ফজর নামাজের গুরুত্ব
আল্লাহর সৃষ্টি মানুষ ৷ এই মানুষ ধর্মভেদে আবার হরেক প্রকার ৷ আল্লাহর মনোনীত ধর্ম ইসলামের অনুসারীরা দিনের শুরু থেকেই ব্যতিক্রম
৷ আলাদা ৷ একজন মুসলিম সূর্যের আলো না পড়তেই উঠে পড়ে ৷ বিছানা ত্যাগ করে ৷ ওজু বানিয়ে রবের জন্য সিজদাবনত হয় ৷
সে তার এ কাজটির মাধ্যমে অন্য সব ভ্রান্ত ধর্মবিশ্বাসীদের থেকে নিজেকে আলাদা করে নিলো ৷ পার্থক্য সূচিত হলো মুসলিম আর অমুসলিমে ৷
কিন্তু নামধারী কিছু মুসলিম আছে সমাজে ৷ যারা অন্যসব অমুসলিমদের মতোই ঘুমিয়ে কাজা করছে ফজর ৷ তাদের সাথে আর অমুসলিমদের সাথে ডিফারেন্ট থাকে না ৷ এজন্যই বিশ্বনবী বলেছেন, ‘যে ব্যাক্তি ইচ্ছাকৃত এক ওয়াক্ সালাত ছেড়ে দিলো, সে কুফরি করলো’ ৷ (নাউজুবিল্লাহ)
ফজর সালাত সম্পর্কে আয়াত
اَقِمِ الصَّلٰوۃَ لِدُلُوۡکِ الشَّمۡسِ اِلٰی غَسَقِ الَّیۡلِ وَ قُرۡاٰنَ الۡفَجۡرِ ؕ اِنَّ قُرۡاٰنَ الۡفَجۡرِ کَانَ مَشۡہُوۡدًا ﴿۷۸﴾
‘সূর্য হেলে পড়ার সময় থেকে রাতের অন্ধকার পর্যন্ত সালাত কায়েম কর এবং ফজরের কুরআন*। নিশ্চয় ফজরের কুরআন (ফেরেশতাদের) উপস্থিতির সময়’ ৷
*‘ফজরের কুরআন’ দ্বারা উদ্দেশ্য ফজরের সালাত।
নামাজ কায়েম করো সূর্য ঢলে পড়ার পর থেকে রাতের অন্ধকার পর্যন্ত এবং কায়েম করো ফজরের নামাজ। নিশ্চয়ই ফজরের নামাজ উপস্থিতির সময়। [সুরা : বনি ইসরাঈল, আয়াত : ৭৮ ]
ফজরের নামাজের সময়, ফজরের নামাজের শেষ সময়
আল্লাহ কুরআনে আরো বলছেন,
وَأَقِمِ الصَّلٰوةَ طَرَفَيِ النَّهَارِ وَزُلَفًا مِّنَ اللَّيْلِ ط إِنَّ الْحَسَنٰتِ يُذْهِبْنَ السَّيِّاٰتِ ط ذٰلِكَ ذِكْرٰي لِلذّٰكِرِيْنَ
“তুমি সালাত কায়েম কর দিবসের দু’ প্রান্তে রজনীর কিছু অংশ অতিবাহিত হওয়ার পর। সৎকর্ম অবশ্যই অসৎকর্ম মিটিয়ে দেয়। উপদেশ গ্রহণকারীদের জন্য এটা এক উপদেশ।” (সূরা হূদ ১১:১১৪)
এভাবে আল্লাহ তা‘আলা অত্র আয়াতে পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের সময়সীমা বর্ণনা করেছেন এবং বিশেষ করে ফজরের কথা উল্লেখ করেছেন। কেননা এ সময় ফেরেশতাগণ উপস্থিত হন।
হাদীসে এসেছে, আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, একাকী সালাত আদায় করার চেয়ে জামা‘আতে সালাত আদায় করার মর্যাদা পঁচিশ গুণ বেশি। আর ফজরের সালাতের সময় দিনের ও রাতের ফেরেশতারা একত্রিত হয়। তোমরা ইচ্ছা করলে এ আয়াতটি তেলাওয়াত করতে পারে। [সহীহ বুখারী: ৪৭১৭, সহীহ মুসলিম: ৬৪৯]
ফজর শব্দের অর্থ
ফজর শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে, ভোর হওয়া বা প্রভাতের উদয় হওয়া অর্থাৎ একেবারে সেই প্রথম লগ্নটি যখন প্রভাতের শুভ্রতা রাতের আঁধার চিরে উঁকি দিতে থাকে।
ফজরের কুরআন পাঠ মানে হচ্ছে, ফজরের নামায, কুরআন মজীদে নামায প্রতিশব্দ হিসেবে কোথাও ‘সালাত’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে আবার কোথাও বিভিন্ন অংশের মধ্য থেকে কোন একটির নাম নিয়ে সমগ্র নামাযটি ধরা হয়েছে।
