রমজানে করণীয় ও বর্জণীয়
সুপ্রিয় পাঠকবৃন্দ । মহান আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি ও সান্নিধ্য অর্জনের মাস রমজান। রাসুলে আরাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র জবানে উচ্চারিত হয়েছে-
শাবান আমার মাস আর রমজান আল্লাহর মাস । হাদীসে রমজান মাসকে আল্লাহর দিকে সম্বন্ধিত করায় এ মাসের মর্যাদা বৃদ্ধি পেয়েছে । ব্যতিক্রম ও অনন্য হয়েছে অন্য ১১টি মাস থেকে । সুতরাং নিশ্চিত করে এ কথা বলা যায় ক্ষমা লাভের স্পেশাল মাস রমজান। রহমত , বরকত ও নাজাতের বসন্তকাল হচ্ছে রমজান ।
এ মাসে প্রত্যেকটি মুসলমানের অনেক করণীয় ও বর্জনীয় আছে । কিন্তু জ্ঞানের অভাবে অনেকেই সেগুলো সঠিকভাবে আঞ্জাম দিতে পারেনা । করে বসে অনেক রকম ভুল । ইবাদাত হয় না কবুল । তাই সেগুলোকে জানান দিতেই আজকের এই বিশেষ আয়োজন । রমজানের করনীয় ও বর্জনীয় শীর্ষক আলোচনাটি বিস্তারিত লিখেছেন তরুণ আলেম মাওলানা শরিফ আহমাদ । পাঠ শেষে উপকৃত হবেন বলে আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস । – সম্পাদক ।
পবিত্র রমজান মাসে আমাদের অনেক করণীয় ও বর্জনীয় আছে । সংক্ষিপ্তভাবে উল্লেখ করছি ।
রোজা রাখা ।
রোজা মূলত একটি ফারসী শব্দ । আরবীতে হচ্ছে صوم বা صيام । সাওম অর্থ হলো বিরত থাকা, দূরে থাকা ,আত্মসংযম ইত্যাদি । পরিভাষায় সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত নিয়তের সাথে পানাহার ও সকল প্রকার যৌন সম্ভোগ থেকে বিরত থাকাকে সাওম বলা হয় । নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হিজরতের ১৮ মাস পর কিবলা পরিবর্তনের পরে শাবান মাসে রমজানের রোজা ফরজ হবার নির্দেশ সম্বলিত আয়াত নাযিল হয়-
یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا کُتِبَ عَلَیۡکُمُ الصِّیَامُ کَمَا کُتِبَ عَلَی الَّذِیۡنَ مِنۡ
قَبۡلِکُمۡ لَعَلَّکُمۡ تَتَّقُوۡنَ ۙ
অনুবাদ: হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর রোজা ফরয করা হয়েছে, যেরূপ ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের উপর, যেন তোমরা পরহেযগারী অর্জন করতে পার। (আল বাকারা – ১৮৩)
হযরত আবু হুরায়রা রাদিআল্লাহু তাআলা আনহু থেকে বর্ণিত । তিনি বলেন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ যে সকল লোক রমজান মাসের রোজা রাখবে ঈমান ও চেতনা সহকারে তার পূর্ববর্তী সকল গোনাহ মাফ হয়ে যাবে । ( সহীহ বুখারী,৩৭ সহীহ মুসলিম,১২৬৮ )
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রাদিআল্লাহু তাআলা আনহু থেকে বর্ণনা । রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন রোজা ও কোরআন রোজাদার বান্দার জন্য আল্লাহর নিকট কেয়ামতের দিন সুপারিশ করবে। রোজা বলবে হে আল্লাহ আমি এ ব্যক্তিকে দিনে খাবার ও অন্যান্য কামনা-বাসনা থেকে ফিরে রেখেছি ।
আপনি তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ কবুল করুন । কোরআন বলবে হে আল্লাহ আমি এ ব্যক্তিকে রাতের নিদ্রা থেকে ফিরিয়ে রেখেছি । আপনি তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ গ্রহণ করুন । অতঃপর আল্লাহ তাদের সুপারিশ গ্রহণ করবেন । ( মুসনাদে আহমদ, হাদীস নং ৬৩৩৭) অপর একটি হাদীসে এসেছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন আল্লাহ তাআলা বলেনঃ রোজা আমার জন্য আমি নিজেই তার প্রতিদান দেবো ।
কেয়ামতের দিন রোজাদারদের জন্য একটি বিশেষ হাউজ থাকবে । যেখানে রোজাদার ব্যতীত অন্য কারো আগমন ঘটবে না । মুসনাদে বাজ্জার , হাদীস নং ৮১১৫ )
রোযা কার কার উপর ফরজ ?
