মহররম কী?
আর এর অপর নাম শহরুল্লাহ বা আল্লাহর মাস ৷ বিশেষত্ব ও অনন্য বৈশিষ্ট্যের কারণে এ মাসের নামকরণ করা হয়েছে মহররম বা মর্যাদাপূর্ণ মাস। মহররম সম্পর্কে (যা আশহুরে হুরুমের অন্তর্ভুক্ত তথা নিষিদ্ধ মাস) পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে-
اِنَّ عِدَّۃَ الشُّہُوۡرِ عِنۡدَ اللّٰہِ اثۡنَا عَشَرَ شَہۡرًا فِیۡ کِتٰبِ اللّٰہِ یَوۡمَ خَلَقَ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضَ مِنۡہَاۤ اَرۡبَعَۃٌ حُرُمٌ ؕ ذٰلِکَ الدِّیۡنُ الۡقَیِّمُ ۬ۙ فَلَا تَظۡلِمُوۡا فِیۡہِنَّ اَنۡفُسَکُمۡ وَ قَاتِلُوا الۡمُشۡرِکِیۡنَ کَآفَّۃً کَمَا یُقَاتِلُوۡنَکُمۡ کَآفَّۃً ؕ وَ اعۡلَمُوۡۤا اَنَّ اللّٰہَ مَعَ الۡمُتَّقِیۡنَ ﴿۳۶﴾
নিশ্চয় মাসসমূহের গণনা আল্লাহর কাছে বার মাস আল্লাহর কিতাবে, (সেদিন থেকে) যেদিন তিনি আসমান ও যমীন সৃষ্টি করেছেন। এর মধ্য থেকে চারটি সম্মানিত, এটাই প্রতিষ্ঠিত দীন। সুতরাং তোমরা এ মাসসমূহে নিজদের উপর কোন যুলম করো না, আর তোমরা সকলে মুশরিকদের সাথে লড়াই কর যেমনিভাবে তারা সকলে তোমাদের সাথে লড়াই করে, আর জেনে রাখ, নিশ্চয়ই আল্লাহ মুত্তাকীদের সাথে আছেন। [সুরা তাওবা : ৩৬]
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, যুগ ঘুরে-ফিরে পুনরায় সেই অবস্থাতে এসে গেছে যে অবস্থাতে ছিল ৷ যখন আল্লাহ তা‘আলা আকাশ, পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন। তা হল বার মাসে এক বছর। যার মধ্যে চারটি হল নিষিদ্ধ মাস, তিনটি ধারাবাহিক যুলক্বাদাহ, যুলহাজ্জ ও মুহাররাম।
আর চতুর্থটি হল রজব যা জুমাদাল আখির ও শাবানের মাঝে। (সহীহ বুখারী হা: ৪৬৬২) এটাই সঠিক শরীয়ত। অর্থাৎ এমন মাসগুলো এ ক্রমানুসারে হওয়া যেমন আল্লাহ তা‘আলা করেছেন, যার মধ্যে চার মাস নিষিদ্ধ। তা যথাযথ হিসাব ও সংখ্যায় পূর্ণ।
হারাম মাসগুলোতে যুদ্ধের সূচনা করা যাবে কিনা এ নিয়ে দুটি মত পাওয়া যায়।
১. হারাম মাসে যুদ্ধ করার যে নিষেধাজ্ঞা ছিল তা রহিত হয়ে গেছে। কেননা আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:
(فَلَا تَظْلِمُوْا فِيْهِنَّ أَنْفُسَكُمْ)
“সুতরাং তোমরা তার মধ্যে নিজেদের প্রতি জুলুম করো না” আবার আল্লাহ তা‘আলা মুশরিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার নির্দেশও দিচ্ছেন।
আয়াতের পূর্বাপর দ্বারা বুঝা যাচ্ছে বিষয়টি ব্যাপক। যদি হারাম মাসে যুদ্ধ করা নিষেধ থাকত তাহলে তা শর্তযুক্ত করে দেয়া হত। তাছাড়া নাবী (সাঃ) শাওয়াল মাসে হাওয়াযেন গোত্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। (সহীহ বুখারী হা: ৪৩২৫০)
২. হারাম মাসগুলোতে যুদ্ধ করা হারাম। এ বিধান রহিত হয়নি। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(اَلشَّھْرُ الْحَرَامُ بِالشَّھْرِ الْحَرَامِ وَالْحُرُمٰتُ قِصَاصٌ ﺚ فَمَنِ اعْتَدٰی عَلَیْکُمْ فَاعْتَدُوْا عَلَیْھِ بِمِثْلِ مَا اعْتَدٰی عَلَیْکُمْﺕ وَاتَّقُوا اللہَ وَاعْلَمُوْٓا اَنَّ اللہَ مَعَ الْمُتَّقِیْنَ)
