তালাক দেওয়ার নিয়ম
সুপ্রিয় পাঠক । বিবাহের মাধ্যমে নারী পুরুষ দাম্পত্য জীবনে প্রবেশ করে । সুখময় জীবন গড়ে তোলে । কিন্তু বিভিন্ন কারণে বিভিন্ন সময় স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিরোধ দেখা দেয় । একজন আরেকজনকে দেখতে পারে না । জীবন যেন বিষাক্ত হয়ে ওঠে । তাদের মিলনের আর যখন কোন সম্ভাবনাই থাকে না ,তখন তাদের বিচ্ছিন্ন হওয়ার জন্য ইসলামে তালাকের বিধান দেওয়া হয়েছে ।তালাক দেওয়ার নিয়ম কি?
অথচ এই তালাক সম্পর্কে অধিকাংশ মানুষ জানে না । জানে না তালাক দেওয়ার নিয়ম এবং এ সম্পর্কে জরুরি মাসআলা মাসায়েল । এজন্য অনেকেই গুনাহ করে ফেলছে । তাই আজ এখানে তালাক সংক্রান্ত জরুরী বিষয়গুলো উল্লেখ করা হচ্ছে । উপকৃত হবেন নিশ্চিত ।
তালাক দেওয়ার নিয়ম
তালাক শব্দের অর্থ কি ?
তালাক একটি আরবী শব্দ। শব্দটির অর্থ হলো বিচ্ছিন্ন হওয়া ,ত্যাগ করা ইত্যাদি ।
তালাক কাকে বলা হয় ?
পরিভাষায় তালাক বলা হয় স্বামী তার স্ত্রীর সাথে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করে দেওয়াকে । অর্থাৎ ইসলামে আনুষ্ঠানিক বিবাহ বিচ্ছেদকে তালাক বলা হয় ।
তালাক দেওয়ার নিয়ম
তালাক দেওয়ার তিনটি নিয়ম বা তরীকা আছে ।
১. অতি উত্তম নিয়ম ।
২. উত্তম নিয়ম ।
৩. বিদআত ও হারাম নিয়ম ।
এই তিনটির নিয়ম সম্পর্কে নিচে বিবরণ দেওয়া হলো ।
তালাক দেওয়ার অতি উত্তম নিয়ম
তালাক দেওয়ার অতি উত্তম নিয়ম হলো স্ত্রী যখন হায়েস থেকে পাক হবে তখন ( অর্থাৎ তহুর বা পাকীর সময়ে) এক তালাক দিবে এবং শর্ত এই যে , এ তহুরের মধ্যে তার সাথে সহবাস হতে পারবে না । এর পরবর্তী হায়েজ থেকে তার ইজ্জত শুরু হবে এবং তিন হায়েজ অতিবাহিত হলে তার ইদ্দত শেষ হবে । এই ইদ্দতের মধ্যে আর কোন তালাক দেবে না । ইদ্দত শেষ হলে বিয়ে ভেঙে যাবে।
তালাক দেওয়ার উত্তম নিয়ম
তালাক দেওয়ার উত্তম নিয়ম হলো স্ত্রী হায়েজ থেকে পাক হলে তহুরের মধ্যে এক তালাক দিবে । তারপর হায়েজ গিয়ে দ্বিতীয় তহুর এলে তাতে আর এক তালাক দিবে । তারপর তৃতীয় তহুরে আর এক তালাক দিবে । এভাবে তিন তহুরে তিন তালাক দিবে এবং ওই সময়ের মধ্যে ওই স্ত্রীর সাথে সহবাস করবে না ।
তালাক দেওয়ার বিদআত ও হারাম নিয়ম
উপরোক্ত তরীকা বা নিয়ম দুটির বিপরীত নিয়মে তালাক দেওয়া । যেমন একসঙ্গে তিন তালাক দেওয়া , বা হায়েজের সময় তালাক দেওয়া, বা যে তহুরে সহবাস হয়েছে সেই তহুরে তালাক দেওয়া । এসব অবস্থায় তালাক দিলে তালাক হয়ে যায় । তবে গুনাহ হবে । অতএব তা থেকে বিরত থাকা উচিত ।
