জাহান্নাম থেকে মুক্তির উপায় 2024 | মাওলানা শরিফ আহমাদ

জাহান্নাম থেকে মুক্তির উপায় নিয়ে আজ আমি মাওলানা শরিফ আহমাদ এর গ্রন্থনায় আলোচনা করব। আশা করি এ সংক্রান্ত অধ্যয়ন আপনাদের অনেক ভাল লাগবে এবং আমল করার চেষ্টা করলে সহজেই জাহান্নাম থেকে মুক্তি পেতে পারেন। 

জাহান্নাম থেকে মুক্তির উপায় 2024 | মাওলানা শরিফ আহমাদ
জাহান্নাম থেকে মুক্তির উপায় 2024 | মাওলানা শরিফ আহমাদ

জাহান্নামের পরিচয়:

জাহান্নাম একটি আরবী শব্দ। শব্দটির অর্থ হল শাস্তির জায়গা ,দুঃখময় স্থান । পবিত্র কোরআনে বর্ণিত জাহান্নামের সমার্থক শব্দে আন নার ( النار ) ব্যবহার করা হয়েছে ।

জাহান্নামকে ফার্সিতে বলে দোযখ আর ইংরেজিতে বলে Hell , জাহান্নামের প্রতি বিশ্বাস রাখা ঈমানের একটি অন্যতম শাখা । জাহান্নামে পাপীরা চিরকাল আজাব ভোগ করবে । জাহান্নাম সম্পর্কে অসংখ্য আয়াত ও অগণিত হাদীস রয়েছে ।

আরো পড়ুনঃ আল্লাহর নৈকট্য লাভের উপায় মাওলানা শরিফ আহমাদ

সাতটি জাহান্নামের নাম:

নিচে সাতটি জাহান্নামের নাম উল্লেখ করা হলো।

  • ১. জাহান্নাম। ( সুরা আল বাকারা,২:২০৬)
  • ২. হাবিয়াহ। (সুরা আল কারিয়া,১০১:৮–৯)
  • ৩.জাহীম । ( সুরা আল বাকারা,২:১১৯)
  • ৪. সাকার। ( সুরা আল মুদ্দাসসির,৭৪:২৬–২৮)
  • ৫.সায়ীর । ( সুরা আন নিসা,৪:১০)
  • ৬.হুতামাহ । ( ১০৪:৪–৬ )
  • ৭. লাযা। ( সুরা আল মায়ারেজ,৭০:১৫–১৬)

আরো দেখুনঃ তালাক দেওয়ার নিয়ম মাওলানা শরিফ আহমাদ

জাহান্নামে আজাবের ধরন:

মহাগ্রন্থ আল কোরআন এবং পবিত্র হাদীসের অনেক জায়গায় জাহান্নামে আজাবের ধরণ নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।

  • ১. বিষাক্ত, দুর্গন্ধময় খাবার ও উত্তপ্ত গরম পানি পরিবেশনের মাধ্যমে আজাব দেওয়া হবে ।
  • ২. মাথায় উত্তপ্ত পানি প্রবাহিত করে আজাব দেওয়া হবে ।
  • ৩. অগ্নি নির্মিত সংকীর্ণ অন্ধকার গৃহে রেখে আজাব দেওয়া হবে ।
  • ৪. মুখ মন্ডলে অগ্নিশিখা প্রজ্বলিত করে আজাব দেওয়া হবে ।
  • ৫. গুর্জ ও হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করে আজাব দেওয়া হবে ।
  • ৬. বিষাক্ত সাপ ও বিচ্ছুর দংশনের দ্বারা শাস্তি দেওয়া হবে ।
  • ৭. দেহকে বিশাল আকৃতি করে শাস্তি দেওয়া হবে ।
  • ৮. অসহনীয় ঠান্ডা দিয়ে শাস্তি দেওয়া হবে ।
  • ৯. এছাড়া আরো অনেক রকম অজানা শাস্তির মাধ্যমে আজাব দেওয়া হবে ।

জাহান্নামের আগুন

হযরত আবু হুরায়রা রাদিআল্লাহু তা’আলা আনহু বর্ণনা করেন ,নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন ,তোমাদের এই (দুনিয়ার) আগুন জাহান্নামের আগুনের সত্তর ভাগের একভাগ উত্তাপ মাত্রা । বলা হলো হে রাসুলুল্লাহ ! কেন এই আগুন কি যথেষ্ট ছিল না ? নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন দুনিয়ার আগুন থেকে জাহান্নামের আগুনকে ৬৯ গুন বৃদ্ধি করা হয়েছে । এর প্রতিটি অংশ আলাদা ভাবে দুনিয়ার আগুনের সমতুল্য । ( সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৩০২৫)

