মানুষ হত্যার কারণ ও প্রতিকার | শরিফ আহমাদ | শীর্ষবার্তা ডটকম


— শরিফ আহমাদ ||

দৈনিক পত্র-পত্রিকা কিংবা অনলাইনে চোখ দিলেই ভাসে মানুষ হত্যার খবর ৷
দেশের অভ্যন্তরে এবং সীমান্তে চলে মানুষ হত্যার মহড়া ৷ প্রতিবেশী রাষ্ট্র প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভঙ্গ করে ৷ বন্ধ করে না মানুষ হত্যা ৷ প্রদর্শিত হয় নির্মম ও নিষ্ঠুরতার ভয়াবহ চিত্র ৷ যেন মানুষ পশুর চেয়ে অধম ৷ অথচ মহান আল্লাহ তায়ালা মানুষকে মুহাব্বত করে সৃষ্টি করেছেন ৷ মানুষকে করেছেন শ্রেষ্ঠ মাখলুক ৷ তাদেরকে দিয়েছেন মানানসই অবয়ব ৷ সবচে সুন্দর আকৃতি ৷ কুরআনে এসেছে,আমি সৃষ্টি করেছি মানুষকে সুন্দরতর অবয়বে।’ (সূরা: ত্বিন, আয়াত: ৪)।
মানব সৃষ্টির ব্যাপারে ফেরেশতাদের প্রবল আপত্তি ছিলো ৷ ছিলো অনেক যুক্তি ৷ তিনি তাদের আপত্তি এবং যুক্তি উপেক্ষা করেছেন ৷ মানুষকে এই জমিনে তাঁর প্রতিনিধি হিসাবে প্রেরণ করেছেন ৷ ফেরেশতাদের লক্ষ করে কুরআনুল কারীমে ঘোষণা দিয়েছেন।
নিঃসন্দেহে আমি জানি, যা তোমরা জানো না।’ (সূরা: বাকারা, আয়াত: ৩০)
শুধু তাই নয়, আল্লাহর সুস্পষ্ট অন্য একটি বাণী হচ্ছে, বিশ্বজগতের সবকিছু তিনি সৃষ্টি করেছেন শুধু মানুষের জন্য। আল্লাহ ইরশাদ করেন, তিনিই সেই সত্তা যিনি সৃষ্টি করেছেন তোমাদের জন্য জমিনের সবকিছু। (সূরা বাকারা,আয়াত: ২৯)আল্লাহ তায়ালা শুধু মানুষই সৃষ্টি করেই ক্ষ্যান্ত হননি ৷ বরং তিনি মানবজাতির সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছেন। একজন মানুষের জীবন, সম্পদ, মানসম্মান আল্লাহর কাছে এত দামি যে, কোরআন ও হাদিসে এসব বিষয়ের সুরক্ষা ও নিরাপত্তার ব্যাপারে অত্যন্ত কঠোর সব নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।

তিনি এতোকিছু কেন দিয়েছেন? কেনইবা ভালোবেসে সৃষ্টি করেছেন? কী তার উদ্দেশ্যে ছিলো কুরআনে তার ষ্পষ্ট বিবরণ এসেছে,
আমি জিন ও মানবজাতিকে শুধুমাত্র আমার ইবাদত ছাড়া অন্য কোনো উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করিনি। (সুরা যারিয়াত : আয়াত ৫৬) আর ইবাদত হলো আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের নির্দেশিত পথে ও মতে জীবন পরিচালনা করা। আল্লাহ নির্দেশিত পথে জীবন পরিচালনাই হলো মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্য আর নির্দেশ পালনের আমল হলো ইবাদত।
মানুষ যখন সেই ইবাদাতের কথা ভুলে যায়, দীন থেকে দূরে সরে যায় ৷ তখনই সে আল্লাহর রহমত থেকে ছিটকে পড়ে ৷ মন্দের মূল তিনটি বিষয় এবং শাখা ছয়টি তাদের অন্তর ঘিরে রাখে ৷ মূল তিনটি হলো –
১) হিংসা-বিদ্বেষ,
২) লোভ-লালসা এবং
৩) দুনিয়ার প্রতি ভালোবাসা।
আর শাখা ছয়টি হলো –
১) নিদ্রা,
২) পেট ভরে খাওয়া,
৩) আরাম-আয়েশ,
৪) নেতৃত্ব,
৫) প্রশংসা পাওয়া
৬) গর্ব-অহংকারের প্রতি আকর্ষণ ও ভালোবাসা।
উপরোক্ত ছয়টি বিষয় কারো মাঝে বিদ্যমান থাকলে সে প্রকৃত মানুষ থাকে না ৷ হয়ে যায় নিকৃষ্ট জানোয়ারের মতো ৷ ফলে মানুষ হত্যাসহ কোন অপরাধ করতে পিছপা হয় না ৷ বুঝা গেলো শরীরের হাত, পা ,চোখ ,কান ইত্যাদি ঠিক হলেই কেউ মানুষ হয় না ৷ সত্যিকার মানুষ হতে ইনসানিয়াত লাগে ৷ আল্লাহ ভীতি প্রয়োজন ৷
তাই একথা জোর গলায় বলা যায়, শুধু সাংবিধানিক আইন দিয়ে নয় ইসলাম দিয়েই সমস্ত অপরাধ বন্ধ করা সম্ভব ৷ আল্লাহ ভীতি দিয়ে অন্যায়ের প্রতিকার করা সহজ ৷

