুর রহমান খুনের মামলায় ৬ জনের ফাঁসী এবং ৪ জনের যাবজ্জীবন

মুহাম্মদ আবু সুফিয়ান আল মাহমুদ, শরীয়তপুর থেকে

শরীয়তপুরের চাঞ্চল্যকর জোড়া খুনের মামলা অর্থাৎ এ্যাাডভোকেট হাবিবুর রহমান এবং তার ছোট ভাই মনির হোসেন হত্যা মামলার রায় ঘোষণা করা হয়েছে।
২১ মার্চ রবিবার সকাল সাড়ে ১১টায় এই রায় ঘোষণা করা হয়। অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ শওকত হোসাইন ১৩৩ পৃষ্ঠার এই রায় ঘোষণা করেন। রায়ে ৬ জনের ফাঁসি ৪ জনের যাবজ্জীবন কারাদন্ড এবং ৩ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়া হয়েছে।
মামলায় মোট ৫৩ জন আসামীর মধ্যে ১৩ জনকে সাজা দেয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে ৬ জন মৃত্যুদন্ড প্রাপ্ত আসামীরা হলেন, শহিদ তালুকদার, শহিদ কোতোয়াল, শাহিন কোতোয়াল, শফিক কোতোয়াল, মজিবর তালুকদার এবং সোলাইমান সরদার।
যাবজ্জীবন সাজা প্রাপ্ত ৪ জন আসামীরা হলেন, সরোয়ার হোসেন বাবুল তালুকদার, বাবুল খান, ডাবলু তালুকদার এবং টোকাই রশিদ।
বিভিন্ন মেয়াদে যাদেরকে সাজা দিয়েছেন তারা হলেন মন্টু তালুকদার, আসলাম সরদার এবং মজনু সরদার। এদের ৭ বছরের সশ্রম কারাদন্ড প্রদান করা হয়েছে।
প্রায় ২০ বছর পর চাঞ্চল্যকর এই জোড়া খুনের মামলার সমস্ত সাক্ষ্য এবং শুনানীর পর রায় ঘোষণা করা হলো। এই মামলায় ৫৩ জন লোককে আসামী করা হয়ে ছিলো।
তারমধ্যে ৩ জন মারা যায়। বাকী আসামীদের মধ্যে ৮ জন আসামী জামিনে ছিলেন। আর ৪২ আসামীর মধ্যে ১৫ জন আসামী পলাতক রয়েছে।
অন্যান্য আসামীরা হলেন, ১) সরোয়ার হোসেন ওরফে বাবুল তালুকদার ২) বাবুল খান ৩) ডাবলু তালুকদার ৪) মন্টু তালুকদার ৫) জুয়েল মীর মালত ৬) হেমায়েত হোসেন ৭) শাহিন কোতোয়াল ৮) পনির সিকদার ৯) সুবাস চন্দ্র দাস ১০) টোকাই রশিদ ১১) কে এম বসিরুল ইসলাম ১২) হেলাল উদ্দিন ১৩) বাবুল সরদার ১৪) শহীদ তালুকদার ১৫) সোহাগ তালুকদার ১৬) টুলু খান ১৭) দুলাল খান ১৮) বাদল তালুকদার ১৯) শহীদ কোতোয়াল ২০) শফিক কোতোয়াল ২১) সলেমান সরদার ২২) রূবেল খান ২৩) বাবুল ফকির ২৪) দুলাল ফকির ২৫) এনামুল ২৬) বাদশা ২৭) মোতাহার কোতোয়াল ২৮) লিটন মুন্সি ২৯) বিল্লাল কোতোয়াল ৩০) আনিছ উদ্দিন ৩১) গোলাম মোস্তফা খান ৩২) জাহিদ খান ৩৩) অহিদ খান ৩৪) জহির খান ৩৫) মজিবর রহমান তালুকদার ৩৬) কামাল তালুকদার ৩৭) নুরুল ইসলাম সরদার ৩৮) রাব্বি আহমেদ রনি ৩৯) মতি মিয়া মাদবর ৪০) লিটন বেপারী ৪১) জসিম শেখ ৪২) অসীম শেখ ৪৩) ইলিয়াছ বেপারী ৪৪) শাহালম সিকদার ৪৫) শাজাহান মাঝি ৪৬) শহিদুল্লাহ মাঝি ৪৭) আসলাম সরদার ৪৮) মীরচান সরদার ৪৯) অরুন বেপারী ৫০) মজনু সরদার ৫১) হারুণ বেপারী ৫২) জলিল বেপারী ৫৩) আজিজুল বেপারী
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী এ্যাডভোকেট মির্জা হযরত আলী ও নিহত হাবিবুর রহমানের ছেলে এ্যাডভোকেট পারভেজ রহমান জন বলেন, ২০০১ সালের ১ অক্টোবর জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামীলীগ প্রার্থী মোবারক আলী সিকদারের সাথে বিএনপি’র সমর্থিত স্বতন্ত্রপ্রার্থী হেমায়েত উল্লাহ আওরঙ্গ নির্বাচনে প্রার্থী হন। ভোট গ্রহণের দিন শরীয়তপুর ৮টি কেন্দ্রের ভোট গ্রহণ স্থগিত হলে তা পুণরায় ৮ অক্টোবর ভোট গ্রহণের দিন ধার্য হয়।
