চরমোনাই কি স্বকীয়তা হারাচ্ছে?

চরমোনাই কি স্বকীয়তা হারাচ্ছে?

চরমোনাই দরবারের প্রতিষ্ঠাতা হলেন মাওলানা এসহাক রাহিমাহুল্লাহু। তিনি বিখ্যাত বুজুর্গ কারী ইবরাহীম রহ. এর খলিফা ও মুজাজ। আর তিনি হলেন কুতবে আলম মাওলানা রশীদ আহমাদ গাঙ্গোহী রহ. এর খলিফা।
মাওলানা রশীদ আহমাদ গাঙ্গোহী রহ. কেবল একজন শায়খে তরিকত বা পীর ছিলেন না, ছিলেন বড় মাপের ফকিহ ও মুহাদ্দিস। তাঁর পীর ও শায়খ হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কী রহ. এর একটা মাসআলার বিপরীত তিনি মতামত দিয়েছিলেন। তখন কেউ জিজ্ঞেস করল, আপনার পীরের খেলাফ বললেন? তিনি উত্তর দিলেন, “তরিকতের ক্ষেত্রে আমি তাঁর মুরিদ, আর ফিকহের ক্ষেত্রে তিনি আমাদের মুরিদ।”

গাঙ্গোহী রহ. এর ধারায় ইলম এবং তাসাউওফ একইসঙ্গে প্রবাহিত হয়েছে। উপমহাদেশে কখনও খিলাফত প্রতিষ্ঠা না হলেও সাধারণ জনগণের মাঝে দীনের দাওয়াতে ব্যাপক কাজ করেছেন পীর ও মাশায়েখগণ। যে কারণে পীর ও মাশায়েখদের প্রতি মানুষের দুর্বলতা খুব বেশি। এই দুর্বলতা কাজে লাগিয়ে হকপন্থী পীর মাশায়েখদের পাশাপাশি গড়ে উঠেছে অনেক বাতিল পীর।

বাংলাদেশের কথাই চিন্তা করুন। আটরশীর একটা খানকা আছে বনানীর ৫ নম্বর রোডে। সম্ভবত এই বিল্ডিংটা এরশাদ চাচার হাদিয়া। সেখানে গিয়ে দেখবেন বড়লোক ও কোটিপতিদের ভীড়৷ শিক্ষিত মানুষজন বেশি। আটরশী ছাড়াও দেওয়ানবাগ, কুতুববাগ অমুক তমুক পীরের অভাব নেই। সরাসরি বাতিল পীর ও তাদের মুরিদের সংখ্যা অনেক।

পীর ও দরবার তিন ধরনের :
ক. হকপন্থী
খ. সেমি হকপন্থী
গ. বাতিলপন্থী।

চরমোনাইকে ক বিভাগে রাখা যায়। শর্ষিনা, ফুরফুরাকে খ ভাগে রাখব আমি। আর আটরশী জাতীয় সব হচ্ছে গ বিভাগের।

চরমোনাই তরিকা নিরেট একটি তরিকত ও তাসাউওফের ওপর গঠিত একটি জামাত। এই দরবারের প্রতিষ্ঠাতা ও তাঁর মাশায়েখদের মেহনতের দিকে এবং বর্তমান চরমোনাই তরিকার কার্যক্রমের দিকে তাকালেই বিষয়টি ভালোভাবে ফুটে উঠবে। তারা ইলম ও তরিকতের ওপর জোর দিতেন বেশি; আর এখনকার চরমোনাই তরিকা তরিকত ও ইলমের মেহনত থেকে সরে গিয়ে কেবল রাজনীতি সর্বস্ব একটি জামায়াতে পরিণত হচ্ছে।

মাত্র রমজান মাস অতিবাহিত হল। এই মাসে বিভাগীয় শহরগুলোর পাশাপাশি বিভিন্ন এলাকায় মুরিদ নিয়ে ইতেকাফে বসতে পারত পীর মাশায়েখগণ। সারাবছর কেন্দ্রীয় নেতাদের কার্যক্রম মাহফিল বা রাজনৈতিক কর্মসূচিতে সীমাবদ্ধ। নিরেট ইসলাহী মজলিস হয় না বললেই চলে, যেখানে মুরিদদের নিবিড় পরিচর্যা হবে, তাসাউওফের উচ্চাঙ্গীন বিষয়ে দীক্ষা দেওয়া হবে। এখানে দীক্ষাপ্রাপ্ত শায়খগণ প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিয়ে মানুষের মাঝে দাওয়াতি কাজ করবেন।