“নিষিদ্ধ মাসের পরিবর্তে নিষিদ্ধ মাস এবং নিষিদ্ধ মাসেও বদলার ব্যবস্থা রয়েছে ঐ অবস্থায় যদি কেউ তোমাদের প্রতি অত্যাচার করে, তবে তোমরাও তার প্রতি সে পরিমাণ অত্যাচার কর যতটুকু সে করেছে। আল্লাহকে ভয় কর এবং জেনে রেখ যে, আল্লাহ মুত্তাকীদের সাথে রয়েছেন।” (সূরা বাকারাহ ২:১৯৪) তবে প্রথম কথাই প্রসিদ্ধ ও অধিক গ্রহণযোগ্য।
আশুরা অর্থ কী?
এ ধারাবাহিকতায় আল্লাহর রাসুল হজরত মুহাম্মদ (সা.) কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনার কথা আশুরার সময়ে বা আশুরাকেন্দ্রিক হতে পারে বলে আশা ও আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন। এ সময় এলেই তিনি বিনম্র থাকতেন, রোজা রাখতেন। (তাফসিরে তাবারি, ইবনে জারির)।
কুরআনে এসেছে, ‘আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টির দিন থেকেই আল্লাহর নিকট মাসের সংখ্যা বারো, তন্মধ্যে চারটি মাস সম্মানিত।’ (সুরা-৯, তাওবা, আয়াত: ৩৬)। হাদিস শরিফে মহররমকে ‘শাহরুল্লাহ’ বা ‘আল্লাহর মাস’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। আর পবিত্র কোরআনে উল্লেখিত সুরা তাওবার ৩৬ নম্বর আয়াতে ‘অতি সম্মানিত ও মর্যাদাপূর্ণ চার মাস’ বলতে জিলকদ, জিলহজ, মহররম ও রজব—এই চার মাসকে বোঝানো হয়েছে। (তাফসিরে মাজহারি)।
মহররম বা আশুরার রোজা
আশুরার দিন রোজা রাখা সুন্নাত। আশুরার রোজা সব নবীর আমলেই ছিল। নবী করিম (সা.) মক্কায় থাকতেও আশুরার রোজা পালন করতেন। হিজরতের পর মদিনায় এসে রাসুলুল্লাহ (সা.) দেখতে পেলেন, ইহুদিরাও এই দিনে রোজা রাখছে। প্রিয় নবী (সা.) তাদের রোজার কারণ জানতে পারলেন, এদিনে মুসা (আ.) সিনাই পাহাড়ে আল্লাহর পক্ষ থেকে তাওরাত লাভ করেন।
এদিনেই তিনি বনি ইসরাইলকে ফেরাউনের কয়েদখানা থেকে উদ্ধার করেন এবং এদিনেই তিনি বনি ইসরাইলদের নিয়ে লোহিত সাগর অতিক্রম করেন। আর ফেরাউন সেই সাগরে ডুবে মারা যায়। তাই কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য ইহুদিরা এই দিন রোজা রাখে।
মহানবী (সা.) বললেন, মুসা (আ.)-এর সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক তোমাদের চেয়ে বেশি ঘনিষ্ঠ। অতঃপর তিনি মহররমের ৯-১০ অথবা ১০-১১ মিলিয়ে দুটি রোজা রাখতে বললেন, যাতে ইহুদিদের সঙ্গে সাদৃশ্য না হয়। দ্বিতীয় হিজরিতে রমজান মাসের রোজা ফরজ করা হলে আশুরার রোজা নফল হয়ে যায়। তবে রমজানের রোজা রাখার পর আশুরার রোজা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও ফজিলতপূর্ণ।
আশুরার রোজা সম্পর্কে হাদীস