তালাক দেওয়ার মাসয়ালা
১. নিতান্ত অপারগতা ছাড়া তালাক দেওয়া জুলুম ও অন্যায় ।
২. নিতান্ত ঠেকা ব্যতীত স্বামীর তালাক চাওয়া মহাপাপ ।
৩. কোন কল্যাণ ও প্রয়োজনে তালাক দেয়া মুবাহ বা জায়েজ ।
৪. স্ত্রী যদি স্বামীর জন্য কষ্টদায়ক হয় বা স্ত্রী নামাজ সম্পূর্ণ পরিত্যাগ কারিনী হয় বা স্বামীর অবাধ্য হয় তাহলে সে স্ত্রীকে তালাক দিয়া দেওয়া মুস্তাহাব । বোঝানো সত্ত্বেও যে স্ত্রী অশ্লীল কাজে লিপ্ত হয় তাকে তালাক দিয়ে দেওয়া উত্তম ।
৫. স্বামীর পক্ষ থেকে স্ত্রীর হক আদায় করতে অক্ষমতা দেখা দিলে তালাক দেওয়া ওয়াজিব । তবে স্ত্রী তার হক মাফ করে দিলে ওয়াজিব থাকে না ।
৬. নিজের কানে শোনা যায় এতোটুকু শব্দে তালাক দিলেই তালাক হয়ে যায় । স্ত্রীর বা অন্য কারো শোনা যাওয়া জরুরি নয় ।
৭. হাসি-ঠাট্টা করে বা রাগের মুহূর্তে বা নেশা করে মাতাল অবস্থায় তালাক দিলেও তালাক হয়ে যায় ।
৮. তালাক দেওয়ার ক্ষমতা স্বামীর ব্যতীত অন্য কারো নেই । অবশ্য স্বামী কাউকে ( স্ত্রী বা অন্য কাউকে) তালাক দেওয়ার ক্ষমতা দিলে সে তালাক দিতে পারে ।
৯. হায়েজ নেফাস অবস্থায় তালাক দিলে তালাক হয়ে যায় । তবে হায়েজ নেফাস অবস্থায় তালাক দেওয়া গুনাহ ।
১০. একসঙ্গে তিন তালাক দেওয়া হারাম ও গুনাহে কবিরা । তবে একসঙ্গে তিন তালাক দিলেও তিন তালাক হয়ে যাবে এবং স্ত্রী তার জন্য সম্পন্ন হারাম হয়ে যাবে । এমতাবস্থায় নিয়ম মাফিক অন্য স্বামীর ঘর হয়ে ঘুরে না আসলে আর তাকে স্ত্রী হিসেবে রাখার বা বিয়ে করার উপায় থাকবে না ।
১১. কারো চাপ ,জোর জবরদস্তি বা হুমকির মুখে তালাক দিলেও তালাক হয়ে যাবে ।
( আহকামে জিন্দেগি , পৃষ্ঠা নং ৪২৪-২৫ )
ইদ্দত মূলত কি ?
স্ত্রী তালাকপ্রাপ্তা হলে বা তার স্বামীর মৃত্যু হলে যে সময়ের জন্য উক্ত স্ত্রীকে এক বাড়িতে থাকতে হয় , অন্যত্র যেতে পারে না ,বা অন্য কোথাও বিয়ে বসতে পারে না তাকেই মূলত ইদ্দত বলে । ইদ্দতের মাসআলা মাসায়েল নিচে উল্লেখ করা হলো ।
ইদ্দতের মাসয়ালা মাসায়েল
১. স্ত্রী তালাকপ্রাপ্ত হলে তালাকের তারিখের পর পূর্ণ তিন হায়েজ অতিবাহিত না হওয়া পর্যন্ত উক্ত স্ত্রীর পক্ষে অন্য কোথাও বিয়ে বসা হারাম ।
২. উক্ত ইদ্দতের সময়ে তাকে স্বামীর বাড়িতে নির্জন বাসস্থানে থাকতে হবে ।
৩. উক্ত স্ত্রী বয়স কম হওয়ার কারণে বা বৃদ্ধ হওয়ার কারণে হায়েজ না আসলে তিন হায়েজের পরিবর্তে পূর্ণ তিন মাস উপরোক্ত নিয়মে ইদ্দত পালন করতে হবে ।
