কবিদের বর্ষাপ্রীতি সাহিত্যের নতুন দিগন্ত
— শরিফ আহমাদ
সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি ৷ আর কবি মানেই বটগাছের মতো মাথাভর্তি চুল ও ইয়া বড় বড় দাঁড়ি গোফওয়ালা কেউ নয় ৷ কবি মানেই স্মার্ট-রুচিশীল ব্যক্তি ৷ কবি মানেই ভাবের সম্রাট ৷ শব্দ শ্রমিক ৷ কথার কারিগর ৷
কবিরা লিখেন সব বিষয়ে ৷ সবকে নিয়ে ৷ ঋতু কেন্দ্রিক রচনাও অঢেল ৷ চিরসবুজ বাংলাদেশে বর্ষাকালে প্রকৃতির বুকে যেভাবে কিশোরী অবয়বসম লাবণ্য নিয়ে জেগে ওঠে বারো মাসের ষড় ঋতুর আর কোনটিতেই এমনটি দেখা যায় না। বসন্ত ও বর্ষা নিয়ে বাংলা সাহিত্যের লেখকরা যত রূপে লিখেছেন তা আর কোন ঋতু নিয়ে ততটা লেখেননি। প্রবল বিশ্বাস বর্ষা-ঋতু বাংলার কবিদের মন ও মননকে অন্দোলিত করেছে অনন্য এক আলোড়নে।
উভয় বাংলার কবিরা যদিও বাস্তবতার নিরিখে ,কল্পনার রঙ মিশিয়ে কবিতা লিখেছেন দুর্দম গতিতে তবু বর্ষার আবেদন অন্য যে কোন ঋতুর চেয়ে অন্যরকম। বর্ষায় কবি যেন নেচে ওঠেন রিমঝিম ছন্দে ৷ সেজে ওঠেন ময়ূরীর মতো। কবি যেন পেখম মেলে লিখতে বসেন বর্ষার বৃষ্টি, মেঘ, আলো-অন্ধকার, কাদা, মেঠোপথ, নদীর থৈ থৈ জল, নৌকোর ঘাঁট, বাড়ন্ত জল, মৃদু মৃদু ঢেউ নিয়ে ৷
বাংলার কবি যেন বর্ষার আবেশ পেলে যুগের ঘুম ভেঙ্গে জেগে ওঠেন অদম্য এক যৌবনে। দিনের পর দিন, রাতের পর রাত জেগে প্রতিটি অণুক্ষণ ধারণ করেন মনের ডায়েরীতে ৷ দৃষ্টির ফিল্মে । তারপর জাবর কাটার মতো শব্দে বাক্যে পয়ারে-নানান ছন্দ তালে-রূপ রস গন্ধ মিলিয়ে ব্যক্ত করেন দৃষ্টিগত রূপের বৈচিত্র।
পত্র-পত্রিকা কিংবা বইয়ের পাতায় বর্ষা যেন নৃত্যকলায় ব্যস্ত ৷ সে যেন তার রিনিঝিনি শব্দে প্রকৃতির মনকে কখনও আনন্দে সিক্ত করে, কখনো বেদনা রিক্ত করে আবার কখনও বিরহকাতর করে তোলে ৷ প্রকৃতির সে ভাব কবি অবলোকন করেন একচোখে, তারপর সে ভাব ভর করে কবির সরল মানসপটে। সেখান থেকে কবি তা তুলে আনেন কলমের কালিতে। প্রকৃতি কবিকে যেভাবে প্রেরণ করে তার গন্ধ কবি সেভাবেই তা ছড়িয়ে দেন কালো অক্ষরের রাজ্যে ৷ আনন্দ যেন আর ধরে না! তাইতো ছড়া কবিতায় পাওয়া যায় বৃষ্টিভেজা কদম ফুল কুড়ানো ও মেঘের মালা গাঁথার কথা । কখনো ঝড়ের তোড়ে ছিন্ন মালার বেদনায় নীল হয়ে কুঁকড়ে ওঠার স্মৃতি । বর্ষা ঘিরে এ সুধা রচনার আনন্দ থেকে ফিরে থাকতে পারেননি আদিযুগ থেকে মধ্যযুগ, মধ্যযুগ থেকে আধুনিক, আধুনিক থেকে সময়ের কোন কবিই। সব যুগে সব সময়ে বর্ষা তার অপরূপ রূপের ছুরি নিয়ে হানা দিয়েছে প্রেমিক কবির মনে। কবিরাও অপরূপ রূপের দেবী বর্ষার ছুরিতে খুন হতে চেয়েছেন বারে বারে।
আধুনিক বাংলা সাহিত্যে আরও সম্িদ হচ্ছে ৷ এযুগের কবিরা নিত্য নতুন স্টাইলে কবিতা ছড়ার ফুল ফুটিয়ে চলেছেন ৷ প্রতিবছর বইমেলা কেন্দ্রিক প্রকাশিত বই, বিভিন্ন নথি-ম্যাগাজিনের পাতা আর ফেসবুকের নিউজ ফ্রীডে বিষয়টি স্পষ্ট ৷ বর্ষা প্রীতিতে সাহিত্যের নতুন সৃজনগুলো টিকে থাকবে কিনা সময়ই বলে দেবে ৷ তবে একথা সত্য যে,
চিরকালই কবিদের বর্ষা বন্দনায় ফুটে উঠেছে গ্রাম-বাংলার বর্ষার মোহিনী রূপ। ব্যক্ত হয়েছে অনেক কিছু বিষয় ৷ অব্যক্ত রয়ে গেছে আরও বেশি ৷ তবুও কবি ও কবিতাকে মানুষ ভালোবেসেছে অনন্ত কাল। আর যুগে যুগে কবিরা সে ভালোবাসার চিহ্ন রেখে যান ৷