পবিত্র কুরআনুল কারীম ও হাদীসের বিশ্লেষণ অনুযায়ী রমজানের চাঁদ উদিত হওয়ার পর প্রত্যেক সুস্থ মস্তিষ্ক, প্রাপ্তবয়স্ক, মুকিম মুসলমান পুরুষ ও হায়েজ-নেফাস থেকে পবিত্র মহিলার উপর পূর্ণ এক মাস রোজা রাখা ফরজ ।
আর অতিশয় বৃদ্ধ যার রোজা রাখার কোনো ক্ষমতা নেই বা এমন অসুস্থ ব্যাক্তি যার ভালো হওয়ার আশা নেই । তারা তাৎক্ষণিকভাবে ফিদিয়া দেবে । গর্ভবতী মহিলা রোজা রাখলে নিজের বা গর্ভস্থ সন্তানের প্রাণহানি অথবা মারাত্মক স্বাস্থ্যহানির প্রবল আশঙ্কা থাকলে, এমনিভাবে দুগ্ধদানকারী মহিলা রোজা রাখলে যদি সন্তান দুধ না পায় , আর সন্তান অন্য কোন খাবারে অভ্যস্ত না হয় তাহলে এ ধরনের মহিলাদের রোজা ভাঙ্গা জায়েজ আছে । পরে কাযা করতে হবে । এ ছাড়া অন্য কোনো অজুহাতে রোজা ভঙ্গ করা জায়েজ নাই ।
কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য যে ইদানিং অনেকে রোজা রাখে না । কেউ কেউ আবার প্রাপ্তবয়স্ক ছেলে মেয়েদের রোজা রাখার ক্ষেত্রেও যথেষ্ট দুর্বলতা দেখায় । মনে করে ছেলে-মেয়েটা যদি রোজা রাখে তাহলে তার স্বাস্থ্যটা ভেঙ্গে যাবে । এটা তাদের ভুল ধারণা। রোজা রাখার শারীরিক ফায়দা বিজ্ঞানের আলোকেও প্রমাণিত ।
তাছাড়া একটা রমজানের এত গুরুত্ব যে ইচ্ছাপূর্বক কোন শরয়ী ওজর ব্যতিত কেউ যদি একটা রোজাও ছেড়ে দেয় এর পরিবর্তে সারা বছর রোজা রাখলেই হয় ওই একটা রোজার ঘাটতি পূরণ হবে না । এক্ষেত্রে নবীজির হাদীসটি স্মরণযোগ্য । নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন ,যে ব্যক্তি অসুস্থতা ও সফর ব্যতীত ইচ্ছাকৃতভাবে রমজানের একটি রোজা ছেড়ে দিল সে আজীবন রোজা রাখলেও একটি রোজার হক আদায় হবে না । ( সুনানে তিরমিযী )
তাই সন্তানের জন্য এ ধরনের অন্যায় মায়া মমতা করা জায়েজ নয়। এর দ্বারা আপনারা নিজেরাই নিজের হাতে তাদের ধ্বংসের পথ করে দিলেন । এজন্য আপনাদের জবাবদিহি করতে হবে রোজ হাশরে ।
আল্লাহর আদালতে । অতএব সবাই সাবধান থাকুন ।
তারাবীর নামাজ পড়া।
তারাবীহ শব্দের মূল হচ্ছে তারবীহা । অর্থ হচ্ছে স্বাচ্ছন্দ ভোগ করা । তারাবীর নামাজের প্রতি চার রাকাত অন্তর যেহেতু বসে বসে একটু বিশ্রাম নেওয়া হয় এজন্য এই নামাজকে তারাবীর নামাজ বলে । রমজান মাসে দিনের বেলা রোজা রাখা ফরজ আর রাতের বেলা তারাবীর নামাজ পড়া সুন্নাতে মুআক্কাদা ।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তারাবীর নামাজ সাহাবায়ে কেরামকে সঙ্গে নিয়ে জামাতের সাথে আদায় করেছেন । তবে তিনি মাঝেমধ্যে এ থেকে বিরতও থেকেছেন । এ বিরত থাকার কারণ তিনি বর্ণনা করেছেন, আমার ভয় হয় আমার উম্মতের উপরে তারাবীর নামায ওয়াজিব হয়ে যায় কিনা ! কেননা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে কাজ নিয়মিত করতেন তা উম্মতের উপর ওয়াজিব হিসেবে গণ্য হতো ।
হাদীসে বর্ণিত আছে, যে দিন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্ব প্রথম তারাবীর নামাজ পড়লেন সেদিন কিছু সংখ্যক সাহাবায়ে কেরাম তার সঙ্গে অংশগ্রহণ করেন । পরের দিন আরও বেশি লোক নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে জামাতে শরীক হন । তৃতীয় দিনও প্রচুর লোক সমাগম হয় । আর চতুর্থ দিন মসজিদ লোকে লোকারণ্য হয়ে যায় । সকলে বসে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে জামাতে নামাজ পড়ার অপেক্ষা করতে থাকেন । কিন্তু নবী কারীম সাল্লাল্লাহু সাল্লাম সেদিন আর মসজিদে হাজির হলেন না । ঘরেই নামাজ পড়েন নিলেন। পরদিন ফজরের নামাজ শেষে উপস্থিত লোকদের উদ্দেশ্যে বললেন, গত রাতে আপনারা আমার জন্য দীর্ঘক্ষন অপেক্ষায় বসে ছিলেন । আমিও আপনাদের উপস্থিতি ও বসে থাকা সবই জানতাম তবুও আসিনি ।
কেননা মসজিদে আসলে আমাকে অবশ্যই তারাবীর নামাজ পড়তে হতো । এই ইবাদাত নিয়মিতভাবে করলে আমার উম্মতের উপর ফরজ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে । তাই আমি এর থেকে মাঝে মধ্যে বিরত থাকি । অবশ্য সাহাবায়ে কেরাম এ নামাজ নিয়মিত পড়তেন ।