حَدَّثَنِيْ أَحْمَدُ أَوْ مُحَمَّدُ بْنُ عُبَيْدِ اللهِ الْغُدَانِيُّ حَدَّثَنَا حَمَّادُ بْنُ أُسَامَةَ أَخْبَرَنَا أَبُوْ عُمَيْسٍ عَنْ قَيْسِ بْنِ مُسْلِمٍ عَنْ طَارِقِ بْنِ شِهَابٍ عَنْ أَبِيْ مُوْسَى قَالَ دَخَلَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم الْمَدِيْنَةَ وَإِذَا أُنَاسٌ مِنْ الْيَهُوْدِ يُعَظِّمُوْنَ عَاشُوْرَاءَ وَيَصُومُوْنَهُ فَقَالَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم نَحْنُ أَحَقُّ بِصَوْمِهِ فَأَمَرَ بِصَوْمِهِ
আবূ মূসা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ:
তিনি বলেন, নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন মদীনায় আসলেন, তখন ইয়াহূদী সম্প্রদায়ের কিছু লোক আশুরার দিনকে খুব সম্মান করত এবং সেদিন তারা সাওম পালন করত। এতে নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, ইয়াহূদীদের চেয়ে ঐ দিন সাওম পালন করার আমরা বেশি হকদার।তারপর তিনি সবাইকে সাওম পালন করার নির্দেশ দিলেন। (আধুনিক প্রকাশনীঃ ৩৬৫১, ইসলামী ফাউন্ডেশনঃ ৩৬৫৪)
আশুরা বা মহররমের রোজার ফজিলত
أَخْبَرَنَا قُتَيْبَةُ بْنُ سَعِيدٍ، قَالَ: حَدَّثَنَا أَبُو عَوَانَةَ، عَنْ أَبِي بِشْرٍ، عَنْ حُمَيْدِ بْنِ عَبْدِ الرَّحْمَنِ هُوَ ابْنُ عَوْفٍ، عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «أَفْضَلُ الصِّيَامِ بَعْدَ شَهْرِ رَمَضَانَ شَهْرُ اللَّهِ الْمُحَرَّمُ، وَأَفْضَلُ الصَّلَاةِ بَعْدَ الْفَرِيضَةِ صَلَاةُ اللَّيْلِ»
আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ:
তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, রমযান মাসের পর সর্বোত্তম সাওম হল মুহররম মাসের সাওম (আশুরার সাওম) এবং ফরয সালাতের পর সর্বোত্তম সালাত হল রাত্রের সালাত।
[সুনানে আন-নাসায়ী, হাদিস নং ১৬১৩]
عَنْ أَبِي قَتَادَةَ الأَنْصَارِيِّ – رضي الله عنه – أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ – صلى الله عليه وسلم – سُئِلَ عَنْ صَوْمِ يَوْمِ عَرَفَةَ، قَالَ: «يُكَفِّرُ السَّنَةَ المَاضِيَةَ وَالبَاقِيَةَ» وَسُئِلَ عَنْ صِيَامِ يَوْمِ عَاشُورَاءَ، فَقَالَ: «يُكَفِّرُ السَّنَةَ المَاضِيَةَ» وَسُئِلَ عَنْ صَوْمِ يَوْمِ الاثْنَيْنِ، قَالَ: «ذَاكَ يَوْمٌ وُلِدْتُ فِيهِ، وَبُعِثْتُ فِيهِ، أَوْ أُنْزِلَ عَلَيَّ فِيهِ» رَوَاهُ مُسْلِمٌ
আবূ কাতাদাহ আল-আনসারী (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ:
রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ‘আরাফাহর দিনে সওম সম্বন্ধে জিজ্ঞাসিত হয়ে বললেন-এর দ্বারা বিগত ও আগত এক বছরের গোনাহ (পাপ) মোচন হয়। “আশুরাহর দিনের সওম পালন সম্বন্ধে জিজ্ঞাসিত হয়ে বললেন-বিগত এক বছরের পাপ মোচন হয়। সোমবারের দিনে সওম পালন সম্বন্ধে জিজ্ঞাসিত হয়ে বললেন, এটা সেদিন যেদিন আমি জন্মেছি এবং নুবুওয়াত লাভ করেছি আর আমার উপর (কুরআন) অবতীর্ণ হয়েছে।”