ইন্টারনেট, ফেসবুকেও চরমোনাই তরিকার ইসলাহী ও তাসাউওফের কোনো কার্যক্রম পাবেন না। এমন একটা আইডি দেখান যেখানে ইসলাহী লেখা লেখা হয়। অথচ তাদের বিরাট অর্থবিত্ত ও লোকজন রয়েছে, তারা ইচ্ছা করলে অনলাইন ও মিডিয়া জগতে দীনি এবং ইসলাহী কার্যক্রমে নেতৃত্ব দিতে পারতেন। কিন্তু এখানে তাদের কোনো বিনিয়োগ ও প্রচেষ্টা নেই।

গাজী সাহেবের লেখায় ঝড় উঠেছে। ভালো কথা। কিন্তু এতদিন তিনি কী বিষয়ে লেখালেখি করেছেন? গত এক বছরে গাজী আতাউর রহমান সাহেবের লেখাগুলো পড়ে আসুন। ফেসবুকে তাদের একটা শ্রেণীর কাজই হচ্ছে বিরুদ্ধবাদীদের জবাব দেওয়া কিংবা কারও সমালোচনা করা। কেউ কেউ ফেক, কিন্তু পরিচিতমুখরা তো ফেক না।

ইলমের প্রচার, প্রসার ও গবেষণায়ও তাদের উল্লেখযোগ্য অবদান নেই। শুনেছি মরহুম পীর সাহেব রহ. এর নামে একটা রিসার্চ সেন্টার তৈরি হচ্ছ বা হবে। কিন্তু এ পর্যন্ত তাদের ইলমী খেদমাতের কোনো নজির চোখে পড়েনি। এই দিকে তাদের নজরই নেই।

চরমোনাই তরিকার উচিত হল :

১. এই তরিকার পীর ও প্রধান ব্যক্তিরা সরাসরি রাজনীতিতে না আসা। তাদের কোনো ভাই কিংবা উত্তরসূরিদের হাতে রাজনীতি সোপর্দ করে দেওয়া। পীর সাহেবগণ পুরো বাংলাদেশের মুসলমানদের দীনি রাহবার। যে দল একটা সংসদীয় আসনেও বিজয় লাভ করতে পারে না, এমন দলের প্রধান হওয়ার কোনো মানে হয় না।
তাছাড়া আরও ইসলামি রাজনৈতিক দল রয়েছে। যে কারণে একটা দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে। এই দ্বন্দ্ব থেকে দূরে সরা উচিত।
গত ৫০ বছরে বাংলাদেশের ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর অর্জন কী এবং তারা ভবিষ্যতে কী করতে পারবে এবং আগামীতে কখনও কি বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচনের সম্ভাবনা রয়েছে, এই তিনটি বিষয় বিবেচনা করলে তাদের রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়ানো উচিত।

২. রাজনৈতিক ও মাহফিল কেন্দ্রিক কর্মসূচির বাহিরে নিরেট দাওয়াতি ও ইসলাহী প্রোগ্রাম করা৷

৩. অনলাইনে দাওয়াতের শক্তিশালী নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা।

৪. সেবামূলক কার্যক্রমে আরও ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণ করবে।

৪. কওমি ঘরানার অন্যান্য মহলের সাথে দূরত্ব কমিয়ে আনা এবং একসঙ্গে দীনি ও জাতীয় ইস্যুতে কাজ করা।

৫. সংখ্যাগরিষ্ঠ আলেমদের বিপরীতে কোনো মতামত পেশ না করা। উদাহরণস্বরূপ বলতে চাই, আন্দোলনের কোনো একটা প্রোগ্রামে জামিয়াতুস সুন্নাহর বর্তমান মুহতামিম সাহেব বাংলাদেশের খ্যাতনামা আলেমদের নিয়ে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেন। ওই ভিডিওটা দেখলে কান্না আসে। তার মতো লোক কি জাতীয় মানের প্রায় সকল আলেমের সমালোচনা করতে পারে?
চারদলীয় জোটের সাথে জোটবদ্ধ হওয়ার লাভ-ক্ষতি আলোচনা করতে পারেন, রাজনৈতিক বিশ্লেষণ করতে পারেন; কিন্তু শায়খুল হাদীস ও মুফতি আমিনী সাহেবদের মতামতকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য ও ব্যঙ্গ করার অধিকার নেই। ফতোয়া দেওয়ার মানদণ্ডে উত্তীর্ণ ওলামায়ে কেরাম দেশে আছেন৷

এই একটা বিষয় নিয়ে অনেক দূরত্ব তৈরি হয়েছে। তাই এমন জাতীয় বিষয়গুলোর প্রকাশ্য সমালোচনা হতে বিরত থাকা উচিত।

আমাদের আশা, চরমোনাই তরিকা তার স্বকীয়তা বজায় রাখবে। কোটি কোটি মানুষের দীনি, দাওয়াতি ও ইসলাহী এবং নিরেট ইলমী কাজে আত্মনিয়োগ করবে।

লেখকঃ মুফতি মহিউদ্দীন কাসেমী