অবশেষে খোলাফায়ে রাশেদার যুগে দ্বিতীয় খলীফা আমীরুল মুমিনীন হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব রাদিআল্লাহু তাআলা আনহু রাষ্ট্রীয়ভাবে তারাবীর নামাজ জামাতের সাথে পড়ার ইন্তেজাম করেন । সে থেকে অদ্যাবধি চলে আসছে । এটা হযরত ওমর রাদিআল্লাহু চালু করা আমল মনে করে খাটো করে দেখার কোন সুযোগ নেই । কেননা হাদীসে এসেছে তোমরা আমার ও খোলাফায়ে রাশেদার সুন্নাতকে আঁকড়ে ধরবে । ( আবু দাউদ )
তারাবীর নামাজ সুন্নাত হলেও বেশ গুরুত্ব ও ফজিলতের কথা হাদীসে বর্ণিত হয়েছে ।
হযরত আবু হুরায়রা রাদিআল্লাহু তাআলা আনহু থেকে বর্ণিত । রাসুলে আরাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি পূর্ণ ঈমান ও বিশ্বাসের সাথে সওয়াবের আশায় তারাবীর নামাজ আদায় করবে তার পূর্ববর্তী গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে ( সহীহ বুখারী ,২০০৯)
হযরত আব্দুর রহমান ইবনে আউফ রাদিআল্লাহু তাআলা আনহু বর্ণনা করেন । নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, আল্লাহ তাআলা তোমাদের উপর রোজা ফরয করেছেন আর আমি কিয়ামুল লাইল অর্থাৎ তারাবীর নামাজকে সুন্নাত করেছি । সুতরাং যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে সওয়াবের আশায় রমজানের রোজা ও তাবাবীর নামাজ আদায় করবে সে ঐদিনের মতো নিষ্পাপ হয়ে যাবে যেদিন সে মাতৃগর্ভ থেকে সদ্য ভূমিষ্ঠ হয়েছিল । ( মুসনাদে আহমদ, হাদীস নং ১৬৬০)
তারাবীর নামাজের রাকাত সংখ্যা নিয়ে মতানৈক্য রয়েছে । তবে প্রসিদ্ধ মত অনুযায়ী তারাবীর নামাজ ২০ রাকাত । এটাই সুন্নাত এবং সাহাবায়ে কেরামের আমল। তারাবীর নামাজ সংক্রান্ত আলাদা একটি কনটেন্ট তৈরি করা হবে ইনশাআল্লাহ । সেখানে দলীলভিত্তিক আলোচনা হবে । সেটি পেতে আমাদের সাথেই থাকুন ।
কোরআনুল কারীমের তেলাওয়াত করা।
রোজা এবং রমজান মাসে সঙ্গে কোরআনে গভীর সম্পর্ক রয়েছে । এ প্রসঙ্গে স্বয়ং আল্লাহ তাআলা বলেছেন-
شَہۡرُ رَمَضَانَ الَّذِیۡۤ اُنۡزِلَ فِیۡہِ الۡقُرۡاٰنُ ہُدًی لِّلنَّاسِ وَبَیِّنٰتٍ مِّنَ الۡہُدٰی وَالۡفُرۡقَانِ ۚ فَمَنۡ شَہِدَ مِنۡکُمُ الشَّہۡرَ فَلۡیَصُمۡہُ ؕ وَمَنۡ کَانَ مَرِیۡضًا اَوۡ عَلٰی سَفَرٍ فَعِدَّۃٌ مِّنۡ اَیَّامٍ اُخَرَ ؕ یُرِیۡدُ اللّٰہُ بِکُمُ الۡیُسۡرَ وَلَا یُرِیۡدُ بِکُمُ الۡعُسۡرَ ۫ وَلِتُکۡمِلُوا الۡعِدَّۃَ وَلِتُکَبِّرُوا اللّٰہَ عَلٰی مَا ہَدٰىکُمۡ وَلَعَلَّکُمۡ تَشۡکُرُوۡنَ
অনুবাদ: রমযান মাসই হল সে মাস, যাতে নাযিল করা হয়েছে কোরআন, যা মানুষের জন্য হেদায়েত এবং সত্যপথ যাত্রীদের জন্য সুষ্পষ্ট পথ নির্দেশ আর ন্যায় ও অন্যায়ের মাঝে পার্থক্য বিধানকারী।
কাজেই তোমাদের মধ্যে যে লোক এ মাসটি পাবে, সে এ মাসের রোযা রাখবে। আর যে লোক অসুস্থ কিংবা মুসাফির অবস্থায় থাকবে সে অন্য দিনে গণনা পূরণ করবে। আল্লাহ তোমাদের জন্য সহজ করতে চান; তোমাদের জন্য জটিলতা কামনা করেন না যাতে তোমরা গণনা পূরণ কর এবং তোমাদের হেদায়েত দান করার দরুন আল্লাহ তাআলার মহত্ত্ব বর্ণনা কর, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা স্বীকার কর। (আল বাকারা – ১৮৫)
উক্ত আয়াতের প্রথমাংশে রমজানের গুরুত্ব ও মহত্ত্বের কথা স্পষ্ট । অর্থাৎ রমজানের মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বের অন্যতম কারণ হলো এ মাসে কুরআন নাযিল হয়েছে । যেহেতু নুজুলে কুরআনের সাথে রমজানের সম্পর্ক রয়েছে তাই রমজানের এতো ফজিলত। সুতরাং এর দ্বারা বুঝা যায় যার সাথে কোরআনের সম্পর্ক যত বেশি হবে তার মর্তবা ও মর্যাদা তত বেশি হবে ।
তাই সে ফেরেশতা হোক, নবী-রাসূল হোক, বা কোন স্থান, কোন সময় কিংবা কোন ব্যক্তি হোক, বস্তু হোক যাই হোক না কেন ! কোরআনের সাথে যার যত বেশি সম্পর্ক হবে তার মর্যাদা ততো বেশি বৃদ্ধি পাবে ।