যেমন তাসবীহ, যিকির, হামদ (প্রশংসা) কিয়াম (দাঁড়ানো) রুকূ’ সিজদাহ ইত্যাদি। অনুরূপভাবে এখানে ফজরের সময় কুরআন পড়ার মানে শুধু কুরআন পাঠ করা নয় বরং নামাযে কুরআন পাঠ করা।
এভাবে নামাযের উপাদান ও অংশ কি ধরনের হতে হবে কুরআন মজীদ সেদিকে পরোক্ষ ইঙ্গিত দিয়েছে।
আর এ ইঙ্গিতের আলোকে নবী ﷺ নামাযের কাঠামো নির্মাণ করেন। বর্তমানে মুসলমানদের মধ্যে নামাযের এ কাঠামোই প্রচলিত।
ফজরের কুরআন পরিলক্ষিত হওয়ার মানে হচ্ছে, আল্লাহর ফেরেশতারা এর সাক্ষী হয়।
হাদীসে সুস্পষ্ট একথা বর্ণনা করা হয়েছে যদিও ফেরেশতারা প্রত্যেক নামায ও প্রত্যেক সৎকাজের সাক্ষী তবুও যখন ফজরের নামাযের কুরআন পাঠে তাদের সাক্ষ্যের কথা বলা হয়েছে তখন এ থেকে পরিষ্কার বুঝা যাচ্ছে যে, এ কাজটি একটি বিশেষ গুরুত্বের অধিকারী।
এ কারণেই নবী ﷺ ফজরের নামাযে দীর্ঘ আয়াত ও সূরা পড়ার পদ্ধতি অবলম্বন করেন। সাহাবায়ে কেরামও তাঁর এ পদ্ধতি অনুসরণ করেন এবং পরবর্তী ইমামগণ একে মুস্তাহাব গণ্য করেন।
ফজরের নামাজের গুরুত্ব অত্যাধিক
নামাজের মধ্যে যেমন ফজরের রয়েছে বিশেষ গুরুত্ব, তেমনি সময়ের মধ্যে ফজরের সময়ের রয়েছে বিশেষ গুরুত্ব।
পবিত্র কোরআনে ‘ফজর’ নামে একটি সুরাও রয়েছে। ওই সুরার শুরুতে মহান আল্লাহ ইরশাদ করেছেন, ‘শপথ ফজরের।’ (সুরা : ফজর, আয়াত : ১)
হাদিসে ফজরের নামাজের বিশেষ তাগিদ রয়েছে। জুনদুব ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, মহানবী (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি ফজরের নামাজ পড়বে, সে আল্লাহর জিম্মায় থাকবে…। (মুসলিম, হাদিস : ৬৫৭)
অন্য হাদিসে ফজরের নামাজ আদায়কারীকে জান্নাতি মানুষ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। আবু মুসা আশয়ারি (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি দুটি শীতল সময়ে নামাজ আদায় করবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।’ (বুখারি ও মুসলিম)
আর এটা স্বতঃসিদ্ধ যে ফজরের নামাজ রাতের সবচেয়ে শীতল অংশে এবং আসরের নামাজ মৃদুমন্দ ঠাণ্ডা পড়ার পর দিনের সবচেয়ে শীতল অংশে আদায় করা হয়।
আলোচ্য আয়াতের শেষাংশে ফজরের জন্য একটি গুণবাচক শব্দ আনা হয়েছে। সেটি হলো ‘মাশহুদ’।
এর অর্থ উপস্থিত হওয়া। হাদিসের বর্ণনা অনুযায়ী, এ সময় দিন-রাতের উভয় দল ফেরেশতা দুনিয়ায় মিলিত হয়।
তাই একে ‘মাশহুদ’ বলা হয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘রাতের ফেরেশতা ও দিনের ফেরেশতারা ফজরের সময় উপস্থিত হয়।’ (তিরমিজি, হাদিস : ৩১৩৫)
অন্য হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘জামাতের নামাজের ফজিলত একাকী নামাজের চেয়ে ২৫ গুণ বেশি।
রাতের ফেরেশতা ও দিনের ফেরেশতারা ফজরের নামাজে একত্র হয়ে থাকে।’ (বুখারি, হাদিস : ৬৪৮, মুসলিম, হাদিস : ৬৪৯)
ফজরের নামাজ কয় রাকাত ?
