শবে বরাতের গুরুত্ব ফজিলত ও শবে বরাতের আমল। মাওলানা শরিফ আহমাদ

শবে বরাতের  গুরুত্ব ফজিলত ও শবে বরাতের  আমল

 

 

সুপ্রিয় পাঠকবৃন্দ ! ইদানীং শবে বারাআতকে নিয়ে বেশ বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ি লক্ষ্য করা যাচ্ছে । অনলাইন- অফলাইনে বিভিন্ন তর্ক বিতর্ক পর্যন্ত উঠছে ।‌ তাই কোরআন সুন্নাহ ভিত্তিক সঠিক ম্যাসেজ মুসলিম উম্মাহকে পৌঁছানোর ইচ্ছা ছিল । আপনাদের সার্চ করার আগ্রহ আর সম্পাদক মহোদয়ের তাগাদায় লেখাটিকে ত্বরান্বিত করার প্রেরণা জোগালো ।‌ তাই আজ আপনাদের সঙ্গে নির্ধারিত টপিক শবে বরাতের গুরুত্ব ও ফজিলত সম্পর্কে আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ ।‌ শবে বরাত যেহেতু শাবান মাসের মধ্যে তাই প্রথমে শাবান মাসের ফজিলত ও আমল সম্পর্কে জানা প্রয়োজন । সংগত কারণেই অত্র আলোচনার শেষে সেটা পাবেন । চলুন এবার শবে বরাত সম্পর্কে জেনে নিই ।

 

 

শবে বরাত অর্থ কি?

 

শব একটি ফারসী শব্দ। শব্দটির অর্থ হলো রাত । বারাআত একটি আরবী শব্দ। শব্দটির অর্থ মুক্তি, নিষ্কৃতি ইত্যাদি । আরবী এবং ফার্সি মিলিয়ে হয়েছে শবে বারাআত । এখন এক কথায় অর্থ হবে জাহান্নাম থেকে মুক্তির রাত । শবে বারাআতকে হাদীসের ভাষায় লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান বলা হয়েছে। (ليلة النصف من شعبان) অর্থাৎ সাবানের অর্ধ মাসের রাত । ‘শবে বারাআত” এই শব্দে কোরআন ও হাদীসে লেখা না থাকায় অনেকে শবে বারাআত বলতে কিছু নেই ঘোষণা করেছেন । অনেকে অনেক খোঁড়া যুক্তি তুলে থাকেন । তাদের দাবি এবং যুক্তি সঠিক নয় । একটু বুঝিয়ে বলি আমরা সবাই দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করি কোরআন-হাদীসের নির্দেশের কারণে । কিন্তু কোরআন ও হাদীসের কোথাও কি নামাজ শব্দ আছে ? আমরা যাকে নামাজ বলি কোরআন ও হাদীসের উদ্বৃত শব্দ সালাতই তো‌ নামাজ ।‌

তদ্রুপভাবে আমরা যাকে শবে বারাআত বলি হাদীসে সেটাকে লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান বলা হয়েছে ।

এমন আরও অসংখ্য দৃষ্টান্ত দেখানো যাবে । জ্ঞানী এবং সচেতন ব্যক্তিদের জন্য এতোটুকুই বলাই যথেষ্ট ।

 

 

শবে বরাত- 2022 কবে?

বাংলাদেশের আকাশে গত ৩ মার্চ বৃহস্পতিবার কোথাও ১৪৪৩ হিজরী সনের পবিত্র শাবান মাসের চাঁদ দেখা যায়নি ।‌ ফলে ৪ মার্চ শুক্রবার পবিত্র রজব মাস ৩০ দিন পূর্ণ হয়েছে। এবং ৫ মার্চ শনিবার থেকে পবিত্র শাবান মাস গণনা শুরু হয়েছে । এই কারণে আগামী ১৮ মার্চ শুক্রবার দিবাগত রাতে পালিত হবে শবে বরাত ।

ইসলামিক ফাউন্ডেশন বায়তুল মুকাররম জাতীয় মসজিদের সভাকক্ষে জাতীয় চাঁদ দেখা কমিটির সভায় এ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় ।

 

শবে বারাআতে‌র কোরআনের আয়াত

 

কুরআনুল কারীমের ২৫ তম পারার ৪৪ নং সুরায় মহান আল্লাহ তাআলা বলেছেন-

 

حٰمٓ ۚۛ . وَالۡکِتٰبِ الۡمُبِیۡنِ .اِنَّاۤ اَنۡزَلۡنٰہُ فِیۡ لَیۡلَۃٍ مُّبٰرَکَۃٍ اِنَّا کُنَّا مُنۡذِرِیۡنَ.

فِیۡہَا یُفۡرَقُ کُلُّ اَمۡرٍ حَکِیۡمٍ. اَمۡرًا مِّنۡ عِنۡدِنَا ؕ  اِنَّا کُنَّا مُرۡسِلِیۡنَ ۚ .

رَحۡمَۃً مِّنۡ رَّبِّکَ ؕ  اِنَّہٗ ہُوَ السَّمِیۡعُ الۡعَلِیۡمُ ۙ .