ফেরেশতাদের সঙ্গে সম্পর্ক হওয়ায় ফেরেশতা জিবরাঈল আলাইহিস সালাম সমস্ত ফেরেশতা দের মধ্যে শ্রেষ্ঠ মর্যাদার অধিকারী হয়েছেন । নবীর সঙ্গে সম্পর্ক হওয়ায় নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সমস্ত নবী-রাসূলগণের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করেছেন । শহরের সঙ্গে সম্পর্ক হওয়ায় শহর মক্কা-মদিনা পৃথিবীর সমস্ত শহর থেকে শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করেছেন। যার কারণে শহর দুটির নাম নেওয়ার সময় অত্যন্ত সম্মানের সাথে বলা হয় মক্কাতুল মুকাররমাহ ও মদিনাতুল মুনাওয়ারা ।
মাসের সাথে সম্পর্ক হওয়ায় এ মাস ১২ মাসের মধ্যে শ্রেষ্ঠ মাস হয়েছে । সুতরাং যে ব্যক্তি সঙ্গে কোরআনের সম্পর্ক হবে, যে এই কোরআন মুখস্ত করবে ,তেলাওয়াত করবে, এর বিধি বিধান মোতাবেক আমল করবে ,কেয়ামতের ময়দানে তার মর্যাদা ও সকলের উপরে হবে ।
এ কারণেই রমজান মাসে কোরআন তেলাওয়াতের গুরুত্ব দিতেন স্বয়ং নবীজি । হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিআল্লাহু আনহু বলেন, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন সবচেয়ে বেশি দানশীল ও বদান্যতা । রমজানে তার দানশীলতা ও বদান্যতা অনেক বেড়ে যেত ।
প্রত্যেক রমজানে ফেরেশতা জিব্রাইল আলাইহিস সাল্লাম তার সঙ্গে মিলিত হতেন এবং পুরো কোরআন একে অপরকে শোনাতেন । (সহীহ বুখারী , হাদীস নং ৬)
পবিত্র কুরআন বুঝে পড়ুক অথবা না বুঝে পড়ুক পাঠ করলেই সওয়াব পাবে । এজন্য নবীজি পবিত্র কুরআন পড়ার প্রতি উদ্বুদ্ধ করতে গিয়ে বলেছেন,
যে ব্যক্তি কুরআনের একটি হরফ ( অক্ষর) পাঠ করল সে একটি নেকী লাভ করল এবং একটি নেকি দশটি নেকীর সমতুল্য হবে । নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেন আমি এটা বলি না যে ألم একটি হরফ বরং الف একটি হরফ لام একটি হরফ ও م একটি হরফ । ( সুনানে তিরমিজী)
অর্থাৎ আলিফ-লাম-মীম তিনটি হরফের সমন্বয়ে একটি শব্দ ।এই একটি শব্দও পাঠ করা মাত্র ৩০ নেকি পাওয়া যাবে । আর রমজান মাসে প্রত্যেক আমলের সওয়াব ৭০ গুণ বৃদ্ধি পায় । তাহলে এবার হিসেব করে দেখুন পবিত্র কোরআন তেলাওয়াতের কত সওয়াব হতে পারে ! খতমে তারাবী ও অফুরান সওয়াব পাওয়ার বড়ো একটি মাধ্যম । এদিকে ও সকলের মনোযোগী হওয়া উচিত ।
আপনারা পড়ছেন রমজানে করনীয় বর্জনীয়
ইফতার করা
সারাদিন রোজা রাখার পর সূর্য ডোবার সঙ্গে সঙ্গে আযানের পর যে আহার গ্রহণ করা হয় তার নাম ইফতার । এটা শরীয়তের অনেক বড় একটি আমল। এ আনন্দপূর্ণ আমলের জন্য ঘোষণা করা হয়েছে বড় বড় পুরস্কার । ইফতার যেহেতু অনেক বরকতের তাই এই বরকত পূর্ণ আমল শুরু করতে বিলম্ব করতে নিষেধ করা হয়েছে ।
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, লোকেরা যতদিন প্রথম সময় ইফতার করার বিষয়ে যত্নবান হবে ততদিন তারা কল্যাণের পথে থাকবে । ( সহীহ বুখারী , হাদীস নং ১৯৫৭)
ইফতার খেজুর দ্বারা করা মুস্তাহাব । খেজুর না পেলে পানি দ্বারা ইফতার করা যাবে । এ সম্পর্কে রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি সাল্লামের ঘোষণা- যে ব্যক্তি খেজুর পাবে সে যেন খেজুর দ্বারা ইফতার করে। যে ব্যক্তি খেজুর পাবে না সে পানি দ্বারা ইফতার করলেও চলবে । কারন পানিও পবিত্র । ( সুনানে নাসায়ী )
হযরত আনাস ইবনে মালেক রাদিআল্লাহু তাআলা আনহু বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাগরিবের নামাজ পড়ার আগে তাজা খেজুর দিয়ে ইফতার করতেন। তাজা খেজুর না পেলে শুকনা খেজুর দ্বারা ইফতার করতেন। আর তাও না পেলে এক ঢোক পানি দ্বারা ইফতার করতেন।(জামে তিরমিযী , হাদীস নং ৬৯২)
রোজা রাখার পর স্বাভাবিক কারণেই কিছুটা শারীরিক দুর্বলতা দেখা দেয়। এ কারণে এমন জিনিস দ্বারা ইফতার করতে হবে যা সহজে হজম হবে এবং শরীরে শক্তি যোগাবে । আর এক্ষেত্রে খেজুর হচ্ছে পারফেক্ট খাদ্য । খেজুরের রাসায়নিক পর্যালোচনা এমন ।
এক. প্রোটিন ২.০ দুই. ফ্যাট ২.০ তিন. কার্বো হাইড্রেটস ২৪.০ চার. ক্যালোরী ২.০ পাঁচ. সোডিয়াম ৪.৭ ছয়. পটাশিয়াম ৭৫৪.০ সাত. ক্যালসিয়াম ৬৭. ৯ আট. ম্যাগনেমিয়াম ৫৮. ৯ নয়. কপার ০.২১ দশ. আয়রণ ১.৬১ এগারো. ফসফরাস ৬৩৮. ০ বারো. সালফার ৫১.৬ তেরো. ক্লোরাইন ২৯০.০