আরো পড়ুনঃ টয়লেটে যাওয়ার নিয়ম মাওলানা শরিফ আহমাদ

জাহান্নামের গভীরতা

হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত । তিনি বলেন একদা আমরা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট বসা ছিলাম । হঠাৎ করে এক বিকট শব্দ শোনা গেল । অতঃপর নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন তোমরা কি জানো এটা কি ? আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু বলেন, আমরা বললাম আল্লাহ তার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অধিক ভালো জানেন । রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন এটা হল সে পাথর যা ৭০ বছর যাবত জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হচ্ছে । এইমাত্র পাথরটি গর্তের সর্বনিম্নে পৌঁছেছে । ( সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৫০৭৮)

জাহান্নামের খাদ্য যাক্কুম

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন । নবী কারীম সাল্লাল্লাহু ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যদি যাক্কুম বৃক্ষের এক ফোঁটা রস দুনিয়ার জমিনে দেওয়া হয় তাহলে তা গোটা দুনিয়াবাসীকে ধ্বংস করে দিবে । ( কারণ তার বিষক্রিয়া, দুর্গন্ধ এত বেশি ) সুতরাং যাক্কুম যাদের খাদ্য হবে তাদের (জাহান্নামীদের) অবস্থা কেমন হবে ? ( জামে তিরমিজি, হাদীস নং ২৫১০)

জাহান্নাম থেকে মুক্তির উপায়:

জাহান্নাম থেকে মুক্তির উপায় হলো ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের উপর আমল করা । স্তম্ভ পাঁচটি হলো এই–

  • ১. কালিমা বা ঈমান ।
  • ২. নামাজ কায়েম করা ।
  • ৩. যাকাত প্রদান করা ।
  • ৪. হজ্জ করা ।
  • ৫. রমজানে রোজা রাখা ।

আরেকটু সহজ করে এভাবে বলা যায় , জীবনের প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে আল্লাহর বিধান এবং নবীজির সুন্নাহ মেনে চলার মাধ্যমেই জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব । এছাড়াও হাদীসে বর্ণিত বেশ কিছু আমলের মাধ্যমেও জাহান্নাম থেকে রেহাই পাওয়া যাবে । নিচে জাহান্নাম থেকে মুক্তির উপায় নিয়ে ধারাবাহিকভাবে হাদীসগুলো উল্লেখ করা হচ্ছে ।

১. হজরত মুসলিম ইবনে হারেস তামিমি রাদিআল্লাহু আনহু বলেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে কানে কানে বললেন, মাগরিবের নামাজের যখন সালাম ফেরাবে তখন কারো সঙ্গে কথা বলার পূর্বে এই দুআটি সাত বার পড়বে। যদি তুমি তা পড় আর ওই রাতেই তুমি মারা যাও তাহলে তোমার জন্য জাহান্নাম থেকে মুক্তির ফায়সালা লিখে দেয়া হবে। আর ফজরের নামাজের পরও এ দুআটি একই নিয়মে সাতবার পড়বে। যদি তুমি তা পড়ে থাক আর ওই দিনেই তুমি মারা যাও তাহলে তোমার জন্য জাহান্নাম থেকে মুক্তির ফায়সালা লিখে দেয়া হবে। (আবু দাউদ: হাদীস নং ৫০৮১ সুনানে কুবরা: হাদীস নং ৯৯৩৯ সহীহ ইবনে হিব্বান: হাদীস নং ২০২২) নিম্নের দোয়াটি জাহান্নাম থেকে মুক্তির উপায় হিসেবে স্বীকৃত।

দোয়াটি হলো– اللَّهُمَّ أَجِرْنِى مِنَ النَّارِ

অনুবাদ: হে আল্লাহ ! আমাকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করুন ৷

২. হযরত আবু উমামা রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত । রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি প্রতি ফরজ নামাজের পর আয়াতুল কুরসী পাঠ করবে সে মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে জান্নাতে প্রবেশ করবে । ( সুনানে নাসায়ী, হাদীস নং ১০০)

৩. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি একমাত্র আল্লাহ তাআলাকে সন্তুষ্ট করার উদ্দেশ্যে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলে কেয়ামতের দিন সে এমন ভাবে উপস্থিত হবে যে তার ওপর জাহান্নাম হারাম । ( মুসনাদে আহমদ, হাদীস নং ১৪৬৮২)

৪. রাসূল সাল্লাল্লাহু ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, কেউ যদি প্রত্যেক ফরজ নামাজের পর ৩৩ বার সুবহানাল্লাহ ৩৩ বার আলহামদুলিল্লাহ ৩৩ বার আল্লাহু আকবার পাঠ করে এরপর একবার পাঠ করে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা শারিকালাহু লাহুল মুলকু ওয়ালাহুল হামদু ওহুয়া আলা কুল্লি শাইয়িন কাদির । এই দোয়াটি পড়লে জাহান্নাম থেকে মুক্তির উপায় পাওয়া যায়।

ওই ব্যক্তির সমস্ত পাপ মাফ করে দেওয়া হবে যদিও তার সাগরের ফেনা সমতুল্য হয় । ( সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১২৩৯)