অনুবাদ: হা-মীম। শপথ সুস্পষ্ট কিতাবের। আমি একে নাযিল করেছি। এক বরকতময় রাতে, নিশ্চয় আমি সতর্ককারী। এ রাতে প্রত্যেক প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয় স্থিরীকৃত হয়। আমার পক্ষ থেকে আদেশক্রমে, আমিই প্রেরণকারী। আপনার পালনকর্তার পক্ষ থেকে রহমতস্বরূপ। তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ। ( সুরা দুখান, আয়াত ১- ৬)

 

বিখ্যাত তাবেয়ী হযরত ইকরামা রহ: এবং মুফাসসিরীনদের এক জামাতের অভিমত হলো এ আয়াতে মোবারক রজনী বলে শবে বারাআতকে বোঝানো হয়েছে । কিন্তু আল্লামা নববী ও মুফাসসিরীনদের অধিকাংশের মত হল মোবারক রাত দ্বারা শবে কদরকে বোঝানো হয়েছে । কেননা কোরআন নাজিল সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেছেন-

اِنَّاۤ اَنۡزَلۡنٰہُ فِیۡ لَیۡلَۃِ الۡقَدۡرِ ۚۖ .

 

অনুবাদ: আমি একে নাযিল করেছি শবে-কদরে।‌ (আল ক্বাদর – ১) সুতরাং মোবারক রাত বলতে এখানে শবে বারাআত নয় বরং শবে কদর উদ্দেশ্য ।

 

 

এটাই বিশুদ্ধ বলেছেন গ্রহণযোগ্য মুফাসসিরীনে কেরাম। যার পক্ষে যুক্তিও শক্তিশালী। অতএব সুরা দুখানের উল্লেখিত আয়াতগুলো শবে কদরের । শবে বারাআত কেন্দ্রিক নয় ।

 

শবে বরাতের সহীহ হাদীস ও দলীল

 

শবে বারাআতের গুরুত্ব ও ফজিলতের কথা তাফসীরে রুহুল মাআনী, তাফসীরে জালালাইন, তাফসীরে মারেফুল কোরআনে এসেছে । হাদীসের কিতাব বাইহাকী শরীফ, ইবনে মাজাহ শরীফ ও মিশকাত শরীফে শবে বারাআতের বর্ণনা পাওয়া যায় ।

 

সাহাবীদের মধ্যে হযরত আলী রাদিআল্লাহু আনহু, হযরত আয়েশা রাদিআল্লাহু আনহা , হযরত আবু হুরাইরা রাদিআল্লাহু তা’আলা আনহু , হযরত আনাস রাদিআল্লাহু আনহু, হযরত মুসা আশআরী রাদিআল্লাহু তাআলা আনহুসহ আরো দশজন থেকে শবে বরাতের সহীহ, হাসান, জয়ীফ হাদীসের বর্ণনা পাওয়া যায় ।

 

 

শবে বারাআতের কয়েকটি সহীহ হাদীস ।

 

শবে বরাত নিয়ে ১নং হাদিস

عن معاذ بن جبل عن النبي صلى الله عليه و سلم قال : ( يطلع الله إلى خلقه في ليلة النصف من شعبان فيغفر لجميع خلقه إلا لمشرك أو مشاحن

 

অনুবাদ: হযরত মুআয ইবনে জাবাল রাদিআল্লাহু তাআলা আনহু বলেন, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- আল্লাহ তাআলা ১৫ই শাবানের রাতে ( শবে বারাআতে) সৃষ্টির দিকে রহমতের দৃষ্টি দেন এবং মুশরিক ও বিদ্বেষ পোষণকারী ব্যতীত আর সবাইকে ক্ষমা করে দেন।

 

( ফুটনোট: সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস নং-৫৬৬৫, মুসনাদুল বাজ্জার, হাদীস নং-২৭৫৪, মুসনাদে ইসহাক বিন রাহওয়াই, হাদীস নং-১৭০২, আল মুজামুল আওসাত, হাদীস নং-৬৭৭৬, আল মুজামুল কাবীর, হাদীস নং-২১৫, সুনানে ইবনে মাজা, হাদীস নং-১৩৯০, মুসনাদুশ শামীন, হাদীস নং-২০৩, মুসন্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস নং-৩০৪৭৯, শুয়াবুল ঈমান, হাদীস নং-৬২০৪ সিলসিলাতুল আহাদীছিস আস সহীহাহ-৩/৩১৫)

 

 

এই হাদীসের সনদ সহীহ । এ জন্য ইমাম ইবনে হিব্বান একে কিতাবুস সহীহে বর্ণনা করেছেন। ইমাম মুনযিরী, ইবনে রজব, কাস্তাল্লানী, যুরকাবী, নুরুদ্দীন হাইসামী এবং অন্যান্য হাদীস বিশারদ এ হাদীসটিকে আমলযোগ্য সহীহ বলেছেন। ( তারগীব তারহীব ২/১১৮, ৩/৪৫৯ লাত্বাইফুল মা‘আরিফ ১৫১-৩, মাজমা‘উয যাওয়ায়েদ ৮/৬৫, শারহুল সাওয়াহিব-১০/৫৬১)

 

 

২ নং হাদীস

 

হযরত আলী ইবনুল হারেস রাদিআল্লাহু তাআলা আনহু থেকে বর্ণিত ।‌ হযরত আয়েশা রাদিআল্লাহু তাআলা আনহা বলেন, রাতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নামাজে দাঁড়ান এবং এত দীর্ঘ সিজদা করেন যে আমার ধারণা হলো তিনি হয়তো মৃত্যুবরণ করেছেন ।

 

 

আমি তখন উঠে তার বৃদ্ধাঙ্গুলি নাড়া দিলাম । তার বৃদ্ধাঙ্গুলি নড়লো‌ । যখন তিনি সিজদা থেকে উঠলেন