[মুসলিম ১১৬২, তিরমিযী ৬৭৬, নাসায়ী ২৩৮২, আবু দাউদ ২৪২৫, ইবনু মাজাহ ১৭১৩, আহমাদ ২২০২৪ ]
উম্মুল মুমিনিন হজরত হাফসা (রা.) বলেন, রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম চারটি কাজ কখনো পরিত্যাগ করেননি। আশুরার রোজা, জিলহজের প্রথম দশকের রোজা, আইয়ামে বিদের রোজা তথা প্রতি মাসের ১৩, ১৪, ১৫ তারিখের রোজা এবং ফজর ওয়াক্তে ফরজের আগে দুই রাকাত সুন্নাত নামাজ।
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আশুরার দিনে পরিবারের ব্যয় বৃদ্ধি করবে, ভালো খাওয়াদাওয়ার আয়োজন করবে; আল্লাহ সারা বছর তার প্রাচুর্য বাড়িয়ে দেবেন।’ হজরত সুফিয়ান ছাওরি তাবিয়ি (রহ.) বলেন, ‘আমরা এটি পরীক্ষা করেছি এবং যথার্থতা পেয়েছি।’ (মিশকাত: ১৭০; ফয়জুল কালাম: ৫০১, পৃষ্ঠা ৩৪৯; বায়হাকি ও রাজিন)।
এ হাদিসের বর্ণনা সূত্রে দুর্বলতা আছে। তবে ইবনে হিব্বানের মতে, এটি ‘হাসান’ পর্যায়ের হাদিস। ইবনে তাইমিয়া (রহ.)-এর দাবি হলো, রিজিকে প্রশস্ততার ব্যাপারে কোনো হাদিস নেই। এটি ধারণাপ্রসূত। ইমাম আহমদ (রহ.) বলেছেন, এটি বিশুদ্ধ হাদিস নয়। অর্থাৎ সত্তাগতভাবে এটি বিশুদ্ধ হাদিস নয়। তবে এ বিষয়ে একাধিক বর্ণনা থাকার কারণে ‘হাসান’ হওয়া অস্বীকার করা যাবে না। আর ‘হাসান লিগাইরিহি’ দ্বারা দলিল দেওয়া যায়। (আস সওয়াইকুল মুহরিকা আলা আহলির রফযি ওয়াদ দালাল ওয়াযযানদিকা,খণ্ড-২,পৃ.৫৩৬)
আশুরার নামাজ কয় রাকাত
আশুরার দিনে বিশেষ কোনো নামাজ নাই ৷ রোজা আছে ৷ রোজার অনেক ফজিলতের কথা আছে ৷ তবে সহীহ সনদে সালাতের কথা আসেনি ৷ কেউ কেউ আশুরার নামাজ আবিষ্কার করেছেন ৷ আশুরার দিন এভাবে নামাজ পড়বে—জোহর ও আসরের মাঝখানে চার রাকাত নামাজ পড়বে। প্রত্যেক রাকাতে সুরায়ে ফাতিহা ও ১০ বার আয়াতুল কুরসি পড়বে, ১১ বার সুরা ইখলাস পড়বে, পাঁচবার সুরা নাস ও ফালাক পড়বে। যখন সালাম ফিরাবে, ৭০ বার আসতাগফিরুল্লাহ বলবে। (মুজামুল বিদাঈ, পৃ. ৩৪১)
এভাবে অনেকেই আশুরার দিন নামাজ পড়ার বিভিন্ন পদ্ধতি ও ফজিলত বর্ণনা করেন। এগুলো বানোয়াট কথা ও ভ্রান্ত বিশ্বাস। শিয়া সম্প্রদায় এগুলো রচনা করেছে। এসবের কোনো ভিত্তি নাই ৷
মহররম মাস সম্পর্কে ভুল ধারণা
মহররম মাস সম্পর্কে সাধারণে কিছু ভুল ধারণা রয়েছে। যেমন এই মাসে
১ ৷ বিয়েশাদি না করা,
২ ৷ নতুন ঘরবাড়ি নির্মাণ না করা,
৩ ৷ কোনো শুভ কাজ বা ভালো কাজের সূচনা না করা,
৪ ৷ গোশত না খাওয়া ও নিরামিষ আহার করা,
৫ ৷ পান না খাওয়া,
৬ ৷ নতুন কাপড় ও সুন্দর পোশাক পরিধান না করা,
৭ ৷ সাদা কাপড় বা কালো কাপড় তথা শোকের পোশাক পরা,
৮ ৷ সব ধরনের আনন্দ উৎসব পরিহার করা ইত্যাদি।
এসবই কুসংস্কার। কোরআন ও হাদিসে এসবের কোনো ভিত্তি নেই। ইবাদত ও ইসলামি পর্বসমূহ কোরআন-সুন্নাহর ভিত্তিতে পালন করা বিধেয়, দলিল–প্রমাণহীন আমলে সুফল আশা করা যায় না। বরং এতে বহুবিধ ক্ষতির আশঙ্কা বিদ্যমান রয়েছে।
আশুরার দিন কি শোকের দিন?