৪. গর্ভাবস্থায় তালাক হলে সন্তান প্রসব হওয়া মাত্রই ইজ্জত শেষ হয়ে যাবে । তাই যত দ্রুত প্রসব হোক না কেন ।
৫. হায়েজের অবস্থা তালাক হলে সে হায়েজকে ইদ্দতের মধ্যে ধরা যাবে না । সে হায়েজ বাদ দিয়ে পরবর্তী তিন হায়েজ ইদ্দত পালন করতে হবে ।
৬. যদি কোন স্ত্রীর সাথে স্বামীর সহবাস বা নির্জন বাস হওয়ার পূর্বে স্বামী তাকে তালাক দিয়ে দেয় তাহলে তাকে ইদ্দত পালন করতে হয় না ।
৭. তালাকে বায়েন হলে ইদ্দত পালন করার সময় ( পূর্ব) স্বামী থেকে সতর্কতার সাথে পূর্ণ মাত্রায় পর্দা রক্ষা করে চলতে হবে । তবে স্বামী কর্তৃক অবৈধভাবে আক্রান্ত হওয়ার প্রবল আশঙ্কা থাকলে সেখান থেকে সরে অন্যত্র গিয়ে ইদ্দত পালন করাই সমীচীন হবে ।
৮. কোন বিয়ে যদি অবৈধ হয় এবং সহবাস হয় তাহলে ওই পুরুষ যখন তাকে পরিত্যাগ করবে তখন থেকে ইদ্দত পালন করতে হবে ।
৯. যে স্ত্রীর স্বামী মারা যায় তার ইদ্দত হল চার মাস দশ দিন । আর গর্ভবতী হলে তার ইদ্দত সন্তান প্রসব হওয়া পর্যন্ত ।
১০. স্বামীর মৃত্যু হলে মৃত্যু কালে স্ত্রী যে বাড়িতে ছিল ইদ্দত পালন করার সময় রাত দিন সে বাড়িতেই থাকবে । অবশ্য গরিব হলে এবং বাইরে গিয়ে কাজকর্ম ব্যতিরেকে খাওয়া পরার ববস্থা না থাকলে দিনের বেলায় কাজের জন্য বাইরে যেতে পারবে । কিন্তু রাতের বেলায় সে বাড়িতেই থাকতে হবে । বাড়িতে নিজেদের একাধিক ঘর বা একাধিক কামরা থাকলে যে কোন ঘর বা যে কোন কামড়ায় থাকতে পারবে । বাড়ির বারান্দা বা উঠানেও বের হতে পারবে ।
১১. স্বামীর মৃত্যু চাঁদের প্রথম তারিখে হলে চাঁদের হিসেবে চার মাস দশ দিন ধরা হবে । আর চাঁদের প্রথম তারিখ ছাড়া অন্য যেকোনো তারিখের মৃত্যু হলে ৩০ দিনের পর চার মাস এবং তারপর দশ দিন অর্থাৎ ১৩০ দিন বিদ্যুৎ পালন করতে হবে । স্ত্রী ঋতুবর্তী বা গর্ভবতী না হলে যদি থাকে তালাক দেওয়া হয় ,তাহলে চাঁদের প্রথম তারিখে তালাক হলে চাঁদের হিসেবে তিন মাস আর অন্য তারিখে তালাক হলে ৩০ দিনের ৩ মাস অর্থাৎ ৯০ দিন ইদ্দত ধরা হবে ।
১২. স্বামী মৃত্যু সংবাদ পেতে দেরি হলে সংবাদ পাওয়ার পূর্বে যে সময় অতিবাহিত হয়েছে সেটাও ইদ্দতের ভেতর অবিবাহিত হয়েছে ধরা হবে । আর ইদ্দতের পূর্ণ সময় অতিবাহিত হওয়ার পর সংবাদ পেলে আর তাকে ইদ্দল করতে হবে না । তার ইদ্দত পূর্ণ হয়ে গেছে ধরা হবে ।
গ্রন্থনা: মাওলানা শরিফ আহমাদ
লেখক ও শিক্ষক
1 thought on “তালাক দেওয়ার নিয়ম মাওলানা শরিফ আহমাদ”
Comments are closed.