এ ছাড়া খেজুরের মধ্যে প্যারোক্সাইডেস ও পাওয়া যায়। রোজার সময়ে ভোর রাতে সাহরী খাওয়ার পর সন্ধ্যা পর্যন্ত কিছু পানাহার করা যায় না । এ কারণে দেহে ক্যালোরি এবং উত্তম ক্রমাগত কমতে থাকে । তাই খেজুর দিয়ে ইফতার করলে দেহের ক্যালোরি এবং উত্তাপে ভারসাম্য ফিরে আসে । দেহ নানা প্রকার রোগ থেকে মুক্ত থাকতে পারে । তাই রোজাদারদের জন্য খেজুর হচ্ছে আদর্শ খাদ্য ।
ইফতার বা সাহরীতে প্রোটিন জাতীয় খাবার যেমন মাংস, মাছ, ডিম ও ভাজা পোড়া কম খাবেন।
মনে রাখবেন প্রোটিন জাতীয় খাবার পানির তৃষ্ণা বাড়ায়। ছোলা, খেজুর পানিসহ হালকা কিছু দিয়ে ইফতার করুন।
ইফতারে প্যাকেটজাত জুস বা ব্রান্ডের তৈরি রসের পরিবর্তে দেশীয় মৌসুমী ফল খান। দেশীয় নিয়মে শরবত তৈরি করুন । এটা উত্তম হবে । আর হ্যাঁ ইফতার খাওয়ার সময় এই দুআটি অবশ্যই পড়বেন- আল্লাহুম্মা লাকা সুমতু ওয়ালা রিজকিকা আফতারতু বিরাহ-মাতিকা ইয়া আর হামার রাহিমিন ।
অনুবাদ: হে আল্লাহ আমি তোমার সন্তুষ্টির জন্য রোজা রেখেছি এবং তোমার দেওয়া রিযিকের মাধ্যমে ইফতার করছি ।
ইফতার নিয়ে আজকাল বেশ বাড়াবাড়ি পরিলক্ষিত । এটা পরিত্যাজ্য । তাছাড়া ইফতার আয়োজন করতে গিয়ে আমাদের মা-বোনেরা আসর থেকে মাগরিব পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময় টা ব্যয় করে ফেলে । এই সময় অনেক দুআ করার কথা হাদীসে বর্ণিত হয়েছে । সেগুলো তাদের তেমন একটা করা হয় না । তাই ইফতার বানাতে বানাতে দুআ দরুদ পড়া উচিত কিংবা ইফতার বানানো কাজ আগে শেষ করে আমলে মশগুল হওয়া উচিত ।
অন্যকে ইফতার করানো
ইফতার করানো একটি সাওয়াব ও আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের মাধ্যম। ইফতার করানোর ফজিলত সম্পর্কে নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি এ মাসে রোজাদারকে ইফতার করাবে তা তার পাপমোচন ও দোযখ থেকে মুক্তির কারণ হবে এবং এতে সে ওই রোজাদারের সম্মান পুণ্যের অধিকারী হবে । অথচ রোজাদারের পুণ্য তাতে একটুও কমবে না ।
তখন সাহাবীগণ আরজ করলেন ইয়া রাসুলুল্লাহ ! আমাদের সকলের তো রোজাদারকে (তৃপ্তি সহকারে) ইফতার করার সামর্থ্য নেই । তখন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন যে ব্যক্তি কোন রোজাদারকে এক ঢোক দুধ দ্বারা বা একটি খেজুর দ্বারা বা একটু পানি দ্বারা ইফতার করাবে তাকেও আল্লাহ তাআলা রোজাদারের সমান সওয়াব দিবেন।
আর যে ব্যক্তি কোন রোজাদারকে তৃপ্তি সহকারে উদর পূর্ণ করে খাওয়াবে আল্লাহ তাআলা তাঁকে আমার হাউস থেকে এমন পানি পান করাবেন যে সে জান্নাতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত আর কখনো পিপাসার্ত হবে না ।
( সহীহ ইবনে খুযাইমা )
হযরত যায়েদ ইবনে খালেদ রাদিআল্লাহু তাআলা আনহু থেকে বর্ণিত । নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি কোন রোজাদারকে ইফতার করাবে সে তার অনুরুপ প্রতিদান লাভ করবে । তবে তার প্রতিদান থেকে বিন্দুমাত্র কম করা হবে না । (সুনানে তিরমিযী , ৮০৭)
সুতরাং আমাদের উচিত রোজা রাখার পাশাপাশি অপর রোজাদারকে ইফতার করানোর একটা বাজেট নির্ধারণ করা এবং একাজে প্রতিযোগিতা করে একে অপরের আগে যাওয়ার চেষ্টা করা । কেননা নেক কাজে প্রতিযোগিতা করা কেবল জায়েজ নয় বরং আল্লাহর হুকুম এবং নবীজির ঘোষণা ।
সাহরী খাওয়া
রোজা মাসে আমরা সবাই সাহরী খাই । কিন্তু চিন্তার বিষয় হলো আমরা কি নিয়তে সাহরী গ্রহণ করব? সাধারণত আমাদের মনে এই চিন্তা থাকে যে সাহরী না খেলে সারাদিন ক্ষুধায় কষ্ট পেতে হবে ।কাজেই ক্ষুধার কষ্ট থেকে বাঁচার জন্য সাহরী খেতে হয় । এই চিন্তায় সাহরী খেলে সহীহ নিয়তে সাহরী হবে না । এই চিন্তায় সাহরী খেলে ক্ষুধার কষ্ট থেকে বাঁচা যাক আর না যাক সওয়াব থেকে আমরা বঞ্চিত হয়ে যাবো ।
সাহরী খাওয়া সুন্নাত এই নিয়তে খেতে হবে । তাহলে না খাওয়ার কষ্ট থেকেও বাঁচা গেল সুন্নাত ও আদায় করার সওয়াব পাওয়া যাবে ।
হযরত আনাস রাদিআল্লাহু তাআলা আনহু বলেন, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন তোমরা সাহরী খাও । অবশ্যই সাহরীর মধ্যে বরকত রয়ে গেছে। ( বুখারী ও মুসলিম) এ হাদীসের আলোকে সাহরীর সময় আমাদের বরকত অর্জন করার নিয়ত থাকার কথা বোঝা গেলো ।
