হাদিয়া বা উপহার দেয়া-নেয়ার শরঈ বিধান | দীদার মাহদী | শীর্ষবার্তা ডটকম

হাদিয়া বা উপহার দেয়া-নেয়ার শরঈ বিধান

দীদার মাহদী

হাদিয়া বা উপহার দেয়া-নেয়া উভয়ই সুন্নাহ ৷ উপহারকে ভালোবাসার নিদর্শন বলা হয় ৷ এতে যেমন কোনো শর্ত থাকে না, থাকে না স্বার্থও ৷ এটা সাদকার সমতুল্য ৷ এমনকি শ্রেষ্ঠ সাদকাহ ৷ হাদিয়া দাতা ও গ্রহিতা উভয়ই সম্মানিত হয় ৷ উপহার ভালোবাসা বাড়ায় তা বিশ্বনবীর হাদীসে রয়েছে ৷ রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা হাদিয়া বা উপহার দাও, তোমাদের মধ্যে প্রীতির বন্ধন দৃঢ় হবে।’ (তিরমিজি)।

উপহারের আরেক নাম সালামি

ঈদে ছোটদের আনন্দের অন্যতম অনুষঙ্গ থাকে সালামি ৷ কে কত সালামি পেলো তারও চলে প্রতিযোগিতা ৷ ঈদ ছাড়া বিশেষ কোনো অনুষ্ঠানে ছোটরা বড়দের সালাম দিয়ে সৌজন্য সাক্ষাত করে ৷ ছোটদের খুশি করতে তখন বড়রা টাকা বা অন্যান্য উপহার সামগ্রী দেন ৷ এটাই সালামি ৷ সুসম্পর্ক ও স্নেহ বৃদ্ধিতে সালামি দেয়াতে কোনো দোষ নেই ৷

হাদিয়া কোনো ঋণ নয়, নয় পাওনাও ৷

হাদিয়া বা উপহার খুশিমনে দেয়া হয় ৷ এটা চেয়ে নেয়ার কিছু নয় ৷ নয় ঋণ ৷ হাদিয়া দেয়া সুন্নাহ ৷ গ্রহণ করাও সুন্নাহ ৷ হাদিয়া দেয়ার জন্য বিশেষ কোনো প্রোগ্রামের প্রয়োজন নেই ৷ আবার প্রোগ্রামে হাদিয়া দিতেও বাধা নেই ৷ এটা আন্তরিকতার বিষয় ৷ চলমান সময়ে বিয়ে বা আকীকার অনুষ্ঠানে উপহার গ্রহণের টেবিল পাতা হয় ৷ এটা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না যে, সবাই খুশিমনে সেখানে উপহার দিচ্ছে না ৷ বরং বাধ্য হয়েই দেয় ৷ যা জায়েজ নয় ৷ চাপ ক্রিয়েট করে, প্রেসার দিয়ে এভাবে উপহার নেয়ার বৈধতা নেই ৷ যারা দিচ্ছে তারা ভাবছে, আমাদের বিয়েতেও তাকে দাওয়াত করলে উসুল হয়ে যাবে ৷
উপহার কোনো বিনিয়োগ বা ঋণদান নয়। যিনি কাউকে কোনো উপলক্ষে উপহার বা হাদিয়া দিলেন, তাঁর কখনো এমন আশা পোষণ করা সমীচীন হবে না যে ওই ব্যক্তি আমার বা আমাদের কোনো অনুষ্ঠান উপলক্ষে অনুরূপ হাদিয়া বা উপহার দেবেন। উপহার বা হাদিয়া কোনো পাওনা বিষয় নয় যে কেউ না দিলে মন খারাপ করতে হবে। এই যে নগ্ন প্রতিযোগিতা তা বৈধ নয় ৷ পবিত্র কুরআন বলছে,

وَ مَاۤ اٰتَیۡتُمۡ مِّنۡ رِّبًا لِّیَرۡبُوَا۠ فِیۡۤ اَمۡوَالِ النَّاسِ فَلَا یَرۡبُوۡا عِنۡدَ اللّٰہِ ۚ وَ مَاۤ اٰتَیۡتُمۡ مِّنۡ زَکٰوۃٍ تُرِیۡدُوۡنَ وَجۡہَ اللّٰہِ فَاُولٰٓئِکَ ہُمُ الۡمُضۡعِفُوۡنَ ﴿۳۹﴾

আর তোমরা যে সূদ দিয়ে থাক, মানুষের সম্পদে বৃদ্ধি পাওয়ার জন্য তা মূলতঃ আল্লাহর কাছে বৃদ্ধি পায় না। আর তোমরা যে যাকাত দিয়ে থাক আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করে (তাই বৃদ্ধি পায়) এবং তারাই বহুগুণ সম্পদ প্রাপ্ত।
[সূরা রূম, আয়াত ৩৯]

অনেক সময় মনে কষ্ট নিয়েই এইসব উপহার দেয়া হয় ৷ বিয়েতে উপহার দেয়া লাগবে এই ভয়ে অনেক বিয়ের দাওয়াত এড়িয়ে চলে ৷ আমরা কুরআনের আরেকটি আয়াতের দিকে লক্ষ্য করি ৷ কুরআন বলছে,

قَوۡلٌ مَّعۡرُوۡفٌ وَّ مَغۡفِرَۃٌ خَیۡرٌ مِّنۡ صَدَقَۃٍ یَّتۡبَعُہَاۤ اَذًی ؕ وَ اللّٰہُ غَنِیٌّ حَلِیۡمٌ ﴿۲۶۳﴾

উত্তম কথা ও ক্ষমা প্রদর্শন শ্রেয়, যে দানের পর কষ্ট দেয়া হয় তার চেয়ে। আর আল্লাহ অভাবমুক্ত, সহনশীল।
সূরা বাকারা, আয়াত 263]