সেই নির্বাচনে সুষ্ঠুভাবে ভোট গ্রহণের জন্য আওয়ামীলীগ নেতাকর্মীদের দায়িত্ব ভাগের জন্য তৎকালীন জেলা আওয়ামীলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি এবং পাবলিক প্রসিকিউটর হাবিবুর রহমানের বাড়ির আঙ্গিনায় ২০০১ সালের ৫ অক্টোবর একটি জরুরি সভা বসে। সেই সভা চলাকালীন দিনে দুপুরে স্বতন্ত্রপ্রার্থী হেমায়েত উল্লাহ আওরঙ্গ এর সমর্থক এবং বেশকিছু চিহ্নিত সন্ত্রাসীরা এ্যাডভোকেট মোঃ হাবিবুর রহমানের বাড়িতে সন্ত্রাসী হামলা চালিয়ে বাড়িঘরে ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করে এবং এ্যাডভোকেট মোঃ হাবিবুর রহমান ও তার ছোট ভাই মোঃ মনির হোসেন মুন্সীকে গুলি করে নির্মমভাবে হত্যা করে।
সেই দিন রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে বাড়ির ২শ’ গজ দুরের পালং থানা পুলিশ রক্ষার্থে এগিয়ে আসেনি। নিরাপত্তার জন্য সন্ত্রাসীদের ভয়ে জীবিত অবস্থায় তাদের চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে নিতে পারেনি পরিবার। তাদের মৃত্যুর পরে পুলিশ এসে লাশ উদ্ধার করে শরীয়তপুর সদর হাসপাতালের মর্গে প্রেরণ করেন।
এরপর এ্যাডভোকেট হাবিবুর রহমানের স্ত্রী মিসেস জিন্নাত রহমান বাদী হয়ে স্বামী ও দেবরের হত্যার বিচার দাবিতে মামলা করেন।
পরে নির্বাচনে হেমায়েত উল্লাহ আওরঙ্গ জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হয়ে প্রভাব বিস্তার করেন। ২০০৩ সালে পুলিশের চার্জশিটে জড়িত আসামিদের নাম বাদ দেয়া হলে বাদী জিন্নাত রহমান নারাজি দেন। নারাজির দরখাস্ত শরীয়তপুরের আদালতে না মঞ্জুর হলে বাদী উচ্চ আদালতে আবেদন করেন। ২০১৩ সালে মামলাটি পূর্ণ তদন্তের আদেশ দেন সুপ্রিমকোর্টের আপিল ডিভিশন। পুণরায় তদন্ত করে বাদপড়া আসামিদের নাম ভুক্ত করে পুণরায় চার্জশিট দেন। মামলার বাদী ২০১৭ সালে ব্রেইন স্টোক করে মারা যায়।
যার প্রেক্ষিতে বাদীর পক্ষে ছেলে এ্যাডভোকেট পারভেজ রহমান জন আদালতে মামলাটির বাদী হিসেবে দায়িত্ব নেন।
অবশেষে জেলা ও দায়রা জজ আদালতে ৬ মাসের মধ্যে মামলাটির সাক্ষ্য গ্রহণ নিয়ে রায় প্রদানের নির্দেশ দেন। তারই প্রেক্ষাপটে করোনা পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলে বর্তমানে মামলাটির শুনানি শুরু হয়। দীর্ঘ ২০ বছর পরে এই মামলার রায় ঘোষণা করা হলো।
মামলার বাদী এ্যাডভোকেট পারভেজ রহমান জন বলেন, দীর্ঘদিন পরে হলেও আমরা ন্যায় বিচার পেয়েছি। আমরা সুখী।
আসামী পক্ষের আইনজীবী এ্যাডভোকেট মাসুদুর রহমান মাসুদ বলেন, আমরা ন্যায় বিচার পাইনি। আমরা উচ্চ আদালতে আপীল করবো।
রাষ্ট্র পক্ষে আইনজীবী এ্যাডভোকেট মির্জা হযরত আলী বলেন, মহামান্য আদালত কর্তৃক যে রায় ঘোষিত হলো তাতে আমরা খুশি হয়েছি। দীর্ঘ ২০ বছর পর বাদী তার রায় পেলেন।