কবর খননের সঠিক নিয়ম

কবর খননের সঠিক নিয়ম 

আসসালামু আলাইকুম,  আশা করি সবাই ভালো আছেন। অনেকেই আমার কাছে  কবর খননের সঠিক নিয়ম জানতে চেয়েছেন। তাই  আজকে আমরা আলোচনা করবো,  কবর খননের সঠিক নিয়ম,  কবরে মাইয়্যাত রাখার নিয়ম, কবর জিয়ারতের দোয়া ও নিয়ম। কেমন জায়গায় কবর দিলে ভালো হয়। কবরের গভীরতা কতটুকু হবে। মোটকথা কবর বিষয়ে সকল প্রশ্নের জবাব দেবার চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ৷

 

কবর খননের সঠিক নিয়ম

মানুষের মৃত্যুর পর দাফনের জন্য সুন্দরভাবে কবর খনন করাও সুন্নাত। আর সুন্নাত পদ্ধতিতে কোনো মুসলমানকে দাফন করার জন্য কীভাবে কবর খনন করতে হয় কিংবা কবর কী পরিমাণ গভীর করতে হয়; তা অনেকেই জানে না। আসুন জেনে নিই, সঠিক পদ্ধতিতে কবর খননের নিয়ম-

কবর খননের আগে প্রথমেই দেখতে হবে মাটি শক্ত-মজবুত নাকি নরম। তারপর মাটির ধরণ অনুযায়ী কবর খনন করতে হয়। তাহলো এমন-

কবর খননের জন্য কেমন মাটি ভালো?

⇒ শক্ত বা মজবুত মাটিঃ

যেসব কবরস্থানের মাটি শক্ত ও মজবুত; সেসব স্থানে লাহদ (বোগলী) কবর খনন করা সুন্নত। সেটা হল-
স্বাভাবিকভাবে চার কোণা করে মাটি খোড়ার পর নীচে পশ্চিম (কেবলার) দিক দিয়ে একটি গর্ত করবে এবং পশ্চিম দিকের ঐ গর্তের মধ্যে লাশ রাখবে।

⇒ নরম মাটিঃ

 

আর যেসব কবরস্থানের মাটি নরম; সেখানে লাহদ বা বোগলী কবর করলে মাটি ভেঙ্গে পড়ার আশঙ্কা থাকে। তাই সেসব জায়গায় সিন্দুক কবর করবে। অর্থাৎ স্বাভাবিকভাবে চার কোণা করে মাটি খোড়ার পর নীচের দিকে গিয়ে মাঝ বরাবর একটি গর্ত করবে এবং সেখানে লাশ রাখবে।

 




⇒ কবরের গভীরতা কেমন হবে?

মাটির উপর নির্ভর করে কবর লাহদ বা বোগলী হোক কিংবা সিন্দুক কবর হোক; উভয় ক্ষেত্রে একজন মধ্যম দৈহিক গড়নের ব্যক্তির কমপক্ষে নাভি পর্যন্ত গভীর হতে হবে। তবে যে এলাকায় যেটার প্রচলন আছে সে অনুযায়ী গভীর করাই উচিত।

কবর খননের নিয়ম
আর কবরের দের্ঘ্য হবে মৃতের দৈর্ঘের সমান এবং প্রস্থ হবে মৃতব্যক্তির দৈর্ঘ্যরে অর্ধেক বা তারচেয়ে কিছু কম।

কবর বিষয়ক কোরআনের আয়াতসমূহ

১ ৷
وَ لَا تُصَلِّ عَلٰۤی اَحَدٍ مِّنۡهُمۡ مَّاتَ اَبَدًا وَّ لَا تَقُمۡ عَلٰی قَبۡرِهٖ ؕ اِنَّهُمۡ کَفَرُوۡا بِاللّٰهِ وَ رَسُوۡلِهٖ وَ مَا تُوۡا وَ هُمۡ فٰسِقُوۡنَ ﴿۸۴﴾

আর তাদের মধ্যে যে মারা গিয়েছে, তার উপর তুমি জানাযা পড়বে না এবং তার কবরের উপর দাঁড়াবে না। নিশ্চয় তারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে অস্বীকার করেছে এবং তারা ফাসিক অবস্থায় মারা গিয়েছে ।
[সূরা আত তাওবা-৮২]

২ ৷

وَّ اَنَّ السَّاعَۃَ اٰتِیَۃٌ لَّا رَیۡبَ فِیۡهَا ۙ وَ اَنَّ اللّٰهَ یَبۡعَثُ مَنۡ فِی الۡقُبُوۡرِ ﴿۷﴾

আর কিয়ামত আসবেই, এতে কোন সন্দেহ নেই এবং কবরে যারা আছে নিশ্চয়ই আল্লাহ তাদের পুনরুত্থিত করবেন।
[সূরা আল হাজ্জ-৭]