শিয়ারা আশুরার দিনকে শোকের দিন হিসেবে পালন করে। এটি বনি উমাইয়ার প্রতি বিদ্বেষের কারণে। এটি হুসাইন রাঃ -এর প্রতি মোহাব্বত বা শোকের কারণে নয়। কেননা হজরত আলী (রা.) হুসাইন (রা.)-এর পিতা ছিলেন। পিতা অবশ্যই পুত্র থেকে উত্তম। আলী (রা.)-কেও অন্যায়ভাবে হত্যা করা হয়েছে। অথচ তাঁর মৃত্যুর দিনকে শোকের দিন হিসেবে পালন করা হয় না। হুসাইন ও আলী (রা.)-এর চেয়ে উত্তম ওসমান (রা.)-কেও অন্যায়ভাবে হত্যা করা হয়েছে। তাঁর শাহাদাতের দিনকেও শোকের দিন পালন করা হয় না। তাঁদের চেয়ে উত্তম হজরত ওমর (রা.)। তাঁর শহীদ হওয়ার দিনকে তো তারা শোকের দিন হিসেবে পালন করে না।
অনেকেই না বুঝে অথবা ভ্রান্ত প্ররোচনায় পড়ে আশুরার ঐতিহ্য বলতে রাসুল (সা.)-এর প্রিয়তম দৌহিত্র, জান্নাতের যুবকদের দলপতি হযরত হুসাইন (রা.)-এর শাহাদাত ও নবী পরিবারের কয়েকজন সম্মানিত সদস্যের রক্তে রঞ্জিত কারবালার ইতিহাসকেই বুঝে থাকে। তাদের অবস্থা ও কার্যাদি অবলোকন করে মনে হয়, কারবালার ইতিহাসকে ঘিরেই আশুরার সব ঐতিহ্য, এতেই রয়েছে আশুরার সব রহস্য।
আশুরার হাদিসের আলোকে প্রতীয়মান হয়, আসলে বাস্তবতা কিন্তু এর সম্পূর্ণ বিপরীত। বরং আশুরার ঐতিহ্যের স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে প্রাচীনকাল থেকেই। হযরত হুসাইন (রা.)-এর মর্মান্তিক শাহাদাতের ঘটনার অনেক আগ থেকেই আশুরা অনেক তাৎপর্যপূর্ণ ও রহস্যঘেরা দিন। কারণ কারবালার যুদ্ধ সংঘটিত হয় ৬১ হিজরির ১০ মহররম।
আর আশুরার রোজার প্রচলন চলে আসছে ইসলাম আবির্ভাবেরও বহুকাল আগ থেকে। তবে এ কথা অনস্বীকার্য যে আবহমানকাল থেকে আশুরার দিনে সংঘটিত বিভিন্ন ঘটনা যেমন অপরিসীম গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি হিজরি ৬১ সনে আশুরার দিন কারবালার ময়দানের দুঃখজনক ঘটনাও মুসলিম জাতির জন্য অতিশয় হৃদয়বিদারক ও বেদনাদায়ক।
প্রতিবছর আশুরা আমাদের এই দুঃখজনক ঘটনাই স্মরণ করিয়ে দেয়। তবে এও বাস্তব যে এ ঘটনাকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে না পেরে আজ অনেকেই ভ্রষ্টতা ও কুসংস্কারের অন্ধকারে নিমজ্জিত। যারা কারবালার মর্মান্তিক ঘটনাকে ব্যথাভরা অন্তরে স্মরণ করে থাকেন, তারা কোনো দিনও চিন্তা করেছেন যে কী কারণে হজরত হুসাইন (রা.) কারবালার ময়দানে অকাতরে নিজের মূল্যবান জীবন বিলিয়ে দিয়েছিলেন। তাই তো অনেকেই মনে করেন যে জারি মর্সিয়া পালনের মধ্যেই কারবালার তাৎপর্য! হায়রে আফসোস! কী করা উচিত! আর আমরা করছি কী?