ফজরের নামাজ ৪ রাকাত ৷ দু রাকাত সুন্নাত ৷ যা একাকী পড়তে হয় ৷ আর দু রাকাত ফরজ ৷ যা দলবদ্ধভাবে জামায়াতের সাথে পড়া ওয়াজিব ৷
ফজরের নামাজ পড়ার নিয়ম ও নিয়ত
নামাজের বাহিরের সাত ফরজ আদায় করে পাক-পবিত্র হয়ে জায়নামাজে দাঁড়াতে হবে। জানা থাকলে এই দুআটি পড়তে হবে ৷ এটা জরুরি নয় ৷ জায়নামাজের দোয়া নামে পরিচিত ৷
ইন্নি ওয়াজ্জাহতু ওয়াজহিয়া লিল্লাজি ফাতারাসসামাওয়াতি ওয়াল আরদ্বা হানিফাও ওয়ামা আনা মিনাল মুশরিকিন।
তারপর নিয়ত করতে হবে ৷ আরবি নিয়ত পারলে পড়বে ৷ সেটা জরুরি নয় ৷ মুস্তাহাব ৷ বাংলা উচ্চারণ (নাওয়াইতু আন উসাল্লিয়া লিল্লাহিতায়ালা রাকাতাই সালাতি ফাজরি ফারদুল্লাহি তায়ালা ‘’ইমামের পিছনে পড়লে’ ইকতা দাইতু বিহাজাল ইমাম অথবা ইমামতি করলে আনা ইমামু লিমান হাদ্বারা উয়ামাইন ইয়াহদুরু’’ মুতাওয়াজ্জিহান ইলা জিহাতিল ক্বাবাতিশ শারিফাতি আল্লাহু আকবার)বলে কান পর্যন্ত হাত উঠিয়ে বাধতে হবে।
⇄ দুই হাত কান বরাবর এভাবে নিবে যাতে হাতের তালু দুইটি কাবার দিকে থাকে ৷ এরপর সানা পড়তে হবে ৷ (সুবহানাকা আল্লাহুম্মা বিহামদিকা উতাওয়া রাকাসমুকা উয়াতায়ালা জাদ্দুকা উয়ালা ইলাহা গাইরুক)।
⇄তারপর সুরা ফাতিহা পড়ে সাথে যে কোন একটি সূরা পড়তে হবে।
⇄তারপর আল্লাহু আকবার বলে রুকুতে যেতে হবে। রুকুতে গিয়ে পড়তে হবে { সুবহানা রাব্বিয়াল আযিম (৩ বার উত্তম, বেশি পড়লে ভাল)}
⇄সামিয়াল্লাহুলিমান হামিদা বলে রুকু থেকে উঠতে হবে। আবার আল্লহু আকবার বলে সিজদায় যেতে হবে। (সিজদার নিয়ম হচ্ছে প্রথমে পায়ের পাতা থেকে কোমর পর্যন্ত সোজা রেখে দেহটাকে নিচের দিকে ঝুঁকিয়ে পরবর্তিতে হাঁটু ঝুঁকিয়ে প্রথমে নাক পরে কপাল মাঠিতে লাগানো) সিজদায় গিয়ে পড়তে হবে (সুবহানা রাব্বিয়াল আলা ৷ ঠিক আগের মতো ৷ ৩বার উত্তম ৷ বেশি পড়লে ভাল)। আল্লাহু আকবার বলে সিজদাহ থেকে সোজা হয়ে বসতে হবে ৷ অবস্থায় তার পর আবার সিজদায় যেতে হবে। আগের মতোই বলতে হবে। তারপর আল্লাহু আকবার বলে দাঁড়িয়ে যেতে হবে।
ফজরের দ্বিতীয় রাকাতের নিয়ম
⇄প্রথম রাকাতের মতোই দ্বিতীয় রাকাত পড়তে হবে ৷
দুই সিজদা শেষ হলে বসে যেতে হবে ৷ বসে তাশাহহুদ পড়তে হবে (আত্তাহিয়াতু লিল্লাহি ওয়াসসালাওয়াতু ওয়াত্তাইয়িবাতি আসসালামু আলাইকা আইয়ু হান্নাবিয়ু ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু ৷
