ইসলামি প্রতিরোধ আন্দোলন ”হামাস” ইতিহাস-ঐতিহ্য

হামাস আরবি শব্দ। যার অর্থ হোলো আশা, উদ্দীপনা, উৎসাহ। এটা মূলত হারাকাত আল-মুকাওয়ামা আল-ইসলামিয়া, ‘ইসলামি প্রতিরোধ আন্দোলন’ এর সংক্ষিপ্ত রূপ। এই সংগঠনটির প্রতিষ্ঠা হয় ১৯৮৭ সালে। প্রতিষ্ঠা করেন শেখ আহমেদ ইয়াসিন। খুবই শিশু বয়সেই তিনি ইহুদিদের আক্রমণে পঙ্গু হয়ে যান। তবুও তিনি ফিলিস্তিনের গণ মানুষের নেতা হয়েছেন। প্রথম ইন্তিফাদার পূর্ব-অবধি এটি প্রতিরোধ আন্দোলন ছিলো না। এই সংগঠন আরবের ইখওয়ানুল মুসলিমিনের-উপমহাদেশের জামায়াতে ইসলামীর একটি শাখা।

১৯৮৭ সালের ০৯-ই ডিসেম্বরে ইসরাঈলী বর্বর কুখ্যাত সন্ত্রাসীরা ফিলিস্তিনের তিনজন নিরিহ মানুষকে গাড়ি-চাপা দিয়ে হত্যা করে। এই অমানবিক নির্যাতনের বিরুদ্ধে শুরু হয় প্রথম ইন্তিফাদা তথা জন-জাগরণ। সাধারণ মানুষের এমন শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে বর্ষার অঝোর ধারার বৃষ্টির মতো গুলি বর্ষণ করে সন্ত্রাসী ইহুদি পুলিশ-সৈন্যরা।

তো সে ইন্তিফাদার মধ্যেই ইখওয়ানুল মুসলিমিনের ফিলিস্তিন শাখার সাতজন শীর্ষ নেতৃত্ব এক বৈঠকে মিলিত হন। আরবের দিকে দিকে তখনও ইখওয়ানুল মুসলিমিন একটি জনপ্রিয় গণমানুষের সংগঠন। কিন্তু রাষ্ট্রীয় জুলুম-নির্যাতন, জুডিশিয়াল কিলিংয়ের মাধ্যমে একে একে তাদের নেতৃত্ব হত্যা-গ্রেফতারে সাধারণ মানুষ ভালোবাসলেও আগের মতো খুব একটা সক্রিয় হয়ে ভীড়ছে না সে সংগঠনে। ফিলিস্তিনের অবস্থাও তাই। কিন্তু ইসরাঈলী ইহুদীরা পুরো ফিলিস্তিনকে একটা নরকের দ্বার-কারাগারে পরিণত করে রাখছে। অবস্থা এতোটাই ভয়াবহ যে, এক গ্রামের লোক অন্য গ্রামেও যেতে পারে না। পাশের স্বজনদের সাথেও পারছে না দেখা করতে। জীবন-জীবিকা নির্বাহের কোনো উপায়-উপাদানও নেই -ইসরাঈলীদের ওপর নমণীয় হওয়া ছাড়া। মানুষের ভেতর হতাশা-ক্ষোভ সবই একদম কাণায় কাণায় পূর্ণ। এদিকে ইহুদিবাদীরা গ্রেফতার-নির্যাতন-অবরোধে-ই শুধু সীমাবদ্ধ নয়। তারা বিলাসবহুল জীবন-যাপনের লোভ, মদ, যৌনতার টোপেও ফেলার সর্বাত্মক চেষ্টা করে যায় ফিলিস্তিনের বিশেষ করে গাজার অধিবাসী যুবকদের।

এই সাধারণ মানুষের, বিক্ষুব্ধ ক্ষোভকে সঠিকভাবে সঠিক ব্যবহার করার জন্যে, কিংবা হতাশ মানুষদের হতাশা-নিরাশা থেকে যেনো ইসরাঈলীদের প্রতি নমনীয় হয়ে ঈমান বিকিয়ে না দেয় – সেজন্যে তারা সাতজন শীর্ষ নেতা মিলিত হয়ে কিছু সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এবং সাতজন-ই ঐকমত্যে পৌঁছেন যে ইখওয়ানুল মুসলিমিনকে হামাস নামে প্রতিরোধ আন্দোলনে রূপান্তর করা হবে। সে হিসেবে ১৪-১২-১৯৮৭ সালে সর্বপ্রথম তাঁরা নিজেদের কর্মসূচি ঘোষণা করে।

