জামায়াত নেতারা হিজরতকে প্রাধান্য দেননি কেনো?

মীর কাশেম আলী সাহেবের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের মামলা হওয়ার আগে তিনি সৌদি আরবে এসেছিলেন। তিনি আমাদের অফিসেও এসেছিলেন। তার সাথে দেখা হয়েছিল, কথাও হয়েছিল। তখন তার ব্যবসাতে কীভাবে অর্থায়ন করা যায়, সেই বিষয়ে আমার সাথে আলাপ হয়েছিল।

পরবর্তিতে পত্রিকা মারফত জেনেছি, তিনি এরপর আমেরিকাতেও গিয়েছিলেন। আবার ফিরেও এসেছিলেন। ততদিনে চাউর হয়ে গেছে তার বিরুদ্ধে শীঘ্রই মামলা হবে। তাই আমেরিকা চলে যাওয়াতে মনে হয়েছিল তিনি মনে হয় আর ফিরে আসছেন না।

কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে তিনি আমেরিকা থেকে ফিরে আসেন। এরপরই তার বিরুদ্ধে মামলা হয়, তিনি গ্রেফতার হন। এবং এক সময় তার ফাঁসিও হয়।

জামায়াতে ইসলামীর যে সকল নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছিল, তাদের কেউই দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাননি। কেন যাননি, তা আমার জানা নেই।

হয়তো তারা মনে করেছিলেন তাদের কিছু হবে না। কিন্তু এমন মনে করার শক্ত কোন কারণ ছিল কি?

দেশে ক্ষমতায় তখন আওয়ামী লীগ। তারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে অন্যতম এজেন্ডা হিসাবে ঘোষণা দিয়েছে। আমাদের বিচারাঙ্গনও খুব বেশি নিরপেক্ষ, তেমন মনে করারও কোন কারণ ছিল না। তাহলে জামায়াতে ইসলামীর নেতারা সুযোগ পেয়েও পালালেন না কেন? জানি না।

তবে এমন পালানোর সুযোগ কাজে লাগিয়েছিলেন মাওলানা আবুল কালাম আজাদ। এনটিভিতে “আপনার জিজ্ঞাসা” নামক একটি ইসলামিক অনুষ্ঠান করে তিনি খ্যাতিমান হয়েছিলেন। তার বিরুদ্ধেও যুদ্ধাপরাধের মামলা হয়েছিল। কিন্তু সুযোগ পেয়ে তিনি পালিয়ে যান। এখন তিনি কোথায় আছেন জানি না।

জীবনের উপর হুমকি আসলে ঠায় দাঁড়িয়ে না থেকে সেই স্থান থেকে পালিয়ে যেতে হবে – এটা ইসলামের শিক্ষা। এই বিষয়টি খুবই অপ্রিয় হতে পারে, এটা আপনার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারকে ধ্বংস করে দিতে পারে। কিন্তু এটাই ইসলামের পথ।

রাসুল (সাঃ) এই অপ্রিয় বিষয়টি তার নিজের জীবনে চর্চা করে তা দেখিয়ে গেছেন। মক্কায় যখন তার জীবন হুমকির মুখে পড়ল, তখন তিনি আল্লাহর নির্দেশে মদীনায় পালিয়ে গেলেন। এই ঘটনাটিকে মহিমান্বিত করার জন্য একে পালানো বলা হয় না। বলা হয় হিজরত।

একই রকম জীবন বাঁচানোর জন্য পালানোকে আল্লাহপাক মহিমান্বিত করেছেন সুরা কাহাফে। সেখানে একদল ব্যক্তির কথা বলা হয়েছে যারা শাসকের অত্যাচার থেকে বাঁচার জন্য পালিয়ে গিয়েছিলেন। পরে তাদেরকে এক গুহায় আল্লাহপাক দীর্ঘদিন ঘুম পাড়িয়ে রেখেছিলেন।

ইসলামের এই শিক্ষা সাম্প্রতিককালে কাজে লাগিয়েছেন ড. জাকির নায়েক। তার বিরুদ্ধে যখন মামলা হল, তখন তিনি আর দেশে ফিরে আসলেন না। চলে গেলেন মালয়শিয়ায়।

একইভাবে এই শিক্ষা কাজে লাগিয়েছেন খ্যাতিমান আলেম ইউসুফ আল ক্বারদাউই। তিনি তার জন্মভূমি মিশরে আর ফিরে যাননি। আশ্রয় নিয়েছেন কাতারে।

