কুরআনের হাফেজদের মর্যাদা
পবিত্র কুরআনুল কারিম আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে অবতীর্ণ সর্বশেষ এবং সর্বশ্রেষ্ঠ কিতাব। এর পরিশুদ্ধতার ব্যাপারে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। পবিত্র কুরআনুল কারিম সংরক্ষণ ও হেফাজতের দায়িত্ব নিয়েছেন স্বয়ং আল্লাহতায়ালা। এ প্রসঙ্গে আল্লাহতায়ালা ঘোষণা করেন, ‘আমি কোরআন অবতীর্ণ করেছি এবং আমিই তার সংরক্ষণকারী।’ -সূরা আল হিজর : ৮
পবিত্র কুরআনই একমাত্র গ্রন্থ, যেটা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মুখস্থ করা হয়। এর জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে নানা পুরস্কারের কথা ঘোষণা করা হয়েছে।
হজরত আলী (রা.) থেকে বর্ণিত— হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি কুরআন পড়ে মনে রাখে। অতঃপর কুরআন যেটাকে হালাল বলেছে সেটা হালাল এবং কুরআন যেটাকে হারাম বলেছে, সেটাকে হারাম হিসেবে মেনে নেয়। আল্লাহ তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন এবং ওই ব্যক্তি তার পরিবারভুক্ত এমন দশ ব্যক্তির ব্যাপারে সুপারিশ করবেন যাদের ওপর জাহান্নাম অবধারিত। -তিরমিজি
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) থেকে বর্ণিত— রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, (কিয়ামতের দিন) হাফেজে কোরআনকে বলা হবে :পড় এবং আরোহণ কর! তেলাওয়াত কর যেভাবে দুনিয়াতে তেলাওয়াত করতে! নিশ্চয় সেটাই হবে তোমার স্থান, যেখানে তোমার পড়া থেমে যাবে। -তিরমিজি
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি কুরআন পড়ে এবং সে অনুযায়ী আমল করে, কিয়ামতের দিন তার পিতামাতার মাথায় এমন এক তাজ (মুকুট) পরিয়ে দেওয়া হবে, যার কিরণ পৃথিবীর সূর্যের উজ্জ্বলতা থেকে অধিক দীপ্তিময়।
হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যার মাঝে কোরআনের কোনো অংশ নেই সে পতিত ঘরের মতো। -আবু দাউদ ও তিরমিজি
এসব হাদিস থেকে প্রতীয়মান হয় যে, পবিত্র কোরআনের ধারক-বাহকদের কত মান-সম্মান! তাদের পিতামাতা কতই না মর্যাদাবান! এসব পার্থিব জগতের কোনো কিছু দ্বারা মূল্যায়ন করা সম্ভব নয়।
কিন্তু যার মাঝে কোরআনের কোনো অংশ নেই অর্থাৎ যে কোরআন সম্পর্কে অজ্ঞ বা কোরআন শুদ্ধভাবে পড়তে পারে না, সে একটি অনাবাদ পতিত ঘরের মতো। যা কারও উপকারে আসে না বরং বিপদের কারণ হয়। সাপ-বিচ্ছুর আখড়ায় পরিণত হয়। অথচ রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম ওই ব্যক্তি যে নিজে কোরআন শিক্ষা করে এবং অন্যকে শিক্ষা দেয়।’ -তিরমিজি
মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোর একটি বাংলাদেশ। সকাল-সন্ধ্যা এ দেশের মসজিদ-মাদ্রাসা, কলেজ-ইউনিভার্সিটি, সভা-সমাবেশে ইসলামের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করা হয়। দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষার্থীরা কোরআন-সুন্নাহর জ্ঞান আহরণে সদা ব্যস্ত থাকে। বর্তর্মানে শহর-উপশহরে দ্বীনি ইল্ম চর্চার হার বৃদ্ধি পেলেও গ্রামাঞ্চলে এর হার নেমে এসেছে শূন্যের কোঠায়।
মসজিদকেন্দ্রিক মক্তবগুলো প্রায় বিলুপ্তির পথে। এক সময় এ শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে মুসলিম সম্প্রদায়ের কোমলমতি শিশুরা ইসলামের প্রাথমিক জ্ঞান অর্জন করত। কোরআনের পবিত্র ছোঁয়ায় তাদের জীবন আলোকিত হতো। চরিত্র হয়ে উঠত মাধুর্যপূর্ণ।
পবিত্র কোরআনের ধারক-বাহকদের মান ও মর্যাদার কথা যেমন বর্ণিত হয়েছে, তেমনি তাদের দায়িত্ব ও করণীয়তার কথাও ঘোষণা করা হয়েছে। প্রথমে নিজে শিখবে এবং তার ওপর আমল করবে।
অতঃপর অন্যদের তা শিক্ষা দেবে। ৯০ শতাংশ মুসলিম অধ্যুষিত এ দেশে এমন কোনো গ্রাম নেই, যেখানে একজন কারি, হাফেজ, মাওলানা বা একজন আলেম পাওয়া যাবে না।
তারপরও এ দেশে এমন হাজারো মানুষ আছে যারা কালেমাটাও ভালোভাবে উচ্চারণ করতে পারে না। ঠিক পদ্ধতিতে নামাজ আদায় করতে পারে না।
এ অবস্থায় কবরের পথে পাড়ি দিলে জাহান্নাম অবধারিত। উপরন্তু দেশের কোরআনের খাদেম, কারি, হাফেজ, ওলামায়ে কেরাম নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি সামান্য ফেরালে এদের অবস্থার ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হবে। তারা ভ্রান্তপথ ছেড়ে ঠিক পথে পরিচালিত হবে।
জান্নাতি মানুষ হয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় নেবে। নতুবা কিয়ামতের দিন আল্লাহর সামনে জবাবদিহির কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। তাই আসুন, প্রত্যেকেই যার যার অবস্থান থেকে সমাজে কোরআন শিক্ষার কার্যক্রম প্রচার-প্রসারে ভূমিকা রাখি।
কুরআন মুখস্থ করে ভুলে গেলে পরিণাম কী
এক: নিঃসন্দেহে কোরআন ভুলে যাওয়া গর্হিত কাজ। তাই রাসূলুল্লাহ্ ﷺ বহু হাদিসে ভুলে যাওয়ার আশংকা রোধ করার জন্য নিয়মিত তেলাওয়াত করার প্রতি উদ্বুদ্ধ করেছেন। যেমন, এক হাদিসে তিনি বলেছেন,
مَثَلُ الَّذِي يَقْرَأُ الْقُرْآنَ وَهْوَ حَافِظٌ لَهُ مَعَ السَّفَرَةِ الْكِرَامِ الْبَرَرَةِ، وَمَثَلُ الَّذِي يَقْرَأُ الْقُرْآنَ وَهْوَ يَتَعَاهَدُهُ وَهْوَ عَلَيْهِ شَدِيدٌ، فَلَهُ أَجْرَانِ
কোরআনের তেলাওয়াতকারী হাফেজ লিপিকর সম্মানিত ফেরেশতার মত। অতি কষ্ট হওয়া সত্ত্বেও যে ব্যাক্তি বারবার কোরআন তেলাওয়াত করে, সে দ্বিগুণ পুরস্কার পাবে। (বুখারী ৪৫৭৩)