এবং নামাজ শেষ করলেন । তখন আমাকে লক্ষ্য করে বললেন হে আয়েশা/ হুমায়রা ! তোমার কি আশঙ্কা হয়েছে যে আল্লাহর রাসূল তোমার হক নষ্ট করবেন ? আমি উত্তরে বললাম না ইয়া রাসুলুল্লাহ ।

 

 

 

আপনার দীর্ঘ সিজদা থেকে আমার আশংকা হয়েছিল আপনি মৃত্যুবরণ করেছেন কিনা ? নবীজি জিজ্ঞাসা করলেন তুমি কি জানো এটা কোন রাত ? আমি বললাম আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ভালো জানেন । তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন এটা অর্ধ শাবানের রাত । আল্লাহ তাআলা তার বান্দার প্রতি মনোযোগ দেন এবং ক্ষমাপ্রার্থীদের ক্ষমা করেন ও অনুগ্রহ প্রার্থীদের অনুগ্রহ করেন আর বিদ্বেষ পোষণ কারীদের ছেড়ে দেন তাদের অবস্থাতেই ।

(শুআবুল ঈমান-হাদীস নং- ৩৬৩৫)

 

 

হাদীসটি ইমাম বাইহাকী রহ. বর্ণনা করার পর সনদের ব্যাপারে বলেছেন, মুরসালুন জায়্যিদুন অর্থাৎ আমলযোগ্য।

 

 

৩ নং হাদীস

 

হযরত আবু মুসা আশআরী রাদিআল্লাহু তাআলা আনহু থেকে বর্ণিত । রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন ,

আল্লাহ তাআলা মধ্য শাবানের রাতে আত্মপ্রকাশ করেন । এবং মুশরিক ও হিংসুক ব্যতীত সকল সৃষ্টিকে ক্ষমা করে (ইবনে মাজাহ, হাদীস নং ১৩৯০, হাদীসের মান হাসান সহীহ )

 

৪ নং হাদীস

عن عائشة : قالت فقدت رسول الله صلى الله عليه و سلم ليلة فخرجت فإذا هو بالبقيع فقال أكنت تخافين أن يحيف الله عليك ورسوله ؟ قلت يا رسول الله إني ظننت أنك أتيت بعض نساءك فقال إن الله عز و جل ينزل ليلة النصف من شعبان إلى السماء الدنيا فيفغر لأكثر من عدد شعر غنم كلب.

অনুবাদঃ হযরত আয়েশা রাদিআল্লাহু তা’আলা আনহা বলেন , একরাতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে না পেয়ে খুঁজতে বের হলাম । খুঁজতে খুঁজতে জান্নাতুল বাকীতে (মদিনার কবরস্থানে) গিয়ে আমি তাকে দেখতে পেলাম । তিনি বললেন কি ব্যাপার আয়েশা ( তুমি যে তালাশ বের হলে ) তোমার কি মনে হয় আল্লাহ এবং তার রাসুল তোমার ওপর কোনো বিচার করবেন ?

( তোমার পাওনা রাতে অন্য কোন ব্যক্তির ঘরে রাত্রি যাপন করবেন ? ) হযরত আয়েশা রাদিআল্লাহু তা’আলা আনহা বলেন, আমার ধারণা হয়েছিল আপনি অন্য কোন বিবির ঘরে গিয়েছেন । রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন বললেন যখন শাবান মাসের ১৫ই রাত আসে অর্থাৎ যখন শবেবরাত হয় ।

 

তখন আল্লাহ তাআলা এ রাতে প্রথম আসমানে নেমে আসেন । তারপর বনু কালব গোত্রের বকরীর পশমের চেয়ে বেশি সংখ্যক বান্দাকে ক্ষমা করে দেন ।

(সুনানে তিরমিযী, হাদীস নং-৭৩৯, মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং-২৬০২৮, মুসনাদে আব্দ বিন হুমাইদ, হাদীস নং-১৫০৯) হাদীসের মান জয়ীফ ।

 

 

 

৫ নং হাদীস

عن علي بن أبي طالب قال قال رسول الله صلى الله عليه و سلم ( إذا كانت ليلة النصف من شعبان فقوموا ليلها وصوموا نهارها . فإن الله ينزل فيها لغروب الشمس إلى سماء الدنيا . فيقول ألا من مستغفر لي فأغفر له ألا من مسترزق فأرزقه ألا مبتلى فأعافيه ألا كذا ألا كذا حتى يطلع الفجر )

অনুবাদ: হযরত আলী বিন আবু তালিব রাদিআল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত ‌। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যখন শাবান মাসের অর্ধেকের রজনী আসে ( শবে বারাআত) তখন তোমরা রাতে নামাজ পড়ো আর দিনের বেলা রোজা রাখ ।

 

নিশ্চয় আল্লাহ এ রাতে সূর্য ডোবার সাথে সাথে পৃথিবীর আসমানে এসে বলেন, কোন গোনাহ ক্ষমা প্রার্থী আছে কি আমার কাছে ? আমি তাকে ক্ষমা করে দেবো ।‌ কোন রিজিক প্রার্থী আছে কি? আমি তাকে রিজিক দেবো ।‌ কোন বিপদগ্রস্থ মুক্তি পেতে চায় কি ? আমি তাকে বিপদ মুক্ত করে দেবো‌ । আছে কি এমন ? আছে কি তেমন ? এমন বলতে থাকেন ফজর পর্যন্ত ।

 

 

(সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস নং-১৩৮৮, শুয়াবুল ঈমান, হাদীস নং-৩৮২২ ) হাদীসের মান জয়ীফ ।