আরো একটি হাদীসে এসেছে যারা সাহরী খায় আল্লাহ তাদেরকে বরকত দান করেন, ফেরেশতারা তাদের জন্য রহমতের দোয়া করেন । (তাবারানী ও সহীহ ইবনে হিব্বান )
সাহরী যথাসম্ভব রাতের শেষের দিকে খাওয়া উত্তম । যদি আগেভাগে খাওয়া হয়ে যায় তারপরও শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত চা পানি পান ইত্যাদিতে লিপ্ত থাকলেও শেষ মুহূর্তে সাহরী খাওয়ার ফজিলত অর্জিত হবে ।
নিয়ত করার পরে কোনো কিছু খাওয়া যায়না এরকম একটি কথা সমাজে প্রচলিত আছে । এটি ভুল ও ভিত্তিহীন একটি কথা । নিয়ত করার পরেও সময় থাকলে খাওয়া বা পান করা যায় তাতে কোন অসুবিধা নেই ।
তাওবা- ইস্তেগফার করা ।
মানুষের জীবন গোনাহে জর্জরিত । এমন কোন মানুষ নাই যার গোনাহ নেই । একমাত্র আম্বিয়ায়ে কেরামের সুমহান জামাত ব্যতীত । কেননা সমস্ত নবী ও রাসূলগণ নবুওয়াতের আগে ও পরে সব ধরনের গুনাহ থেকে মুক্ত থাকেন । তারা হচ্ছেন নিষ্পাপ । কিন্তু আমরা সাধারণ মানুষ । আমাদের গুনাহ সংঘটিত হওয়া স্বাভাবিক বিষয় ।
গুনাহ সংঘটিত হওয়া কোন আশ্চর্য বা অস্বাভাবিক বিষয় নয় বরং আশ্চর্য হল গোনাহের ওপর অটল অবিচল থাকা । এ কারণে আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে বারবার বান্দাকে তাওবার প্রতি উদ্বুদ্ধ করেছেন-
یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا تُوۡبُوۡۤا اِلَی اللّٰہِ تَوۡبَۃً نَّصُوۡحًا ؕ عَسٰی رَبُّکُمۡ اَنۡ یُّکَفِّرَ عَنۡکُمۡ سَیِّاٰتِکُمۡ وَیُدۡخِلَکُمۡ جَنّٰتٍ تَجۡرِیۡ مِنۡ تَحۡتِہَا الۡاَنۡہٰرُ ۙ یَوۡمَ لَا یُخۡزِی اللّٰہُ النَّبِیَّ وَالَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا مَعَہٗ ۚ نُوۡرُہُمۡ یَسۡعٰی بَیۡنَ اَیۡدِیۡہِمۡ وَبِاَیۡمَانِہِمۡ یَقُوۡلُوۡنَ رَبَّنَاۤ اَتۡمِمۡ لَنَا نُوۡرَنَا وَاغۡفِرۡ لَنَا ۚ اِنَّکَ عَلٰی کُلِّ شَیۡءٍ قَدِیۡرٌ
অনুবাদ: হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহ তা’আলার কাছে তওবা কর-আন্তরিক তওবা। আশা করা যায়, তোমাদের পালনকর্তা তোমাদের মন্দ কর্মসমূহ মোচন করে দেবেন এবং তোমাদেরকে দাখিল করবেন জান্নাতে, যার তলদেশে নদী প্রবাহিত। সেদিন আল্লাহ নবী এবং তাঁর বিশ্বাসী সহচরদেরকে অপদস্থ করবেন না।
তাদের নূর তাদের সামনে ও ডানদিকে ছুটোছুটি করবে। তারা বলবেঃ হে আমাদের পালনকর্তা, আমাদের নূরকে পূর্ণ করে দিন এবং আমাদেরকে ক্ষমা করুন। নিশ্চয় আপনি সবকিছুর উপর সর্ব শক্তিমান। (আত তাহরীম – ৮)
আর রমজান মাসে বেশি করে তওবা ইস্তেগফার করা কর্তব্য । বিশ্বনবী ঘোষণা দিয়েছেন , আল্লাহ এ মাসের প্রতিরাতে অসংখ্য জাহান্নামীকে মুক্তি দান করেন।(মুসনাদে আহমাদ , ১৮৭৯৪)
তিনি আরো বলেছেন তোমরা এ মাসে চারটি কাজ বেশি বেশি করবে । দুটি এমন যা দ্বারা তোমরা তোমাদের প্রভুর সন্তুষ্টি অর্জন করবে এবং দুটি কাজ এমন যা ছাড়া তোমাদের কোন উপায় নেই । প্রভুর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য দুটি কাজ হল ১.কালিমা পাঠ ২. বেশী বেশী ইস্তেগফার করা ।
আর যে দুটি ব্যতীত তোমাদের কোন উপায় নাই আর তা হলো ১.আল্লাহর কাছে জান্নাত চাওয়া ২. জাহান্নাম থেকে মুক্তি কামনা করা ।
সুতরাং আমাদের কর্তব্য বেশি করে তাওবা ইস্তিগফারের আমলে মগ্ন থাকা ।
রমজানে বেশি বেশি দুআ করা ।
রোজার মাধ্যমে মুমিন বান্দা আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করে যতক্ষণ সে রোজা অবস্থায় অথবা রোজার প্রস্তুতি অবস্থায় থাকে। তখন তার কোন দুআ ফেরত দেওয়া হয় না । সমস্ত দোয়া কবুল করা হয় । নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন প্রত্যেক মুসলিমের রমজানের দোয়া করে তা কবুল করা হয় ।(মুসনাদে বায্যার , ৩১৪১)
ইফতারের আগ মুহূর্তে দুআ করা যায়। কেননা এ সময় দোয়া কবুল হয় ।