৩ ৷

وَ مَا یَسۡتَوِی الۡاَحۡیَآءُ وَ لَا الۡاَمۡوَاتُ ؕ اِنَّ اللّٰهَ یُسۡمِعُ مَنۡ یَّشَآءُ ۚ وَ مَاۤ اَنۡتَ بِمُسۡمِعٍ مَّنۡ فِی الۡقُبُوۡرِ ﴿۲۲﴾

আর জীবিতরা ও মৃতরা এক নয়;* নিশ্চয় আল্লাহ যাকে ইচ্ছা শুনাতে পারেন, কিন্তু যে ব্যক্তি কবরে আছে তাকে তুমি শুনাতে পারবে না।
[সূরা আল ফাতির-২২]

* এই আয়াত ও আগের কয়েকটি আয়াতে ঈমান ও কুফরীকে নানা উপমায় চিত্রিত করা হয়েছে; ঈমান হল দৃষ্টিশক্তি, আলো, সুশীতল ছায়া আর প্রাণবন্ত জীবনের ন্যায়। পক্ষান্তরে কুফরী হল অন্ধত্ব, অন্ধকার, প্রচন্ড খরতাপ আর মৃত্যুতুল্য।

৪ ৷

یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا لَا تَتَوَلَّوۡا قَوۡمًا غَضِبَ اللّٰهُ عَلَیۡهِمۡ قَدۡ یَئِسُوۡا مِنَ الۡاٰخِرَۃِ کَمَا یَئِسَ الۡکُفَّارُ مِنۡ اَصۡحٰبِ الۡقُبُوۡرِ ﴿۱۳﴾

হে ঈমানদারগণ, তোমরা সেই সম্প্রদায়ের সাথে বন্ধুত্ব করো না, যাদের প্রতি আল্লাহ রাগান্বিত হয়েছেন। তারা তো আখিরাত সম্পর্কে নিরাশ হয়ে পড়েছে, যেমনিভাবে কাফিররা কবরবাসীদের সম্পর্কে নিরাশ হয়েছে।
[সূরা মুমতাহিনা-১৩]

৫ ৷

ثُمَّ اَمَاتَهٗ فَاَقۡبَرَهٗ ﴿ۙ۲۱﴾

তারপর তিনি তাকে মৃত্যু দেন এবং তাকে কবরস্থ করেন।
[সূরা আবাস-২১]

৬ ৷

اَفَلَا یَعۡلَمُ اِذَا بُعۡثِرَ مَا فِی الۡقُبُوۡرِ ۙ﴿۹﴾

তবে কি সে জানে না যখন কবরে যা আছে তা উত্থিত হবে?
[সূরা আল আদিয়াত-৯]

৭ ৷ আত-তাকাসুর,:আয়াত: ২,

حَتّٰى زُرْتُمُ الْمَقَابِرَؕ

এমনকি (এই চিন্তায় আচ্ছন্ন হয়ে) তোমরা কবর পর্যন্ত পৌঁছে যাও।

বৈজ্ঞানিকভাবে কবর দেয়া উত্তম নাকি পোড়ানো?


বাস্তুসংস্থানের নিয়ম অনুসারে প্রাণী মারা গেলে তা পচনশীল ব্যকটেরিয়ার খাবার হয় ৷ এরপর তা সার হয়ে মাটির উর্বরতা বাড়ায় ৷ আর সেই মাটিতেই জন্ম নেয় উদ্ভিদ ৷ পৃথিবীর প্রত্যেক প্রাণীই খাবারের জন্য প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে উদ্ভিদের ওপর নির্ভরশীল ৷ আজ বিশ্বের জ্বালানি শক্তির প্রধান উৎস তেল ৷ মাটির নিচের এই তেল আসলো কোত্থেকে ? বহু বছর আগে মাছ, অন্যান্য প্রাণী, গাছ এগুলো চাপা পড়েই মাটির তাপ ও চাপে আজ তেলে পরিণত হয়েছে ৷

বিপরীতে লাশ পোড়াতে গেলে-

• একজনের লাশ পোড়াতে বড় গাছ হলে পুরো একটি গাছের কাঠ লাগে ৷

• একটি গাছের কাঠসহ মৃতদেহ পোড়ায় সৃষ্টি হয় প্রচুর কার্বন-ডাইঅক্সাইড ৷

• দেহ টা আগুনে পোড়ানোর উপযোগী নয় ৷ যার ফলে ক্ষতিকারক বিভিন্ন গ্যাস বাতাসে মিশে ৷

• আগুন মৃতদেহকে স্পর্শ করার বেশ আগেই, তার গায়ে থাকা কাপড়  পুড়ে যায় ৷ ফলে দেহ পুরোপুরি উলঙ্গ হয়ে সোজা হয়ে উঠে দাড়ায় ৷ মাঝেমধ্যে অনেকটা হাঁটার মতো ভঙ্গী করে ৷ মৃত মানুষটির শ্লীলতাহানী ঘটে ৷

• ধনী বা সম্ভ্রান্ত কেউ মারা গেলে প্রচুর পরিমাণে ঘি দেয়া হয় চিতায় – খাদ্যের অপচয় ৷