আর জয়ীফ হাদীসের ক্ষেত্রে মুহাদ্দিসীনে কেরামের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হলো- ফাযায়েলের ক্ষেত্রে যয়ীফ হাদীস গ্রহণযোগ্য। (কিতাবুল আযকার-৭, ফাতহুল কাদীর-১/৪৬৭ )

উল্লেখিত পাঁচটি হাদিসের মধ্যে দুইটি হাদীস জয়ীফ । আর অন্যগুলো তো সহীহ এবং হাসান পর্যায়ের । অতএব শবে বরাতের দলীল যারা খুঁজছেন আশা করি পেয়ে গেছেন ।

 

শবে বরাতের গুরুত্ব 

 

কোন রাত বরকতের হওয়া , কোন দিন ফযিলতের হওয়া ,কোন মাস ফজিলতের হওয়া, কোন ব্যক্তি ফজিলতের হওয়া, কোন বস্তুর ফজিলতের হওয়া বা মর্যাদা সম্পন্ন হওয়া এগুলো বান্দার ইখতিয়ার বহির্ভূত । দুনিয়ার সব মানুষ একত্রিত হয়ে যদি কোন দিনকে বা কোন রাতকে ফযিলতের বলে তাহলে তাও ফজিলতের হবে না । শ্রেষ্ঠ হবে না । বরং আল্লাহ তাআলা সব কিছুর সৃষ্টি করেন ।‌ তিনি মনোনীত করেন। কোন ব্যক্তি কে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেন। পবিত্র কুরআনে এসেছে- আপনার পালনকর্তা সৃষ্টি করেন , তিনি মনোনীত করেন । (সূরা কাসাস , ৬৫ )

আল্লাহ তাআলা তাঁর সৃষ্টি জগতের অনেক ক্ষেত্রে চার সংখ্যাকে বিশেষভাবে মনোনীত করেছেন । তাদের মধ্যে থেকে চারজন ফেরেশতা কে মনোনীত করেছেন । অর্থাৎ বিশেষভাবে মর্যাদা দিয়েছেন । এরা হলো

১. জিবরাইল আলাইহিস সালাম

২. আজরাইল আলাইহি সাল্লাম

৩.ইসরাফিল আলাইহি ওয়াসাল্লাম

৪. মিকাইল আলাইহিস‌ সালাম ।

এদের মধ্যে আবার শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন হযরত জিবরাঈল আলাইহিস সালামকে । নবীদের মধ্যে

১. হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম

২.হযরত মূসা আলাইহিস সালাম

৩. হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম

৪.হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বিশেষভাবে মনোনীত করেছেন । তবে শ্রেষ্ঠ দান করেছেন হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ।

হাজার হাজার সাহাবীদের মধ্যে থেকে

১. হযরত আবু বকর রাদিআল্লাহু তাআলা আনহু

২. হযরত ওমর রাদিআল্লাহু তাআলা আনহু

৩. হযরত উসমান রাদিআল্লাহু তাআলা আনহু

৪.হযরত আলী রাদিআল্লাহু তাআলাআনহুকে বিশেষভাবে মনোনীত করেছেন । এদের মধ্যে আবার শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন হযরত আবু বক্কর সিদ্দীক রাদিআল্লাহু তাআলা আনহুকে ।‌ দিনের মধ্যে চারটি দিনকে বিশেষভাবে মর্যাদা দান করেছেন ।

১. ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা

২. আরাফার দিন

৩. জুমার দিন

৪. আশুরার দিন

এর মধ্যে আরাফার দিনকে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন । তেমনি ভাবে রাতের মধ্যে চারটি রাতকে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন। ফজিলতের রাত হিসেবে মনোনীত করেছেন।

১. শবে ঈদাইন

২. শবে জুমা

৩. শবে বরাত ও

৪. শবে কদর

এর মধ্যে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন শবে কদরকে । তাহলে এই আলোচনা থেকে বোঝা গেল শবে বরাত এটা আল্লাহ তাআলার বিশেষ মনোনীত ফজিলতপূর্ণ রাত ।

 

শবে বরাতের বৈশিষ্ট্য 

 

এ রাতের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো শুরু এবং শেষ একই রকম অর্থাৎ সারাবছর আল্লাহ তাআলা রাতের এক তৃতীয়াংশ অতিবাহিত হলে প্রথম আকাশে অবতরণ করে

…. الا من مستغفر فاغفر له

আছে কোন ক্ষমাপ্রার্থী ? আমি তাকে ক্ষমা করে দেব !

( ইবনে মাজাহ )

আর বরাতের রাতের বৈশিষ্ট্য হলো এরাতে সূর্যাস্তের সাথে সাথে তিনি প্রথম আসমানে আত্মপ্রকাশ করে ঘোষণা করতে থাকেন ।

আছে কোন ক্ষমাপ্রার্থী ? আমি তাকে ক্ষমা করে দেবো । আছে কোন রিজিক প্রার্থী ?আমি তাকে রিজিকের ব্যবস্থা করে দেবো ? আছে কোন বিপদ গ্রস্থ ?আমি তাকেই পদ মুক্ত করে দেবো ! এভাবে অন্যান্য বিষয়ের ও প্রার্থনার আহ্বান জানানো হয়। এভাবে ফজর পর্যন্ত চলতে থাকে । সুতরাং বরাতের রাতের প্রতিটি মুহূর্তে অত্যন্ত মূল্যবান । অন্য রাতে তাহাজ্জুদের সময় যেমন গুরুত্বপূর্ণ বরাতের রাতে মাগরিব থেকে ফজর পর্যন্ত সারারাত একই রকমের গুরুত্ব বহন করে । অতএব ঐ রাতে ঘোরাফেরা , আড্ডাবাজিতে সময় কাটানো বন্ধ করে ইবাদত-বন্দেগি, কান্নাকাটি, তাওবা ইস্তেগফারে রত হওয়া উচিত ।

 

শবে বরাত পালন করা কি বিদআত ?