হাদিয়া বা উপহার দিতে হবে নিঃস্বার্থভাবে ৷ পরবর্তীতে এই নিয়ে খোঁটা দেয়া যাবে না ৷
কুরআন বলছে,

اَلَّذِیۡنَ یُنۡفِقُوۡنَ اَمۡوَالَہُمۡ فِیۡ سَبِیۡلِ اللّٰہِ ثُمَّ لَا یُتۡبِعُوۡنَ مَاۤ اَنۡفَقُوۡا مَنًّا وَّ لَاۤ اَذًی ۙ لَّہُمۡ اَجۡرُہُمۡ عِنۡدَ رَبِّہِمۡ ۚ وَ لَا خَوۡفٌ عَلَیۡہِمۡ وَ لَا ہُمۡ یَحۡزَنُوۡنَ ﴿۲۶۲﴾

যারা আল্লাহর রাস্তায় তাদের সম্পদ ব্যয় করে, অতঃপর তারা যা ব্যয় করেছে, তার পেছনে খোঁটা দেয় না এবং কোন কষ্টও দেয় না, তাদের জন্য তাদের রবের নিকট তাদের প্রতিদান রয়েছে এবং তাদের কোন ভয় নেই, আর তারা চিন্তিত হবে না।
[সূরা বাকারা, আয়াত 262]
হাদিস শরিফে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘খোঁটাদানকারী বেহেশতে প্রবেশ করতে পারবে না।’ (মুসলিম)।

হাদিয়া কী হবে?

হাদিয়া বা উপহার হতে পারে স্মৃতিস্মারক ৷ হতে পারে প্রয়োজনীয় ব্যবহার্য বস্তু ৷ হতে পারে জীবনচলার সহায়ক। হাদিয়া বা উপহার কী হবে তা দাতার ইচ্ছা, রুচি ও সামর্থ্যের ওপরেই নির্ভর করে। কিন্তু যাকে হাদিয়া বা উপহার দেওয়া হবে, তার প্রয়োজনীয়তা, চাহিদা ও রুচি বিবেচনা করাও বাঞ্ছনীয়। কারণ, উপহারসামগ্রীর মালিকানা ও ব্যবহারকারী তিনিই হবেন, যিনি বা যাঁকে কেন্দ্র করে উপহার দেওয়া হয়েছে।

যার হাদিয়া গ্রহণ করা যাবে না ৷

অনেক লোক সরাসরি হারাম উপার্জনে লিপ্ত। তার অন্য কোনো বৈধ উপার্জন নেই। তাহলে এমন ব্যক্তির আর্থিক সাহায্য বা হাদিয়া হারাম থেকে হয়েছে বলেই প্রতীয়মান হবে। তাই তার আর্থিক সাহায্য বা হাদিয়া গ্রহণ করা হারাম হবে। কেননা, আল্লাহ তাআলা কেবল হালাল ভক্ষণ করতে নির্দেশ দিয়েছেন।
আল্লাহ তাআলা বলেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا كُلُوا مِنْ طَيِّبَاتِ مَا رَزَقْنَاكُمْ
”হে ঈমানদারগণ! তোমাদেরকে আমি যে রিজিক দিয়েছি তাত্থেকে হালালগুলো ভক্ষণ করো”। (সূরা বাকারা : ১৭২)

রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,

إِنَّ الْحَلاَلَ بَيِّنٌ وَإِنَّ الْحَرَامَ بَيِّنٌ وَبَيْنَهُمَا مُشْتَبِهَاتٌ لاَ يَعْلَمُهُنَّ كَثِيرٌ مِنَ النَّاسِ فَمَنِ اتَّقَى الشُّبُهَاتِ اسْتَبْرَأَ لِدِينِهِ وَعِرْضِهِ وَمَنْ وَقَعَ فِى الشُّبُهَاتِ وَقَعَ فِى الْحَرَامِ

”নিশ্চয় হালাল স্পষ্ট; হারামও স্পষ্ট। হালাল ও হারামের মাঝে অনেক সন্দেহযুক্ত বিষয় রয়েছে যা অনেক মানুষই জানে না। সন্দেহযুক্ত বিষয় থেকে বিরত থাকলে তার দীন ও সম্মান হেফাজতে থাকবে। পক্ষান্তরে সন্দেহযুক্ত বিষয়াবলিতে লিপ্ত হলে সে যেন হারামেই লিপ্ত হল…।” (সহিহ মুসলিম ৪১৭৮)

তবে তার যদি অবৈধ উপার্জনের পাশাপাশি বৈধ উপার্জনও থাকে তখন এ সাহায্য বা হাদিয়া বৈধ উপার্জন থেকেও হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আবার অবৈধ উপার্জন থেকেও দিতে পারে। তাই তখন তার সাহায্য বা হাদিয়া গ্রহণ করা জায়েয হলেও অনুত্তম।

ইবনে মাসঊদ (রাঃ) বলেন, তার নিকটে জনৈক ব্যক্তি এসে বলল, আমার একজন প্রতিবেশী আছে যে সূদ খায় এবং সর্বদা আমাকে তার বাড়িতে খাওয়ার জন্য দাওয়াত দেয়। এক্ষণে আমি তার দাওয়াত কবুল করব কি? জওয়াবে তিনি বললেন, مَهْنَأَهُ لَكَ وَإِثْمُهُ عَلَيْهِ ‘তোমার জন্য এটি বিনা কষ্টের অর্জন এবং এর গোনাহ তার উপরে’। (মুসান্নাফ আব্দুর রাযযাক ১৪৬৭৫)

Leave a Comment