হযরত হুসাইন (রা.)-এর উদ্দেশ্য ও আদর্শ বাস্তব জীবনে অনুসরণ করাই হবে এ ঘটনার সঠিক মর্ম অনুধাবনের বহিঃপ্রকাশ। হযরত হুসাইন (রা.)-ও রাসুলে করিম (সা.)-এর প্রতি মুহব্বত ও আন্তরিকতার একমাত্র পরিচায়ক।
কারবালার প্রকৃত ইতিহাস কী?
ইসলামে আশুরা অর্থাৎ ১০ই মুহররমের যে মর্যাদা তার সাথে কারবালায় হুসাইন (রা.) এর শাহাদাত কিংবা অপরাপর কোনও ঘটনার দূরতম কোনও সম্পর্ক নেই। দু’টি ব্যাপার সম্পূর্ণ আলাদা। তবে এ কথা সত্য যে, এই উম্মতের উপর নানাবিধ কারণে কারবালার একটা সুদূরপ্রসারী প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।
এর কারণ হুসাইন (রা.) রাসুলের নাতি হবার সুবাদে উম্মতের তাঁর প্রতি বিদ্যমান ভালোবাসা। এর বাইরে ইসলামের দৃষ্টিতে হুসাইন (রা.) অন্যায় হত্যার শিকার হওয়া কিংবা আপনার বা আমার অন্যায় হত্যার শিকার হওয়ায় কোনও তফাৎ নাই। কোরআনে সূরা মায়িদায় আল্লাহ যে কোনো অন্যায় হত্যাকে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ হিসেবে সাব্যস্ত করেছেন।
আদতে মৌলিকভাবে কারবালার ঘটনায় দু’টি বড়ো প্রশ্নের মুখোমুখি আমরা সকলেই হই। প্রথমত হুসাইন (রা.) এর ইয়াজিদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের প্রসঙ্গ এবং দ্বিতীয়ত ইয়াজিদের ব্যাপারে আমাদের মনোভাব কি হবে।
ইসলামী রাষ্ট্রনীতি অনুযায়ী, একজন খলিফা মৃত্যুর পূর্বে কাউকে নিজের পদের উত্তরসূরী হিসেবে মনোনয়ন দান করার অধিকার রাখেন- কিন্তু এই মনোয়ন তাঁর মৃত্যুর পর সেই ব্যাক্তিকে খেলাফতের জন্য কেবলমাত্র করা একটা প্রস্তাব এবং পরামর্শ হিসেবে বিবেচিত হয়।
যতক্ষণ না পর্যন্ত উম্মতের বেশিরভাগ অগ্রগণ্য, মান্য, প্রভাবশালী ও জ্ঞানী দায়িত্বশীল ব্যাক্তিবর্গ তাঁর আনুগত্য মেনে নিচ্ছেন ততক্ষণ পর্যন্ত সেই ব্যক্তি খলিফা নন।
ইসলামী রাষ্ট্রনীতিতে আপনাপনি (By Default) কারো রাষ্ট্র নেতা হবার সুযোগ নাই। কেবলমাত্র তখনই তিনি রাষ্ট্রনেতা হবার অধিকার রাখেন, যখন অধিকাংশ দায়িত্বশীল তাঁর নেতৃত্বের প্রতি আনুগত্য পোষণ করে। ইয়াজিদের নেতৃত্ব সিরিয়াবাসী মেনে নিয়েছিলেন।
কিন্তু হিজাজবাসীরা (মক্কা, মদিনা, তাবুকসহ তৎসংলগ্ন অঞ্চল) ইয়াজিদের নেতৃত্ব মেনে নেয় নি। অপরদিকে ইরাকবাসীরা পত্র ও প্রতিনিধির বরাতে বার বার ঘোষণা করছিল তাঁরা হুসাইন (রা.) ব্যতীত অন্য কারো নেতৃত্ব মেনে নেবে না।