 

শবে বারাআত পালন বলতে কি বুঝাতে চান ? মসজিদকে বাসর ঘরের মতো লাল, হলুদ , নীল কাগজ/ ফুল দিয়ে সাজানো ? ঝলমলে রঙ্গিন লাইট লাগানো ‌? প্রত্যেকটি ঘরের বাসিন্দাদের সবকিছুকে নতুন করে ধৌত করা ? মাগরিবের নামাজের পর গোসল করা ? আতশবাজি, পটকা ফোটানো ? রাতভর সম্মিলিতভাবে মসজিদে হুমড়ি খেয়ে পড়ে থাকা‌ আর হালুয়া-রুটি বিতরণ করা ‌ইত্যাদি ? এগুলো করা হলে নিঃসন্দেহে বাড়াবাড়ি এবং বিদআত হবে ।‌

 

 

আর যদি এগুলো না করে শুধু ব্যক্তিগত ভাবে ইবাদত বন্দেগি করে তাহলে বিদআত হবে না । কেননা এ রাতে গুরুত্ব দিয়ে ইবাদাত করা বিদআত এ মর্মে কোন হাদীস বিদ্যমান নেই । কেউ দেখাতে পারবে না । বরং আরও নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বিভিন্ন সূত্রে শবে বরাতের ফজিলত বর্ণিত হয়েছে ।‌

 

যদিও বা কিছু হাদীস জয়ীফ কিন্তু আমলের ক্ষেত্রে তো জয়ীফ হাদীস গ্রহণযোগ্য । শবে বরাত অসংখ্য হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হওয়ার পরেও শবে বরাতকে অস্বীকার করা কিংবা বিদআত বলাটা হাদীস সম্পর্কে অজ্ঞতার পরিচায়ক । আর জেনে শুনে এমনটি করে থাকলে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের‌ হাদীস অস্বীকার করার মতো মারাত্মক অপরাধে অপরাধী হবে সে ব্যক্তি ।

 

তার ব্যাক্তিগতভাবে ভালো না লাগলে সে ইবাদাত-বন্দেগী করবে না । কিন্তু কেউ যদি করতে চায় তাকে বাধা দেওয়া অথবা শবে বরাত সম্পর্কে হাদীসগুলোকে অস্বীকার করা কোন দায়িত্ববান উম্মতের কাজ নয় ।‌

 

 

শবে বরাতের জাল হাদীস

 

১ নং জাল হাদীস

শহর-গ্রামের বিভিন্ন প্রান্তে একটি কথা শোনা যায় । আর তা হচ্ছে “শবে বরাতে হালুয়া রুটি বানালে আরশের নিচে ছায়া পাবে” ।‌ তাই সরল সোজা গ্রামের নারীগণ হালুয়া রুটি বানাতে সর্বাত্মক চেষ্টা করে । হালুয়া-রুটি বানিয়ে নিজে খাওয়া এবং বিতরণ পর্ব চালিয়ে যায়। ‌ দেখুন নিজের যদি হালুয়া রুটি খেতে ইচ্ছে করে তাহলে অন্যদিনে খাবেন ।

 

শবে বারাআতে কেন খেতে হবে ? মানুষকে খাবার দিয়ে সওয়াব অর্জন করতে চান ভালো কথা ।‌ কিন্তু এটা শবে বারাআতে কেন করতে হবে ? অন্যদিনেও তো করা যায় । মূলত হালুয়া রুটির ব্যাপক প্রচার-প্রসার এবং গুরুত্বের লক্ষ্যে ঐ কথাটিকে হাদীস হিসেবে চালিয়ে দেওয়া হয়েছে । কিন্তু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম এর হাদীসের সাথে এই কথার কোনো সম্পর্ক নেই ‌।‌

 

 

ওই কথাটি এমন একটি ভিত্তিহীন কথা যার জাল হওয়ার ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই । এমনকি এটি এমন জাল কথা যে জাল হাদীসের উপর লেখা কিতাবগুলোর মধ্যে তা খুঁজে পাওয়া যায় না ।‌

 

২ নং জাল হাদীস

 

আবার কাউকে কাউকে বলতে শোনা যায় ওহুদ যুদ্ধে যখন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লামের দান্দান মোবারক শহীদ হয়েছিল তখন কিছু দিন কোন প্রকার শক্ত খাবার তিনি খেতে পারতেন না ।‌ সেই ঘটনার প্রতি সমবেদনা জানিয়ে এই দিনে ঘটা করে হালুয়া রুটি খাওয়া হয় ।‌ এই কথাটিও ভিত্তিহীন এবং বানোয়াট ।

 

 

আর ওহুদ তো শাবান মাসের ১৫ তারিখে হয়নি । হয়েছে শাওয়াল মাসের ৭ তারিখে । সুতরাং যদি সে কেন্দ্রিক কোন বিষয়ে থাকতো তাহলে শাওয়াল মাসের ৭ তারিখে থাকতো । শবে বারাআতে‌র মধ্যে নয় ।

 

শবে বরাতে হালুয়া-রুটি সংস্কৃতি

 