সংগঠন হিসেবে হামাস শুধু ইসরাঈলীদের প্রতিরোধ করার করে যাচ্ছে, বিষয়টা এমন নয়। হামাস গণ মানুষের জন্যও করে যাচ্ছে। এমন কোনো খাত নেই, এমন কোনো বিভাগ নেই যে দিক-বিভাগে হামাসের কর্মতৎপরতা নেই। সেই হিসেবে হামাস মূলত তিনটি শাখার সমষ্টি। ১. রাজনৈতিক শাখা, ২. সমাজকল্যাণমূলক শাখা ৩. সামরিক শাখা।

মজলিশে শূরার মাধ্যমে হামাসের প্রতিনিধিগণ একসাথ হয়ে থাকেন। প্রাথমিকভাবে সেই শুরার সিদ্ধান্তের আলোকেই পুরো ফিলিস্তিনে হামাসের কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে থাকে। কিন্তু মূল পলিসি গ্রহণ করার জন্যে হামাসের পনেরো সদস্য বিশিষ্ট আলাদা “পলিটিক্যাল ব্যুরো” রয়েছে । ১৯৯৬ সাল থেকে ১৭ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ২২ বছর এই পলিটিক্যাল ব্যুরোর প্রধাণ ছিলেন খালেদ মিশাল; আর গাজা অঞ্চলে প্রধাণমন্ত্রী হিসেবে ছিলেন ডঃ ইসমাইল হানিয়া। সতেরো সালে স্বেচ্ছায় নেতৃত্ব থেকে অবসর গ্রহণ করেন তুখোড় মেধাবী নেতা খালিদ মিশাল। এরপর হামাসের মজলিশে শুরা কর্তৃক গাজার প্রধানমন্ত্রী ডক্টর ইসমাইল হানিয়াকে হামাসেরও প্রধান হিসেবে নির্বাচিত করা হয়। খালিদ মিশাল প্রধান থাকাকালীন একাধিকবার ইসরাঈলী গোয়েন্দা সংস্থা তাকে হত্যা প্রচেষ্টা করে। আল্লাহর অশেষ অনুগ্রহে তিনি প্রতিবারই বেঁচে যান। কিন্তু হামাসের প্রতিষ্ঠাতা শেখ আহমেদ ইয়াসিনকে তারা মিসাইল হামলায় শহীদ করে। এভাবে শহীদ করা হয় প্রতিষ্ঠাতা সদস্য আব্দুল আজীজ রানতিসি,সালিহ শাহাদাহকেও।

হামাসের শক্ত সাংগঠনিক কাঠামোর পাশাপাশি রয়েছে গণ-জনকল্যাণমুখী ব্যাপক সামাজিক কর্মকাণ্ড। শিক্ষার আলোয়ও নেই পিছিয়ে তাঁরা। গাজা উপত্যকার শতকরা ৯৯ ভাগ মানুষ-ই শিক্ষিত। ইসরাঈলীদের হামলায় কেউ শহীদ হলে সেই পরিবারের ভরণপোষণের দায়িত্ব নেয়
তাঁরা। ঘরবাড়ি প্রতিদিনই কিছু না কিছু, কারো না কারো ধূলিস্যাৎ হয়ে যায় সন্ত্রাসী ইহুদি সেনাদের বোমা হামলায় । এসব ধ্বংস হয়ে যাওয়া বাড়ি-ঘর, পুনঃনির্মাণে সহায়তায় দিয়ে যাচ্ছে তাঁরা। ধ্বসে যাওয়া বাড়ি বা প্রতিষ্ঠানের সামনে খুবই দ্রুততম সময়ে এসে উদ্ধার ও চিকিৎসা দেওয়া হয়।