আব্দুল্লাহ ইবনে মুলাইকা বলেন, আমি আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রাদিআল্লাহ তাআলা থেকে শুনেছি । তিনি বলছেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, ইফতারের সময় রোযাদারের একটি দুআ কবুল করা হয়।
আব্দুল্লাহ ইবনে মুলাইকা রহ: বলেন, আমি হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমরকে ইফতারের সময় এ দুআ করতে শুনেছি, আল্লাহুম্মা ইন্নি আসআলুকা বি রাহমাতিকা আল্লাতি ওসিআত কুল্লা শায়ইন আন তাগফিরলি’। অর্থাৎ, হে আল্লাহ, আমি তোমার দরবারে সেই রহমতের উসিলায় আবেদন করছি যা সকল বস্তুকে বেষ্টন করে রেখেছে, তুমি আমাকে মাফ করে দাও। (মুসতাদরাকে হাকেম , ১/৫২৯, হাদীস নং ১৫৬৭) দুআ করার আরেকটি সময় হচ্ছে সাহরী খাওয়ার সময় । অতএব দুআর প্রতি সকলের আরও গুরুত্ব বাড়ানো উচিত ।
রমজানে নফল নামাজ বেশি পড়া ।
রামাযান মাসে বেশি করে নফল নামাজ পড়া উচিত । কেননা হাদীসে বলা হয়েছে এ মাসে একটি নফল একটি ফরজের সমান। একটি ফরজ ৭০ টি ফরজ এর সমান। হাদীসটি এরকম-
মানুষের প্রত্যেক আমলের প্রতিদান বৃদ্ধি করা হয় । একটি নেকীর সাওয়াব দশগুণ থেকে সাতশ গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয় । আল্লাহ তাআলা বলেন কিন্তু রমাযানের বিষয়টা আলাদা। কারণ তা একমাত্র আমার জন্য এবং আমি নিজেই তার প্রতিদান দেবো । বান্দা তো আমার জন্য নিজের প্রবৃত্তির দমন করে এবং পানাহার ত্যাগ করে । (সহীহ মুসলিম )
তাই অধিক পরিমাণে নফল নামাজ বেশি বেশি পড়া । বিশেষ করে সাহরী খেতে উঠে প্রথমে দু চার রাকাত তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করা । তারপরে সাহরী খাওয়া । এবং এই সুযোগ হাত ছাড়া না করা ।
দান-সদকা ও যাকাত দেওয়া ।
রমজান মাসে আমাদের বেশি করে দান সদকা ও যাকাত দেওয়া উচিত । পবিত্র কোরআনে নামাজের পর সব থেকে বেশি যাকাতের কথা বলা হয়েছে । যাকাত নিয়ে আলাদা একটি কনটেন্ট তৈরি করা হচ্ছে । আমাদের সাইটে সেটা পাবেন ইনশাআল্লাহ।
দান সদকার কথাও কোরআন ও হাদীসে কম উল্লেখ করা হয়নি । আসলেই আল্লাহর হুকুম অনুযায়ী সম্পদ ব্যয় করলে, দীনের কাজে সম্পদ ব্যয় করলে কমে না বরং আরো বাড়ে । দান সম্পর্কে আল্লাহর ঘোষণা-
یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡۤا اَنۡفِقُوۡا مِمَّا رَزَقۡنٰکُمۡ مِّنۡ قَبۡلِ اَنۡ یَّاۡتِیَ یَوۡمٌ لَّا بَیۡعٌ فِیۡہِ وَلَا خُلَّۃٌ وَّلَا شَفَاعَۃٌ ؕ وَالۡکٰفِرُوۡنَ ہُمُ الظّٰلِمُوۡنَ
অনুবাদ: হে ঈমানদারগণ! আমি তোমাদেরকে যে রুযী দিয়েছি, সেদিন আসার পূর্বেই তোমরা তা থেকে ব্যয় কর, যাতে না আছে বেচা-কেনা, না আছে সুপারিশ কিংবা বন্ধুত্ব। আর কাফেররাই হলো প্রকৃত যালেম। (আল বাকারা – ২৫৪)
বিখ্যাত তাবেয়ী হযরত মারসাদ ইবনে আব্দুল্লাহ রহ: বলেন আমাকে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একজন সাহাবী বলেছেন। তিনি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছেন কেয়ামতের দিন মুমিনের ছায়া হবে তার দান-সদকা। (মুসনাদে আহমদ ও সহীহ ইবনে খুযাইমা )
তাছাড়া রমজানে একে ৭০ বৃদ্ধির হাদীস অনুযায়ী অল্প টাকা দান করলেও বিশাল সওয়াবের অধিকারী হওয়া সম্ভব । তাই পরিকল্পনা করে পুরো মাসব্যাপী দান করা উচিত ।
কোরআন ও সুন্নাহর আলোকে রমজানের করণীয় সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা উল্লেখ করা হলো । এবার আমরা জানবো রমজানের বর্জনীয় বিষয়গুলো সম্পর্কে । প্রথমত রমজানে গোনাহ থেকে বেঁচে থাকার ট্রেনিং নিতে হবে । তা না হলে অনেক ক্ষেত্রে রোজার নূরানীয়াত হাসিল হবে না । সাওয়াব বরবাদ হয়ে যাবে । তাই এবার এ সম্পর্কে কিছু কথা শুনুন ।
রমজানে বর্জনীয় কাজ
অশ্লীল কথাবার্তা না বলা ।
রোজা অবস্থায় অশ্লীল কথাবার্তা না বলা এবং শোরগোল না করা ও ঝগড়া ফাসাদ থেকে বিরত থাকা খুব জরুরী । হাদীস শরীফে এসেছে, তোমাদের কেউ যখন রোযা অবস্থায় থাকে তখন যেন অশ্লীল কথা না বলে এবং শোরগোল না করে। আর কেউ যদি তার সঙ্গে ঝগড়া করে, গালি দেয়, তা হলে সে যেন শুধু বলে দেয়, আমি তো রোযাদার। ( সহীহ বুখারী , হাদীস নং ১৯০৪)