শবে বারাআতে হালুয়া রুটি করা অপসংস্কৃতি । ইসলামের সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই । মূলত হালুয়া-রুটি এসেছে শিয়া সংস্কৃতি থেকে । শিয়াদের আকীদা হলো তাদের দ্বাদশ ইমাম ইমামে গায়বের জন্মদিন ১৪ সাবান । তাই তারা এ দিনে হালুয়া রুটি পাকায় । ভালো ভালো পোশাক পড়ে ইত্যাদি । আর শিয়াদের থেকে ধার করা এসব নিয়ম মানতে গিয়ে আমাদের মা-বোনেরা কত কিছুই না করে ! রুটি বেলতে গিয়ে হাতে ফোস্কা পড়ে যায় ।

 

এরপর যখন ক্লান্ত অবসন্ন হয়ে যায় তখন শরীর এলিয়ে দেয় বিছানায়। ক্লান্ত শরীরে মূহুর্তের মধ্যে ঘুম আসে । ভালো খাবার এবং ঘুমে বরকতের রাত শেষ । এটাই কি আমাদের শবে বরাতের আমল ? আর পটকাবাজি আসছে হিন্দু সংস্কৃতি থেকে।‌ হিন্দুরা হোলির দিনে এভাবে পটকা ফুটায় যেমন এখন মুসলমানের সন্তানরা প্রকাশ করছে । অথচ মুসলমানের প্রতিটি কাজ, প্রতিটি পদক্ষেপ নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদর্শ ও সুন্নাহ অনুযায়ী হওয়া উচিত ।‌ আল্লাহ তাআলা সবাইকে সত্যটা বোঝার তাওফীক দান করুন ।‌ আমীন।‌

 

 

শবে বরাতে গোসলের হুকুম কী ?

 

শবে বারাআতের রাতে গোসল করাকে সুন্নাত/ মুস্তাহাব মনে করা স্পষ্ট বিদআত ।‌ এতে কোন সন্দেহ নেই । শবে বরাতের রাতে গোসল করার কথা কোন হাদীসে আসেনি । কোন নির্ভরযোগ্য কিতাবে পাওয়া যায় না ।‌

 

 

বাজারে প্রচলিত ছোটখাটো বইয়ের মধ্যে গোসল করার কথা বর্ণিত হয়েছে ।‌ যার সবই জাল ও বানোয়াট ।‌ এসবের উপর বিশ্বাস করার কোন সুযোগ নেই ।

রাসুলে আরাবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং সাহাবা-তাবেয়ীন উপরোক্ত রাতে গোসল করেছেন মর্মে কোন বর্ণনা কেউ দেখাতে পারবে না ।‌ অতএব গোসল করা থেকে বিরত থাকুন ।

( আল বাহরুর রায়েক-২/৫২)

 

পড়ুন – শবে বরাতের নামাজের নিয়ম

 

 

 

 

 

। ২. সালাতুত তাওবার নামাজ পড়তে পারেন। কারো থেকে কোন পাপ সংগঠিত হয়ে গেলে তৎক্ষণাৎ পবিত্রতা অর্জন করে দুই রাকাত নফল নামাজ পড়ে আল্লাহর নিকট অনুনয় বিনয় করে ক্ষমা প্রার্থনা করাকে তাওবার নামাজ বলে ।

 

এই নামাজের সময় নিজের পাপের কারণে অনুতপ্ত হতে হবে এবং ভবিষ্যতে না করার জন্য পাকাপোক্ত ইরাদা করতে হবে । তাহলে আল্লাহ তার পাপের ক্ষমা করবেন ।‌

হযরত আলী রাদিআল্লাহু আনহু বলেন, আমাকে হযরত আবু বকর রাদিআল্লাহু আনহু বলেছেন । তিনি সত্য বলেছেন, তিনি বলেছেন যে আমি নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি যে কোন ব্যক্তি গোনাহ করে অতঃপর উঠে (অজু-গোসল) দ্বারা পবিত্রতা অর্জন করে এবং কিছু নামাজ পড়ে অতঃপর আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করে আল্লাহ নিশ্চয়ই তার গোনাহ ক্ষমা করে দেন । অতঃপর নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি আয়াত পাঠ করলেন তার অর্থ-

তারা যখন কোন গোনাহের কাজ করে বসে অথবা নিজেদের প্রতি জুলুম করে বসে আল্লাহকে স্মরণ করে এবং নিজেদের গুনাহের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে ( আবু দাউদ ও তিরমিজি )

৩. তাহাজ্জুদ নামাজ পড়তে পারেন । তাহাজ্জুদ নামাজের মাধ্যমে আল্লাহর সঙ্গে বান্দার গভীর সম্পর্ক স্থাপিত হয় । তাহাজ্জুদ নামাজের ফজিলত সম্পর্কে অসংখ্য হাদীস রয়েছে । সেখান থেকে দু একটি উল্লেখ করছি । হযরত আবু হুরায়রা রাদিআল্লাহু আনহু বলেন আমি নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছিঃ ফরজ নামাজের পর নফল নামাজের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মর্যাদা নামাজ হলো রাতের নামায অর্থাৎ তাহাজ্জুদ নামাজ । ( মুসলিম ও মুসনাদে আহমাদ)

 

 

হযরত আবু মালেক আশআরী রাদিআল্লাহু আনহু বলেন, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, জান্নাতে এমন কিছু (সুন্দর) কক্ষ আছে যার ভিতর থেকে বার দেখা যায় আর বার থেকে ভেতর দেখা যায় । আল্লাহ তাআলা সেগুলো ওই সব লোকদের জন্য তৈরি করেছেন যারা মেহমানদারী করে । বেশি বেশি সালাম করে এবং রাতের বেলায় নামাজ পড়ে । যখন অন্য মানুষ ঘুমন্ত থাকে । (সহীহ ইবনে হিব্বান )