এছাড়াও জাহান্নাম থেকে মুক্তির উপায় নিয়ে হাদীসে অনেক কথা আলোচিত হয়।

৫. হযরত আনাস ইবনে মালেক রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত । নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, কোন ব্যক্তি যদি জান্নাতের জন্য আল্লাহর কাছে তিনবার প্রার্থনা করে, তাহলে জান্নাত তখন বলে হে আল্লাহ ! তাকে জান্নাতে প্রবেশ করান । আর কোন ব্যক্তি তিন বার জাহান্নাম থেকে আশ্রয় চাইলে জাহান্নাম তখন আল্লাহর কাছে বলে হে আল্লাহ ! তাকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিন । ( জামে তিরমিজি, হাদীস নং ২৫৭২)

৬. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, তোমরা জাহান্নাম থেকে বাঁচো যদিও খেজুরের এক টুকরা সদকা করে হয় । আর যে ব্যক্তি এর সামর্থ্য রাখে না সে যেন ভালো কথা বলে ‌।( সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৪১৩)

৭. আসমা বিনতে ইয়াজিদ রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহা থেকে বর্ণিত । যে ব্যক্তি তার মুসলিম ভাইয়ের অনুপস্থিতিতে তার সম্ভ্রম রক্ষা করে ,সে আল্লাহর কাছে অধিকার পায় যে তিনি তাকে দোযখ থেকে মুক্তি দেন । ( মুসনাদে আহমদ ,সহীহুল জামে, হাদীস নং ৬২৪০)

৮. হযরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহা থেকে বর্ণিত । রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আদম সন্তানের মধ্যে প্রত্যেক মানুষকে ৩৬০ টি গ্রন্থির ওপর সৃষ্টি করা হয়েছে । ( আর প্রত্যেক গ্রন্থির পক্ষ থেকে প্রদেয় সদকা রয়েছে ) সুতরাং যে ব্যক্তি আল্লাহু আকবার বলল, আলহামদুলিল্লাহ বলল, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বললো ,সুবহানাল্লাহ বলল, আসতাগফিরুল্লাহ বলল, মানুষ চলার পথ থেকে পাথর কাটা অথবা হাড় সরালো কিংবা ভালো কাজের আদেশ করলো অথবা মন্দ কাছ থেকে নিষেধ করল ,( এবং সব মিলিয়ে ৩৬০ টি নেক কাজ করলো )

সে ঐদিন এমন অবস্থায় সন্ধ্যা যাপন করলো যে সে নিজেকে জাহান্নামের আগুন থেকে দূর করে নিল । ( সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২২২০)

৯. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি ধারাবাহিকভাবে জোহরের আগে চার ও পরে চার রাকাত নামাজ আদায় করবে মহান আল্লাহ তার জন্য জাহান্নাম হারাম করে দেবেন । ( ইবনে মাজাহ, হাদীস নং ১১৬০, আবু দাউদ, হাদীস নং১২৬৯)

১০.আবু বকর ইবনে শায়বা ,আবু কুরাইব ও ইসহাক ইবনে ইব্রাহিম বলেন, আবু বকর ইবনে উমর ইবনে রুয়াইবা রহ: তার পিতার সূত্রে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি,মে ব্যাক্তি সূর্যোদয়ের ও সূর্যাস্তের আগে ফজর ও আসরের নামাজ আদায় সে কখনো জাহান্নামে প্রবেশ করবে না। তখন বসরার এক ব্যাক্তি তাকে বললেন এটা কি আপনি নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছেন?

তিনি বলেন হ্যাঁ । তখন ঐ ব্যক্তি বলল, আমি এই মর্মে সাক্ষ্য দিচ্ছি যে আমি নিজ কানে তা নবীজির কাছ থেকে শুনেছি এবং আমার হৃদয়ে তা গেঁথে রেখেছি। ( সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১৩১১)

১১. হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিআল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,আমি কি তোমাদের জানিয়ে দেবো না , কোন ব্যাক্তির জন্য জাহান্নাম হারাম এবং জাহান্নামের জন্য কোন ব্যাক্তি হারাম? মে ব্যাক্তি মানুষের কাছাকাছি ( জনপ্রিয়), সহজ-সরল, নম্রভাষী ও সদাচারী ( তার জন্য জাহান্নাম হারাম ) (জামে তিরমিজি , হাদীস নং ২৮৮৮)

গ্রন্থনা: মাওলানা শরিফ আহমাদ, লেখক ও শিক্ষক

শেষকথাঃ

উপরের আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, মাওলানা শরিফ আহমাদ জাহান্নাম থেকে মুক্তির উপায় নিয়ে বিস্তারিত উপস্থাপন করা হয়েছে। আশা করি উপরিউক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে আল্লাহর নিকট বেশি বেশি দোয়া চাইবেন।