বিশেষ করে মানব হত্যা বিষয়ে বর্ণনাগুলো স্মরণ রাখা প্রয়োজন ৷ আল কোরআনে আল্লাহ একজন মানুষ হত্যা করাকে গোটা মানব-জাতিকে হত্যার মতো জঘন্য অপরাধ বলে আখ্যায়িত করেছে ৷
কাউকে অবৈধভাবে হত্যা করা কবিরা গুনাহের অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ তায়ালা হত্যাকারীকে জাহান্নামি ঘোষণা করেছেন। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর যে ব্যক্তি স্বেচ্ছায় কোনো মুমিনকে হত্যা করে তার শাস্তি জাহান্নাম। যাতে সে দীর্ঘকাল থাকবে, তার ওপর আল্লাহর ক্রোধ ও অভিসম্পাত। আল্লাহ তার জন্য মহাশাস্তি নির্দিষ্ট করে রেখেছেন। (সূরা: নিসা, আয়াত: ৯৩)
আল্লাহর হকের মধ্যে সর্বপ্রথম সালাত এবং বান্দার হকের মধ্য হতে সর্বপ্রথম হত্যা ও রক্তপাতের বিচার হবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, কিয়ামতের দিন মানুষের মধ্যে সর্বপ্রথম হত্যাকান্ডের বিচার করা হবে। (বুখারি ও মুসলিম )
আবু সাইদ খুদরি ও আবু হুরাইরা (রা.) বর্ণনা করেছেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আসমান-জমিনের সমস্ত অধিবাসীরা একত্রে মিলিত হয়েও যদি একজন মুমিনকে হত্যা করার কাজে অংশগ্রহণ করে, তাহলে আল্লাহ তায়ালা তাদের সকলকে উপুর করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন।’ (তিরমিযি, আসসুনান : ১৩৯৮)
মুয়াবিয়া (রা.) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘প্রতিটি গুনাহ আশা করা যায় আল্লাহ তায়ালা ক্ষমা করে দেবেন। তবে দু’টি গুনাহ আল্লাহ তায়ালা ক্ষমা করবেন না। প্রথমটি হচ্ছে, কোনো মানুষ কাফির অবস্থায় মৃত্যুবরণ করা, অপরটি হলো ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো মুমিনকে হত্যা করা।’ (নাসায়ি, আসসুনান : ৩৯৮৪)
হত্যা কাণ্ডের সহযোগীও হত্যাকারী ৷ নিহত ব্যক্তি হত্যাকারীকে সঙ্গে নিয়ে কিয়ামতের মাঠে উপস্থিত হবে ৷ হযরত ইবনু আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘কিয়ামতের দিন হত্যাকারী তার মাথার সঙ্গে নিহত ব্যক্তির মাথা লটকানো অবস্থায় উপস্থিত হবে। নিহত ব্যক্তি বলবে, হে রব! তাকে জিজ্ঞেস করুন, সে কেন আমাকে হত্যা করেছে?’ (ইবনু মাজাহ, আসসুনান : ২৬২১)
এছাড়াও আরো অসংখ্য আয়াত ও হাদীস রয়েছে ৷ ইসলামে রয়েছে একমাত্র কার্যকরী বিভিন্ন তদ্বির ৷ যা পড়ে নিজে বুঝা এবং অন্যকে বুঝানো জরুরী ৷ সঠিক বুঝ পয়দা হলে পরকালের ভয় আসবে ৷ অপরাধ বোধ জাগ্রত হবে ৷ কমে যাবে মানুষ হত্যাসহ সব অন্যায় ৷ আল্লাহ সবাইকে বুঝার তাওফিক দান করুন ৷
আমিন ৷
লেখক: আলেম, কবি ও আলোচক

Leave a Comment