আসসালামু আলাইনা আলা ইবাদিল্লাহিস সুয়ালিহিন, আশহাদু আল্লাহ ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মাদান আবদুহু ওয়া রাসুলুহু ) প্রতিয়মান আসহাদু আল্লআহ ইলাহা বলে শাহাদাত আঙ্গুলি উপরের দিকে ধাবমান করতে হবে।
⇄ তারপর দরূদ শরিফ পড়তে হবে ৷ (আল্লাহুম্মা সাল্লিয়ালা মুহাম্মাদিউ উয়ালা আলি মুহাম্মাদ কামা সাল্লাইতা আলা ইব্রাহিমা উয়ালা আলি ইব্রাহিম ইন্নাকা হামিদুম্মাজিদ)(আল্লাহুম্ম বারিক আলা মুহাম্মাদিউ উয়ালা আলি মুহাম্মাদ কামা বারাক তা আলা ইব্রাহিমা উয়ালা আলি ইব্রাহিম ইন্নাকা হামিদুম্মাজিদ)
⇄ এরপর দুআয় মাসূরা পড়বে ৷ (আল্লাহুম্মা ইন্নি জালামতু নাফসি জুলমান কাছিরা উয়ালা ইয়াগফিরু জুনুবা ইল্লা আনতা ফাগফিরিলি মাগফিরাতাম মিন হিমদিকা উয়ার হামনি ইন্নাকা আনতাল গাফুরুররাহিম) বলে সালাম ফিরাতে হবে। প্রথমে আসসালামুয়ালাইকুম উয়া রাহমাতুল্লাহ বলে ডান দিকে পরে বাম দিকে মস্তক ঘুরাতে হবে ।
ফজরের কাজা নামাজ আদায় করার নিয়ম
অনিচ্ছাকৃত, ভুলবশত কিংবা অন্য কোনো কারণে কোনো ওয়াক্তের নামাজ আদায় করতে না পারলে ঐ নামাজ পরবর্তীতে আদায় করাকে কাজা নামাজ বলা হয়।
ফরজ অথবা ওয়াজিব নামাজ ছুটে গেলে তার কাজা আদায় করা আবশ্যক কিন্তু সুন্নত কিংবা নফল নামাজ আদায় করা না গেলে কাজা আদায় করতে হবে না। ফরজ নামাজ ছুটে গেলে তা ‘কাজা’ করা ফরজ আবার ওয়াজিব নামাজ ছুটে গেলেও তা ‘কাজা’ করা ওয়াজিব।
নামাজ ছেড়ে দেয়া অনুচিত ৷ ঘটনাচক্রে ছুটে গেলে তা আদায় করা জরুরি ৷ কারো ফজরের নামাজ ছুটে গেলে তা আদায় করার নিয়ম নিম্নরূপ ৷
ফজরে টের না পেলে যখনই সে জাগ্রত হবে তখনই ফজর সালাত আদায় করবে ৷
আর জোহরের আগে ফজর কাজা করলে সুন্নতসহ পড়বে ৷
কাজা আর আদা নামাজের নিয়ম একই ৷ শুধু নিয়তের ক্ষেত্রে একটু ব্যতিক্রম ৷ মনে মনে কাজার নিয়ত করলেই হবে ৷
ফজরের কাজা নামাজের নিয়ত
আমি কিবলামুখী হয়ে আল্লাহর উদ্দেশ্যে ফজরের ফরজ দুই রাকাত কাযা নামাজ আদায় করছি, আল্লাহু আকবার।
লেখকঃ
হাফেজ মাওলানা দীদার মাহদী
ভাইস প্রিন্সিপ্যাল,
দারুলহুদা মডেল মাদরাসা
কোদালপুর, গোসাইরহাট, শরীয়তপুর ৷