অপর একটি হাদীসে এসেছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন কত রোজাদার এমন আছে ( রোজা অবস্থায় অশ্লীল কথা ও কর্ম থেকে বিরত না থাকার ফলে ) ক্ষুধা ও পিপাসা ছাড়া রোজা থেকে সে কিছু লাভ করতে পারে না । তেমনি অনেক রাত জাগরণকারী এমন আছে যে তার রাত্রি জাগরন থেকে জেগে থাকার কষ্ট ছাড়া আর কিছু পায় না ।
(সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস নং ১৬৯০ )
মিথ্যা কথা না বলা ।
মিথ্যা কথা একটি মারাত্মক ভাইরাস । রোজা অবস্থায় মিথ্যা কথা বলার পরিণাম ভয়াবহ । রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন যে রোজা রেখেছে অথচ মিথ্যাচার পরিহার করেনি ,তার কৃত্রিম পানাহার বর্জনের কোন প্রয়োজন আল্লাহর নেই ।
(সহীহ বুখারী , হাদীস নং ১৯০৩)
হাদীসে আরো এসেছে যে ব্যক্তি আমার জন্য দুই চোয়ালের মধ্যবর্তী ও দুই পায়ের মধ্যবর্তী বস্তুর জিম্মাদারী নেবে আমি তার জান্নাতের জিম্মাদারী গ্রহণ করব । ( সহীহ বুখারী )
হাদীস থেকে বোঝা গেল কেউ যদি জিব্বা ও লজ্জাস্থানের হেফাযত করে , এর অপব্যবহার না করে তাহলে সে জান্নাতে যাবে।
অনর্থক কাজ বা কথা না বলা ।
হযরত আবু হুরায়রা রাদিআল্লাহু তাআলা আনহু থেকে বর্ণিত । রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, শুধু পানাহার বর্জন করা নাম রোজা নয় বরং রোজা হলো অনর্থক কথা ও কাজ এবং অশ্লীল কথা বর্জন করা । )মুসতাদরাকে হাকেম, হাদীস নং ১৬০২ )
কারো গীবত না করা ।
গীবত একটি মারাত্মক ব্যাধি। এ সম্পর্কে স্বয়ং রাব্বুল আলামীন ইরশাদ করেছেন-
یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوا اجۡتَنِبُوۡا کَثِیۡرًا مِّنَ الظَّنِّ ۫ اِنَّ بَعۡضَ الظَّنِّ اِثۡمٌ وَّلَا تَجَسَّسُوۡا وَلَا یَغۡتَبۡ بَّعۡضُکُمۡ بَعۡضًا ؕ اَیُحِبُّ اَحَدُکُمۡ اَنۡ یَّاۡکُلَ لَحۡمَ اَخِیۡہِ مَیۡتًا فَکَرِہۡتُمُوۡہُ ؕ وَاتَّقُوا اللّٰہَ ؕ اِنَّ اللّٰہَ تَوَّابٌ رَّحِیۡمٌ
অনুবাদ: মুমিনগণ, তোমরা অনেক ধারণা থেকে বেঁচে থাক। নিশ্চয় কতক ধারণা গোনাহ। এবং গোপনীয় বিষয় সন্ধান করো না। তোমাদের কেউ যেন কারও পশ্চাতে নিন্দা না করে। তোমাদের কেউ কি তারা মৃত ভ্রাতার মাংস ভক্ষণ করা পছন্দ করবে? বস্তুতঃ তোমরা তো একে ঘৃণাই কর। আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয় আল্লাহ তওবা কবুলকারী, পরম দয়ালু।
(আল হুজরাত – ১২)
হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে, নবী আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দরবারে দুজন মহিলা উপস্থিত হয়ে( দরজার বাইরে থেকে) অভিযোগ করল রোজার কারণে তাদের খুব কষ্ট হচ্ছে । পিপাসার কারণে প্রাণ ওষ্ঠাগত প্রায়। অবস্থা শুনে তিনি লোক মরফতে তাদের বমি করার আদেশ দিলেন । দেখা গেল গোশতের টুকরো ও তাজা রক্ত বের হচ্ছে ।
সাহাবায়ে কেরাম অবাক হলেন । তখন নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন এরা হালাল খাদ্য দ্বারা সাহরী খেয়ে রোজা রেখেছে কিন্তু রোজা অবস্থায় হারাম খেয়েছে অর্থাৎ মানুষের গীবত করেছে। আর গীবত করা হলো মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়া ।( মুসনাদে আহমাদ , ২৩৬৫৩ )
এই হাদীস থেকে বোঝা গেল গীবত ও অন্যান্য গোনাহের দ্বারা রোজার কষ্ট অনেক বেড়ে যায় । এ কারণে দেখা যায় আল্লাহর নেক বান্দারা রোজার তেমন কোন কষ্ট অনুভব করেন না । বরং তারা অনেক আত্মিক ও দৈহিক শান্তি লাভ করে থাকেন । পক্ষান্তরে যারা গীবত করে এবং বিভিন্ন গোনাহে থাকে তারা রোজার কারণে বেশ কাহিল হয়ে পড়ে । তাই আমাদের তাওবা করা উচিত এবং আল্লাহর কাছে দুই করা উচিত তিনি যেন আমাদেরকে পুরো মাহে রমজানটাকে ইবাদত-বন্দেগির মধ্যে কাটানোর তাওফিক দান করেন । আমীন ।
শেষ কথা:
সুপ্রিয় পাঠক । রমজানে করণীয় ও বর্জনীয় শীর্ষক আলোচনা থেকে কতটুকু উপকৃত হয়েছেন আমাদের জানাতে পারেন । আপনাদের আরো কোন কোন বিষয়ে লেখা প্রয়োজন আমাদের বলুন । আমাদের নির্ধারিত লেখকগণ আপনাদের চাহিদা ভিত্তিক কন্টেন তৈরি করে দিতে প্রস্তুত আছে ইনশাআল্লাহ ।