তাহাজ্জুদ নামাজ দুই রাকাত থেকে শুরু করে ১২ রাকাত পর্যন্ত পড়া যায় । নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাধারণত ৮ রাকাত পড়তেন বিধায় তাকে উত্তম বলা হয়েছে । সুযোগ পেলে ৮ রাকাত নতুবা ৪ রাকাত আর তাও হিম্মত না হলে ২ রাকাত হলেও পড়ুন ।

তাহাজ্জুদের নামাজে যে কোন সূরা দিয়ে পাঠ করা যায় । তবে কিরাত লম্বা হওয়া উত্তম । তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ত এভাবে করা যায়- আমি দুই রাকাত তাহাজ্জুদের নিয়ত করছি ।‌

৪. সালাতুল হাজাত নামাজ পড়তে পারেন । আল্লাহর নিকট বা বান্দার নিকট বিশেষ কোনো প্রয়োজন হলে কিংবা শারীরিক মানসিক যেকোনো পেরেশানি দেখা দিলে উত্তম ভাবে ওযু করে দুই রাকাত নফল নামাজ পড়া‌ । এটাকে সালাতুল হাজত বলে ।‌ অতঃপর আল্লাহর হামদ ও ছানা এবং দরুদ শরীফ পাঠ করে আল্লাহর নিকট দুআ করা ।

৫. সালাতুত‌ তাসবীর নামাজ পড়তে পারেন ।

 

সালাতুত তাসবীহ নামাজের নিয়ম

 

হযরত ইবনে আব্বাস রাদিআল্লাহু তাআলা আনহু থেকে বর্ণিত । নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আব্বাস ইবনে আবদুল মুত্তালিবকে বলেছেন, ‌হে চাচা ! আমি কি আপনাকে দেব না ? আমি কি আপনাকে প্রদান করব না ? আমি কি আপনার নিকটে আসবো না ? আমি কি আপনার জন্য দশটি সৎগুণের বর্ণনা করব না ! যা করলে আল্লাহ তাআলা আপনার আগের ও পেছনের, নতুন ও পুরাতন, ইচ্ছায় ভুলবশতকৃত ,ছোট-বড় , গোপন ও প্রকাশ্য সকল গুনাহ মাফ করে দেবেন ।

 

শবে বরাতের নামাজের নিয়ম

আর সে দশটি সৎগুন হলো আপনি চার রাকাত নামাজ পড়বেন । প্রতি রাকাতে সূরা ফাতিহা ও অন্য একটি সূরা পড়বেন । প্রথম রাকাতে যখন কেরাত পড়া শেষ করবেন তখন দাঁড়ানো অবস্থায় ১৫ বার বলবেন-

سُبْحَانَ اللَّهِ وَالْحَمْدُ لِلَّهِ وَلَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَاللَّهُ أَكْبَرُ

 

( উচ্চারণঃ সুবহানাল্লাহি ওয়ালহামদু লিল্লাহহি ওয়ালা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার)

এরপর রুকুতে যাবেন এবং রুকু অবস্থায় উক্ত দোয়াটি দশবার পড়বেন । এরপর রুকু থেকে মাথা উঠাবেন এবং দশবার পড়বেন ।‌ এরপর সিজদায় যাবেন । সেজদারত অবস্থায় দশবার পড়বেন । এরপর সিজদা থেকে মাথা উঠাবেন এবং ১০ বার পড়বেন। এরপর আবার সিজদায় যাবেন এবং সেজদারত অবস্থায় ১০ বার পড়বেন । এরপর সিজদা থেকে মাথা উঠাবেন এবং দশবার পড়বেন । এই হল প্রতি রাকাতে ৭৫ বার ।

আপনি চার রাকাতে‌ অনুরূপ করবেন । যদি আপনি প্রতিদিন করতে পারেন তবে তা করুন । আর যদি না পারেন তবে প্রতি জুমায় একবার করুন । যদি প্রতি জুমায় না করেন তবে মাসে একবার ।‌ আর যদি তাও না পারেন তবে জীবনে একবার করুন ।

( সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নং-১২৯৭, সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস নং-১৩৮৭,সহীহ ইবনে খুজাইমা, হাদীস নং-১২১৬,‌সুনানে বায়হাকী কুবরা, হাদীস নং-৪৬৯৫ )

 

 

হাদীসের মান সহীহ । এই নামাজ পড়ার অন্য হাদীস আছে ।‌ কিছু দীনি ভাই আবার সালাতুত তাসবিহ এর হাদীসকে অস্বীকার করে বসে । এটা তাদের বাড়াবাড়ি এবং অজ্ঞতা ।

 

সালাতুত তাসবিহ নামাজ পড়ার তরীকা

 

চার রাকাত সালাতুত তাসবীহ নফল নামাজ আদায় করছি মনে মনে এতোটুকু খেয়াল রেখে তাকবীরে তাহরীমা বলে হাত বাধতে হবে । এরপর যথারীতি ছানা আউযুবিল্লাহ-বিসমিল্লাহসহ সূরা ফাতিহা ও তার সাথে অন্য সূরা মিলিয়ে পাঠ শেষে দাড়ানো অবস্থায়-

سُبْحَانَ اللَّهِ وَالْحَمْدُ لِلَّهِ وَلَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَاللَّهُ أَكْبَرُ