আর হুসাইন (রা.) নিজেও ইয়াজিদের নেতৃত্বের প্রতি অনাস্থা জানিয়েছিলেন। কারণ ইয়াজিদ ছিল কঠোর চরিত্রের এবং দমনপ্রবণ। তাই হুসাইন (রা.) আশঙ্কা করছিলেন, যদি ইয়াজিদ তামাম উম্মতের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হয়, তখন তিনিও তাঁর অনুগত থাকতে বাধ্য হবেন ৷ আর ইয়াজিদের কঠোরতার দরুণ উম্মত জুলুমের শিকার হতে পারে। ফলে তিনি চেয়েছিলেন, ইয়াজিদ উম্মতের অধিকাংশের আনুগত্য আদায়ের পূর্বেই ইয়াজিদকে নিরস্ত্র করতে। ফলত ইরাকবাসীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে তিনি কুফার পথে রওয়ানা করেন। কিন্তু কুফার কাছাকাছি পৌঁছে তিনি বুঝতে পারেন, ইরাকবাসীরা তাঁর সঙ্গে প্রতারণা করেছে।
তিনি এও বুঝতে পারেন ইরাকবাসীরা ইয়াজিদের আনুগত্য মেনে নিয়েছে। ফলে তিনি সন্ধির প্রস্তাব রাখেন। সে সব প্রস্তাবের মাঝে এও ছিল যে, তিনি ইয়াজিদের আনুগত্য মেনে নিতে সম্মত আছেন।
কিন্তু ইরাকের প্রাদেশিক সরকারের প্রধান উবায়দুল্লাহ বিন জিয়াদ হুসাইন (রা.) এঁর কোনও প্রকার বক্তব্য শুনতে সম্মত ছিলেন না। তিনি ছিলেন রূঢ় স্বভাবের। তিনি নির্দেশ দিয়েছিলেন, বিনাশর্তে হুসাইন (রা.)কে তার সামনে উপস্থিত করতে।
কিন্তু সন্ধিবিহীন ও শর্তহীনভাবে সাক্ষাত নিজেকে মৃত্যুর কাছে সমর্পণেরই নামান্তর ছিল। সুতরাং তার কাছে উবায়দুল্লাহ বিন জিয়াদের সৈন্য দলের সাথে লড়াইবিহীন কোনও বিকল্প ছিল না। আর এভাবেই কারবালার সেই দুর্ভাগ্যজনক ঘটনার জন্ম হয়েছে।
হুসাইন (রা.) এর শাহাদাতের ঘটনায় ইয়াজিদের সম্পৃক্ততা বিষয়ে এবার আসা যাক। এ ব্যাপারে বহুধা বিভক্ত বর্ণনা পাওয়া যায়। আর ইতিহাস তার স্বভাবসুলভ রীতিতেই ত্রুটিপূর্ণ ও ভুল বর্ণনা থেকে মুক্ত নয়।
তবে যাই হোক, ইয়াজিদ ইবনে মোয়াবিয়ার ব্যাপারে এই উম্মত প্রধানত ৩টি ভাগে বিভক্ত :
১. যারা ইয়াজিদকে সত্য ও ন্যায়ের মাপকাঠিতে চূড়ান্ত উত্তীর্ণ মনে করেন। তারা ইয়াজিদের প্রতি ভালোবাসা পোষণ করেন। এরা নাওয়াসিবি হিসেবে চিহ্নিত। এরা সিরিয়ার একটা অংশের।
২. যারা ইয়াজিদকে মুরতাদ মনে করে। অভিসম্পাত করে। প্রবলভাবে ঘৃণা করে। এরা শিয়া সম্প্রদায়। তারা ইয়াজিদকে হুসাইন (রা.) এর হত্যা এবং নবী বংশধারা ধ্বংসের ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে মনে করে।
৩. এরা হচ্ছে আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামা’আত। উম্মতের সেই হক্বপন্থীদল যারা মধ্যমপন্থার উপর প্রতিষ্ঠিত। তারা না ইয়াজিদের ব্যাপারে ভালোবাসা পোষণ করেন না শত্রুতা। বরং তারা এ ব্যাপারে চুপ থাকেন।