দুই: কোরআন ভুলে গেলে ‘আমি ভুলে গেছি’ বলা উচিত নয়। বরং বলতে হয়, ‘আমাকে ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে’। কেননা, হাদিস শরিফে এসেছে, রাসূলুল্লাহ্ ﷺ বলেছেন,
بِئْسَمَا لأَحَدِهِمْ يَقُولُ نَسِيتُ آيَةَ كَيْتَ وَكَيْتَ بَلْ هُوَ نُسِّيَ اسْتَذْكِرُوا الْقُرْآنَ فَلَهُوَ أَشَدُّ تَفَصِّيًا مِنْ صُدُورِ الرِّجَالِ مِنَ النَّعَمِ بِعُقُلِهَا
যদি কেউ এভাবে বলে যে, আমি অমুক অমুক আয়াত ভুলে গিয়েছি তাহলে তা তার জন্য খুবই খারাপ। বরং তাকে তো ভুলিয়ে দেয়া হয়েছে। তোমরা কোরআনকে স্মরণ রাখ। কারণ কোরআন মানুষের হৃদয় থেকে পা বাঁধা পলায়নপর চতুস্পদ জন্তুর চেয়েও অধিক পলায়নপর। ছাড়া পেলেই পালিয়ে যায় অর্থাৎ স্মরণ রাখার চেষ্টা না করলেই ভুলে যায়। (মুসলিম ১৭২৬)
তিন: কোরআন ভুলে যাওয়ার হুকুম কি এ ব্যাপারে আলেমগণ মতানৈক্য করেছেন,
ইবনু তাইমিয়া রহ. বলেন, فإن نسيان القرآن من الذنوب কোরআন ভুলে যাওয়া গুনাহ। (মাজমু’উল ফাতাওয়া ১৩/৪২৩)
শায়খ জাকারিয়া আলআনসারি রহ. বলেন, অবহেলা ও অলসতার কারণে কোরআন ভুলে যাওয়া কবিরা গুনাহ। কেননা, রাসূলুল্লাহ্ ﷺ বলেছেন,
عُرِضَتْ عَلَىَّ ذُنُوبُ أُمَّتِي فَلَمْ أَرَ ذَنْبًا أَعْظَمَ مِنْ سُورَةٍ مِنَ الْقُرْآنِ أَوْ آيَةٍ أُوتِيَهَا رَجُلٌ ثُمَّ نَسِيَهَا
আমার উম্মাতের গুনাহসমূহ আমাকে দেখানো হয়েছে। আমি তাতে কোরআনের কোন সূরাহ বা আয়াত শেখার পর তা ভুলে যাওয়ার চাইতে বড় গুনাহ আর দেখি নি। (আবু দাউদ ৪৬১ তিরমিযী ১৯৭৬ ইবনু খুযাইমাহ ১৯১৬)
مَا من امْرِئٍ يَقْرَأُ الْقُرْاٰنَ ثُمَّ يَنْسَاهُ إِلَّا لَقِىَ اللّٰهَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ أَجْذَمَ
যে ব্যক্তি কোরআন শিখে ভুলে গিয়েছে, সে কিয়ামাতের দিন অঙ্গহানি অবস্থায় আল্লাহর সাথে সাক্ষাত করবে। (আবু দাউদ ১৪৭৪ মুসান্নাফ ইবন আবী শাইবাহ ১০/৪৭৮)
সাহাবী আবূ ‘আলিয়্যাহ্ রাযি. বলেন,
كنا نعد من أعظم الذنوب أن يتعلم الرجل القرآن ثم ينام عنه حتى ينساه
আমরা সবচাইতে বড় গুনাহ বলে আখ্যায়িত করতাম কোন ব্যক্তির কোরআন শিক্ষা গ্রহণের পর অবহেলাবশত তা ভুলে গেলে। (ফাতহুল বারী ১১/২৮৫)
কারো কারো মতে, এটি এমন একটি মুসিবত যা বান্দার অন্তর ও দ্বীনদারিকে আক্রান্ত করে। এর ফলে বান্দার কোন কোন আমলের উপর আল্লাহর শাস্তি নামতে পারে। যদিও এটি কবিরা গুনাহ নয় বা পাপ নয়। (প্রাগুক্ত ৯/৮৬) কেননা, আল্লাহ তাআলা বলেছেন,
وَمَا أَصَابَكُم مِّن مُّصِيبَةٍ فَبِمَا كَسَبَتْ أَيْدِيكُمْ وَيَعْفُو عَن كَثِيرٍ