হামাসের শত্রু ইইসরাঈলী গবেষকদের গবেষণা মতে হামাসের কার্যক্রমের ৯০% হলো সামাজিক, শিক্ষা সংস্কৃতি ও জনকল্যাণমূলক কাজ, এবং এই সামাজিক কাজের মধ্যে দাতব্য চিকিৎসা, মসজিদ-মক্তব স্থাপন, স্কুল ও শিশুশিক্ষায় অর্থায়ন, খেলাধূলার জন্য ক্লাব প্রতিষ্ঠা অন্যতম। শতো অবরোধের মধ্যেও নিজেদের নিয়ন্ত্রিত গাজাবাসীর জন্য বার্ষিক ৭০-৯০ মিলিয়ন ডলারের একটি বাজেট দিতে সক্ষম হয় হামাস, যার প্রায় ৮৫% অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয় সামাজিক ও জনকল্যাণমূলক কাজে। প্রতিরক্ষা এবং সামরিক খাতে বরাদ্দ যায় মাত্র ১৫%। (রেফারেন্সঃ কিংডম অফ গড-২০০৭ লেখক রুভন পাস)। (এই তথ্যটা আলাপন ব্লগ থেকে প্রাপ্ত )।

হামাস ইসলামি আন্দোলন-সংগঠন হলেও কিন্তু জোর-জবরদস্তী করে কাউকে ইসলামী অনুশাসন মানতে বাধ্য করে না। যারা হামাসকে উগ্রবাদী সন্ত্রাসী এবং কট্ররপন্থী হিসেবে চিত্রায়িত করে তারাও এর একটা নজিরও দেখাতে পারবে না। তবে তাদের দাওয়াহ মন্ত্রনালয়ের অধীনে ‘Virtue Committee’ নামে কিছু নাগরিক কমিটি রয়েছে, যারা বিভিন্নভাবে জনসাধারণকে ইসলামী অনুশাসন মেনে চলতে উদ্ধুদ্ধ করে , এককথায় দাওয়াহর কাজ করে। ইসলামি অনুশাসনের দিকে সাধারণ জনতাকে আহবান জানায়। পরিবর্তন তো মানুষের মন থেকেই হতে হবে। হামাস মূলত সেটাই করে।

নরপিশাচ ইহুদি সেনাদের মোকাবিলায় পুরো ফিলিস্তিনকে স্বাধীন এবং বায়তুল মুকাদ্দিসকে করার উদ্দেশ্যে নিয়ে হামাস গঠিত হলেও শুরু থেকে তাদের সামরিক শাখা ছিলো না। ১৯৯৩ সাল থেকে ইজ্জুদ্দিন আল কাসসাম বিগ্রেড নামে একটি সশস্ত্র সংগঠন গড়ে তোলে।

হামাসের অঙ্গসংগঠন হলেও তাদের সম্পর্কে বহু কিছু সিনিয়র নেতারাও জানতে পারে না। পরিস্থিতির আলোকে অনেক কাজ ও সিদ্ধান্ত নিজেরাও নিয়ে থাকে। সেই এখতিয়ার মূল সংগঠন থেকেই দেওয়া আছে তাদের। কাসসাম বিগ্রেডের মুজা-হিদদের পরিচয় এবং সংগঠনে তাদের অবস্থান আমৃত্যু গোপনীয়ই থাকে। ইহুদিবাদী সন্ত্রাসীদের সাথে যখন যখন তাঁরা জি.হা.দে অবতীর্ণ হয়, তখন দেখা যায় তাঁরা কালো মুখোশ পরিধান করে, এর ওপর সবুজ বেল্ট দিয়ে বাধা থাকে। তাঁরা তাদের নেতার মৃত্যুর পর নিজেরাই নিজেদের নেতা নির্বাচন করে। কাসসাম বিগ্রেডের বর্তমান প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন মুহাম্মদ দেইফ। নেতা হিসেবে সংগঠনটির সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদী দায়িত্ব তিনিই পালন করে যাচ্ছেন। ইহুদিবাদী ইসরাঈলীরা ওনাকে অসংখ্যবার গুপ্তহত্যা করতে চেষ্টা করলেও তিনি রক্ষা পেয়েছেন।