ইসলাম শুধু কোন একটি নির্দিষ্ট স্থানের জন্য আসেনি। এসেছে সারা বিশ্বের জন্য। তাই কোন একটি স্থানে দ্বীনের প্রচার বাধাগ্রস্ত হলে এবং তা জীবনের উপর হুমকির সৃষ্টি করলে ব্যক্তির উচিত সেই স্থান ত্যাগ করে অন্যত্র চলে যাওয়া যেখানে শান্তিপূর্ণভাবে দ্বীনের প্রচার করা যায়।

প্রেসিডেন্ট কিংবা প্রধানমন্ত্রী হয়ে আপনাকে আপনার সমাজে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতেই হবে, এমন কোন নির্দেশনা আল্লাহপাক দেননি। আল্লাহপাক শুধু নির্দেশ দিয়েছেন তার দ্বীনের বাণী প্রচার করার জন্য।

এইভাবে দ্বীনের বাণী প্রচার করতে করতে আপনার পায়ের কাছে রাষ্ট্রক্ষমতা এসে লুটিয়ে পড়তে পারে, আবার নাও পারে।

পৃথিবীতে যত নবী-রাসুল এসেছেন, তাদের সকলেরই একমাত্র দায়িত্ব ছিল এই দ্বীনের বাণী প্রচার করা। তাদের সকলকেই কিন্তু আল্লাহপাক রাষ্ট্রক্ষমতা দেননি৷ দিয়েছেন মাত্র গুটিকয়েক নবী-রাসুলকে।

রাসুল (সঃ) ভাগ্যবান ছিলেন। তিনি সেই ক্ষুদ্র দলের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। আল্লাহপাক তাকে রাষ্ট্রক্ষমতা দিয়েছিলেন। মদীনার লোকেরা তাকে অনুরোধ করে মদীনায় নিয়ে গিয়েছিল। পরিস্থিতিও তেমন হয়ে গিয়েছিল যে রাসুল (সঃ) মদীনায় যেতে রাজি ছিলেন।

কিন্তু সেখানে গেলে তিনি ক্ষমতা পাবেন, তাকে শীর্ষ নেতা বানানো হবে, সেই ব্যাপারে তাকে কোন প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়নি। মদীনাবাসীর পক্ষ থেকে তাকে শুধুমাত্র যে কমিটমেন্ট দেয়া হয়েছিল, তা হল তাকে আশ্রয় দেয়া হবে এবং তাকে নিরাপত্তা দেয়া হবে। এর বেশি কোন প্রতিশ্রুতি তিনি তাদের কাছ থেকে পাননি।

মদীনায় তখন ছিল রাজনৈতিক অস্থিরতা। কেউ কাউকে মানত না। এমন পরিস্থিতিতে একজন নিরপেক্ষ ব্যক্তি হিসেবে সবাই রাসুল (সাঃ) এর কাছে আসত বিরোধ ফয়সালার জন্য। তিনি গোত্রভিত্তিক স্ব স্ব আসমানী কিতাবের বিধান মেনে সকলের মধ্যে ন্যায়বিচারভিত্তিক ফয়সালা করে দিতেন।

এভাবে নিরপেক্ষ ফয়াসালা করতে করতেই তিনি অল্পদিনের মধ্যেই মদীনার অবিসংবাদিত নেতায় পরিণত হন। তার কথা সবাই মানা শুরু করে। তার কথাই হয়ে যায় আইন।

অথচ তাকে সবাই নেতা হিসেবে ঘোষণা করেছে, কিংবা তিনি শাসক হিসেবে শপথ নিয়েছেন, অথবা তার কাছে সবাই এসে বায়াত নিয়েছে, এমন কোন ঘটনা কিন্তু রাসুল (সাঃ) এর জীবনে ঘটেনি। কারণ শাসক ঠিক করার এই সংস্কৃতি তখন মদীনায় চালু ছিল না। এই সংস্কৃতি এসেছে অনেক পরে।

জামায়াতে ইসলামীর অসংখ্য সদস্য আছেন যারা দেশে নির্যাতনের মুখে বিদেশে হিজরত করেছেন। আমেরিকাতে আশ্রিত এমন ব্যক্তিদের মাধ্যমেই গড়ে উঠেছে মুসলিম উম্মাহ অফ নর্থ আমেরিকা নামক একটি সংগঠন যারা আমেরিকায় দ্বীনের খেদমতে কাজ করছেন।

অথচ সুযোগ থাকা সত্বেও বাংলাদেশের জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নেতারা হিজরতকে তাদের জীবনে প্রাধান্য দেননি।

লেখকঃ মাবরুর মাহমুদ, ব্যাংকার,  সৌদি আরব ৷