দার্শনিকভাবে-

মাটির তৈরি মানুষ , মাটিতেই ফিরে আসুক ।

পৃথিবীর সমস্ত প্রাণের উদ্ভব বৈজ্ঞানিক গবেষণা অনুসারে মাটি থেকেই এসেছে ৷

মাটির মধ্যে খনিজ পদার্থের সংমিশ্রণ-ক্ষুদ্র অণু এবং রাসায়নিকের জন্য একটি প্রজনন পরীক্ষাগার হিসেবে কাজ করে যা এটি ‘ স্পঞ্জের মতো শুষে নেয় ‘ ।

এই প্রক্রিয়া কয়েক কোটি বছর লাগে, যার ফলে রাসায়নিক প্রোটিন, ডিএনএ এবং ঘটনাক্রমে, জীবন্ত কোষ গঠনের জন্য একে অপরের প্রতি প্রতিক্রিয়া জানায়, বৈজ্ঞানিক রিপোর্ট জার্নাল-কে জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা ।

এসব দিক বিবেচনায় মৃতকে কবর দেয়াই উত্তম ৷

কবরের আজব কি সত্য?

হ্যাঁ ৷ কবরের আজাব সত্য প্রমাণিত। যেমন আল্লাহ বলেন,
১. আল্লাহ মুমিনদেরকে দৃঢ় বাক্য দ্বারা দৃঢ় রাখেন ইহজীবনে ও পরজীবনে (ইবরাহীম ১৪/২৭)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, উক্ত আয়াতটি নাযিল হয়েছে কবরের আযাব বিষয়ে। যখন তাকে বলা হবে, তোমার প্রতিপালক কে? সে বলবে, আমার প্রতিপালক আল্লাহ। আমার নবী মুহাম্মাদ’ (মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/১২৫)।

২. ‘অবশেষে ফেরাউনের সম্প্রদায়কে আল্লাহর কঠোর শাস্তি ঘিরে ধরে। আর আগুনকে তাদের সামনে সকালে ও সন্ধ্যায় পেশ করা হয়। আর যেদিন ক্বিয়ামত সংঘটিত হবে (সেদিন ঘোষণা করা হবে), ফেরাঊনের অনুসারীদেরকে কঠোরতম আযাবে প্রবেশ করাও’ (গাফের ৪০/৪৫-৪৬)।

ইবনু কাছীর (রহঃ) বলেন, আহলে সুন্নাতের নিকট অত্র আয়াতই আলামে বারযাখে কবরের শাস্তি সাব্যস্ত হওয়ার মৌলিক ভিত্তি (ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা গাফের/মুমিন ৪৬ আয়াত)।

৩. আল্লাহ অন্যত্র বলেন, ‘অচিরেই আমি তাদেরকে দু’বার শাস্তি দেব। অতঃপর তারা কঠিন শাস্তির দিকে ফিরে যাবে’ (তওবা ৯/১০১)।

হাসান বছরী ও ক্বাতাদাহ বলেন, দু’বার শাস্তি অর্থ রোগ-শোক ও বিপদাপদের মাধ্যমে প্রথমবার দুনিয়াবী শাস্তি এবং দ্বিতীয়বার কবর আযাবের শাস্তি’ (কুরতুবী, ইবনু কাছীর; দ্রঃ বুখারী ‘জানাযা’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৮৫)।

কবরের শাস্তির ব্যাপারে আয়েশা (রাঃ)-এর প্রশ্নে জবাবে রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘কবরের আযাব সত্য’ (বুখারী হা/১৩৭২; ছহীহাহ হা/১৩৭৭)। এছাড়া বহু ছহীহ হাদীছ দ্বারা এটি স্পষ্টভাবে প্রমাণিত।

রিলেটেড পোস্ট – কবর জিয়ারতের দোয়া ও নিয়ম 

 

মোদ্দাকথা কবরের আযাবের বিষয়টি সম্পূর্ণ আদৃশ্য জ্ঞানের বিষয়। যে বিষয়ে মানবীয় জ্ঞানের অবকাশ নেই। অতএব পবিত্র কুরআন ও সহীহ হাদীসের উপরে নিঃশঙ্কচিত্তে আমাদের ঈমান আনতে হবে। অহেতুক সন্দেহ-দ্বন্দ্বের দোলাচলে পড়ে ইহকাল ও পরকাল হারানোর পিছনে কোন যুক্তি নেই। কবরের আযাব গায়েবী বিষয়। আর গায়েবের উপর ঈমান আনতে অস্বীকারকারী ব্যক্তি মুমিন নয় (বাক্বারাহ ২/২)। কেননা এর মাধ্যমে সে ঈমানের ছয়টি রুকনের একটিকে তথা আখেরাত বিশ্বাসকে অস্বীকার করেছে। আল্লাহ আমাদের সকলকে সহহী বুঝ দান করুন আমিন।

লেখকঃ
হাফেজ মাওলানা দীদার মাহদী
ভাইস প্রিন্সিপ্যাল, দারুলহুদা মডেল মাদরাসা
কোদালপুর, গোসাইরহাট, শরীয়তপুর ৷