হামাস-ইখওয়ান অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বাস্তবিক ভিত্তিক একটি সংগঠন। দ্বীন শরিয়ত এবং মানুষের কল্যাণে যখন যেমন কর্মসূচি গ্রহণ করা দরকার, তখন তারা সেটাই করে। সে হিসেবে স্থানীয়-জাতীয় নির্বাচনে এবং রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডেও অংশ নেয়। ২০০৫ সালে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত হওয়ার পরের বছরই ফিলিস্তিনি আইন পরিষদ প্যালেস্টিনিয়ান লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের (পিএলসি) নির্বাচনে বিজয়মাল্য পরিধান করে হামাস। বিজয়ী হওয়ার পরেও হামাসের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে অস্বীকৃতি জানায় ফিলিস্তিনের জাতীয়তাবাদী নেতা প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের নেতৃত্বাধীন ফাতাহ । যার ফলে তাদের দন্দ্ব শুরু হয়। সেই দ্বন্দ রূপ নেয় গৃহযুদ্ধে। অত:পর সেই গৃহযুদ্ধে হামাস দখলে নেয় গাজা ও ফাতাহ দখলে নেয় ওয়েস্ট ব্যাংক । গাজা থেকে জাতীয়তাবাদী ফাতাহকে বের করে দেয় হামাস। যেহেতু গাজাবাসীরা পরিষ্কার ঈমানী এবং জি. হা. দি আবেগের অধিকারী সেহুতু ফাতাহ’র অফিসগুলো এখানে শূন্য পড়ে আছে থেকে তো লাভ নেই, তাই গাজাবাসীরা তাদের অফিসগুলোকে অফিসকে মসজিদে পরিণত করে।

গাজার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে হামাস এখানে সরকার গঠন করে। কিন্তু ইসরাঈলী সন্ত্রাসীরা এবং তাদের পোষ্যবর্গ বিশ্ব হর্তাকর্তারা তাদের মোটেও মেনে নিতে পারে নি। বিশ্ব মোড়লরা তাদের সন্ত্রাসী ঘোষণা করে। কিন্তু পাখির মতো গুলি করে, বর্ষার অঝোর ধারার বৃষ্টির মতো বোমা মেরে নিরীহ নারী-পুরুষের খুনি ইসরাঈলীদের ব্যাপারে বরাবরই নীরব তারা। এরই ধারাবাহিকতায়, বিশ্ব হর্তাকর্তাদের চোখের সামনেই ২০০৮ সালে হামাস-সরকারের পতন ঘটাতে গাজাবাসীর ওপর পুনরায় বর্বরোচিত হামলা চালায় সন্ত্রাসী ইসরাঈলী সেনারা। এভাবে ধারাবাহিকভাবে কয়দিন পর পরই ফিলিস্তিনের গাজাবাসীর ওপর, তাদের নেতৃত্ব এবং নিরীহ নারী-পুরুষের হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরাঈলী ইহুদি সন্ত্রাসীরা। সেসব হামলার জবাবে হামাস-মুজাহিদ.গণ তাদের সীমিত সামর্থ্যের মধ্যে সর্বোচ্চ জবাব দিতে চেষ্টা করে। ইটপাটকেল ছুঁড়ে, পাথর নিক্ষেপ করে, সীমিত প্রযুক্তির রকেট ছুঁড়ে ইহুদিদের প্রতিরোধ করে যাচ্ছে। আল্লাহর সৈনিকদের এমন সীমিত প্রযুক্তির রকেটই একদিন ইসরাঈলী ইহুদি সন্ত্রাসীদের এবং প্রাসাদ সমূহ তছনছ করে দিয়ে ফিলিস্তিনের মজলুম জনতাকে মুক্ত করবেন, উদ্ধার করবেন মুসলমানদের প্রথম ক্বিবলা বায়তুল মাকদিসকে। ইন শা আল্লাহ!

একটা চমকপ্রদ বিষয় হচ্ছে যে, বাহিরে-ভেতরে এতো এতো চাপ, হামলা অবরোধের পরেও তাদের ঐক্য আর সংহতির মাঝে একটুও ফাটল ধরে নি। নেই কারো কোনো লোভ-লালসা। স্বেচ্ছায় নেতৃত্ব থেকে অবসর গ্রহণ করে নিজের চেয়ে অধিক যোগ্য লোকের হাতে দায়িত্ব অর্পণের অনুপম মানসিকতা তাদেরকে আর ঋদ্ধ করবে, এবং করেছেও। আল্লাহ এই সমস্ত মর্দে মুমিন-মুজাহিদদের কবুল করুন। আ-মী-ন!!

|| ইসলামি প্রতিরোধ আন্দোলন ”হামাস”||
~রেদওয়ান রাওয়াহা