যেমন আবু আব্দুল্লাহ ইবনে তাইমিয়া বলেন, আমরা ইয়াজিদের ভালোগুণ অস্বীকার করি না আবার তা অতিরঞ্জিতও করি না।
আর ইমাম গাজ্জালি (র.) বলেন, ‘যেহেতু কোনও মুসলমানের পক্ষে যথাযথ প্রমাণবিহীন কাউকে হত্যাকারী বলা হারাম, তাই ইয়াজিদকে হুসাইন (রা.) এঁর হত্যাকারী কিংবা হত্যার নির্দেশ প্রদানকারী হিসেবে বলা জায়েজ নয়।’
যেহেতু ইয়াজিদের হুসাইন (রা.) এর হত্যা প্রসঙ্গে সম্পৃক্ততার অকাট্য প্রমাণ পাওয়া যায় না, সুতরাং আমাদের উচিত হবে এ ব্যাপারে নীরব থাকা।
ইয়াজিদের ব্যাপারে যত মিথ্যে গল্প প্রচলিত আছে, সম্ভবত আর কারো ব্যাপারে এত মিথ্যে আরোপ করা হয় নি। তার ব্যাপারে মদ্যপান, সমকামিতার যে অপবাদ আছে তা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন ও মিথ্যা। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, তিনি যাবতীয় অন্যায় থেকে মুক্ত ছিলেন।
এ কথা ঠিক, তার দ্বারা ঘটিত জুলুমের ইতিহাসও বিদ্যমান আছে। সুতরাং সে যা মন্দ করেছে তার ফায়সালা আল্লাহ্র। তবে এ কথা অনস্বীকার্য যে, উমাইয়া এবং আব্বাসীয় এই দুই আমলেই তার মত স্বভাবের বহু খলিফা ছিলেন এবং তারচে মন্দও অনেকে ছিলেন। অন্যদিকে হুসাইন (রা.) এর আদর্শ ছিল উম্মতের কল্যাণকামীতা এবং উম্মতকে জুলুমের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য ত্যাগের শিক্ষা। সেই শিক্ষাটুকু ধারণ করলেই এই উম্মত এখনও বদলে যেতে পারে।
আমাদের মনে রাখা উচিত, ইতিহাসের বইয়ে যা লেখা থাকে তার সব সত্য নয়। আর তাছাড়া, একটা বিশেষ গোষ্ঠী কারবালার ইতিহাস বিকৃত করে উপস্থাপন করছে। অতীতের বহু বিজ্ঞ আলেমগণ কারবালা কিংবা তৎসংক্রান্ত ঘটনা নিয়ে বিতর্কে না জড়াতে পরামর্শ দিয়েছেন। আমাদের বাড়াবাড়ির পথ পরিহার করা উচিত।
আপনার জন্য আরো কিছু গুরুত্বপুর্ণ লেখা
দোয়া কুনুত বাংলা উচ্চারণ ও অর্থ
নামাজের গুরুত্ব ও ফজিলত
সব নামাজ পড়ার নিয়ম ও নিয়ত বাংলায়
দোয়া মাসুরা বাংলা উচ্চারণ
আয়াতুল কুরসি বাংলা উচ্চারণ ও অর্থ
ইস্তেখারা নামাজের দোয়া ফজিলত
সেরা ইসলামীক উক্তি
অভিশাপ থেকে মুক্তির দোয়া
লেখকঃ
হাফেজ মাওলানা দীদার মাহদী
ভাইস প্রিন্সিপ্যাল, দারুলহুদা মডেল মাদরাসা
কোদালপুর, গোসাইরহাট, শরীয়তপুর ৷
আশুরা আশুরা আশুরা আশুরা আশুরা আশুরা আশুরা আশুরা আশুরা