তোমাদের উপর যেসব বিপদ-আপদ পতিত হয়, তা তোমাদের কর্মেরই ফল এবং তিনি তোমাদের অনেক গোনাহ ক্ষমা করে দেন। (সুরা শূরা ৩০)
চার: ‘ভুলে যাওয়া’ শব্দের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ইমাম আবু ইউসুফ রহ. বলেছেন, المراد بالنسيان : أن لا يمكنه القراءة في المصحف দেখে দেখে তেলাওয়াত করার যোগ্যতাও হারিয়ে ফেলা। (মাতালিব উলিন্নুহা ১/৬০৪)
আর কোনো কোনো মুহাক্কিক ব্যাখ্যাকার ‘ভুলে যাওয়া’-এর ব্যাখ্যা করেছেন মুখস্ত পড়ার যোগ্যতা হারিয়ে ফেলা। (বারীকা মাহমুদিয়া ৪/১৯৪)
ইমাম রাফি‘ঈ রহ. বলেন, কোরআন শিক্ষার বিভিন্ন ধরণ হতে পারে। যেমন দেখে পড়া, মুখস্থ রাখা, অর্থ বুঝা। যাই হোক না কেন তা ভুলে গেলে তার কাবীরাহ্ গুনাহ হবে। (ফাতহুল বারী ১১/২৮৫)
কেউ কেউ বলেন, النسيان بمعنى ترك العمل لا نسيانه بعد حفظه এখানে ভুলে যাওয়া মানে কোরআনের তিলাওয়াত ও তার প্রতি ‘আমাল থেকে বিরত থাকা। (আল ইস্তিযকার ২/৪৮৭)
হজরত সাদ ইবনে ওবায়দা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি কোরআন পড়ে ভুলে যায়, সে কেয়ামতের দিন আল্লাহর দরবারে এমন অবস্থায় আসবে যে, কুষ্ঠ রোগের কারণে তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ যেন খসে খসে পড়ছে।’ (আবু দাউদ : ১৪৭৪)
শিক্ষা
কোরআন পড়ে ভুলে যাওয়ার কয়েকটি কারনঃ
১. কোরআন তেলাওয়াত শেখার পর তেলাওয়াত না করতে করতে পড়তে ভুলে যাওয়া;
২. হিফজ করার পর মুখস্ত পড়তে ভুলে যাওয়া;
৩. কোরআন তেলাওয়াত ও হিফজ করার পর পড়া ছেড়ে দেওয়ার মাধ্যমে কোরআনের কথা ভুলে যাওয়া এবং ৪. কোরআনের হুকুমসমূহ জানার পর তা ভুলে যাওয়া। যেভাবেই ভুলে যাওয়া হোক তার পরিণাম অত্যন্ত ভয়াবহ।
কোরআন আল্লাহর কালাম। তাই প্রতিদিন নিয়মিত তেলাওয়াত করা, সাধ্যমতো হিফজ করার চেষ্টা করা ও কোরআনের বাণী জানার চেষ্টা করা।
কোরআনের নির্দেশ অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করা ৷
কুরআন পড়ে ভুলে যাওয়া ব্যক্তির জন্য কিছু উপদেশ
– তার মুখস্থ করা সূরাগুলো আবার ঠিকমতো মুখস্থ না হওয়া পর্যন্ত পড়তে হবে।
– আবার যাতে ভুলে না যায়, সেদিকে নজর রাখতে হবে এবং পুনঃপাঠ জারি রাখতে হবে।
– মুখস্থ করা চালু রেখে তার উন্নতির দিকে নজর দিতে একজন ভালো শিক্ষকের শরণাপন্ন হতে হবে।
– সে বড় যেসব অংশ মুখস্থ করেছে (যেমন পারা ইত্যাদি) সেগুলোর পুনঃপাঠের পাশাপাশি পুরো সূরা আয়ত্তাধীন করার চেষ্টা করতে হবে। তাই যা আগে পড়া হয়েছিল, এভাবে আবার তা পাঠ করে সম্পূর্ণ সূরা মু্খস্থ করতে সহজ হবে।
– ভুলে যাওয়া ছোট অংশের ক্ষেত্রে (যেমন দুই-তিনটি আয়াত) সেগুলো মনে করার চেষ্টা করে কষ্ট করার দরকার নেই।