এই তাসবীহ ১৫ বার পড়বেন‌। তারপর রুকুতে গিয়ে রুকুর তাসবিহ পাঠ করে উক্ত তাসবীহ ১০ বার পড়বেন । এরপর রুকু থেকে উঠে ১০ বার পড়বেন‌ । এরপর সিজদায় গিয়ে সিজদার তাসবীহ পাঠ করে উক্ত তাসবীহ ১০ বার পড়বেন ‌। এরপর প্রথম সিজদা থেকে উঠে বসে দশবার উক্ত তাসবীহ পাঠ করবেন‌। তারপর দ্বিতীয় সিজদায় গিয়ে সিজদার তাসবীহ পাঠ করে উক্ত তাসবীহ ১০ বার পাঠ করবেন । এরপর সিজদা থেকে উঠে বসে ১০ বার পড়বেন । এই হলো এক রাকাতে মোট ৭৫ বার । এরপর আল্লাহু আকবার বলা ব্যতীত দ্বিতীয় রাকাতে উঠবেন । এইরূপে দ্বিতীয় রাকাত পড়বেন । যখন দ্বিতীয় রাকাতে আত্তাহিয়্যাতু পড়ার জন্য বসবেন তখন আগে উক্ত তাসবীহ ১০ বার পড়বেন । তারপর আল্লাহু আকবার বলে তৃতীয় রাকাতে আগের নিয়মে তাসবিহ পাঠ করবেন । তবে চতুর্থ রাকাতে উঠবার সময় দ্বিতীয় রাকাতে ন্যায় আল্লাহু আকবার বলা ব্যতীত উঠবেন । যেহেতু এখানে আগেই আল্লাহু আকবার বলা হয়েছে। চতুর্থ রাকাতে শেষ বৈঠকের আগে দশবার উক্ত তাসবীহ পাঠ করবেন ।

 

এভাবে চার রাকাতে সর্ব মোট তিনশত বার উক্ত তাসবিহ পাঠ করবেন । কোন স্থানে উক্ত তাসবীর সম্পূর্ণ বা আংশিক ভুলে গেলে পরবর্তীতে যে কোন রোকনে আদায় করে নিলেই হয়ে যাবে । এই হল সালাতুত তাসবীহ নামাজে নিয়ম ।

নোট: সালাতুত তাসবীহ নামাজ জামায়াতের সাথে পড়া জায়েজ নয় । এটি একাকী আদায় করতে হবে । এই নামাজ রাতে পড়া উত্তম।

আরেকটি জরুরী কথা শবে বরাতের নফল ইবাদত করতে গিয়ে যেন ফজরের নামাজ কাজা না হয়ে যায় সেদিকে খেয়াল রাখা । যদি ইবাদত করতে গিয়ে মাঝ রাতে ঘুমিয়ে ফজর কাজা করে তাহলে ওই নফল ইবাদত না করাই উত্তম ।

 

কেননা সারারাত জেগে নফল ইবাদতের যে সওয়াব হয়েছে ফজরের নামাজ কাজা করে তার চেয়ে বেশি গোনাহ হয়েছে। এজন্য রাত জাগতে হলে ইশা এবং ফজরের নামাজ যেন সঠিক সময়ে হয় তার প্রতি সবিশেষ লক্ষ্য রাখতে হবে । একটি হাদীস শুনুন । হযরত উসমান রাদিআল্লাহু আনহু বলেন , নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি ইশার নামাজ জামাতের সঙ্গে আদায় করল সে যেন অর্ধরাত্রি নফল ইবাদত করল । আর যে ফজরের নামাজ জামাতে আদায় করল সে জন্য পূর্ণ রাত নফল নামাজ আদায় করল । (মুসলিম ও তিরমিজী )

 

শবে বরাতের রোজা কয়টি ?

 

মূলত শবে বারাআতের একটি রোজার কথা এসেছে । এই হাদীসটি লক্ষ্য করুন ।

হযরত আলী বিন আবু তালিব রাদিআল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত ‌। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যখন শাবান মাসের অর্ধেকের রজনী আসে ( শবে বারাআত) তখন তোমরা রাতে নামাজ পড়ো আর দিনের বেলা রোজা রাখ নিশ্চয় আল্লাহ এড়াতে সূর্য ডোবার সাথে সাথে পৃথিবীর আসমানে এসে বলেন, কোন গোনাহ ক্ষমা প্রার্থী আছে কি আমার কাছে ? আমি তাকে ক্ষমা করে দেবো ।‌ কোন রিজিক প্রার্থী আছে কি? আমি তাকে রিজিক দেবো ।‌

শবে বরাতের রোজা

কোন বিপদগ্রস্থ মুক্তি পেতে চায় কি ? আমি তাকে বিপদ মুক্ত করে দেবো‌ । আছে কি এমন ? আছে কি তেমন ? এমন বলতে থাকেন ফজর পর্যন্ত ।

(সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস নং-১৩৮৮, শুয়াবুল ঈমান, হাদীস নং-৩৮২২ )

শবে বারাআতের একটি রোজার পাশাপাশি একান্ত যদি কারো রোজা রাখার ইচ্ছা থাকে তাহলে আইয়ামে বীযের রোজা রাখতে পারেন । আইয়ামে বীজ অর্থ উজ্জ্বল রাতের দিনগুলো । চন্দ্র মাসের ১৩,১৪,ও ১৫ তারিখকে আইয়ামে বীজ বলা হয় । হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস রাদিআল্লাহু তাআলা আনহু কর্তৃক বর্ণিত এক দীর্ঘ হাদিসের শেষাংশে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, প্রতি মাসে তিনটি নফল রোজা রাখো । কেননা প্রত্যেকটি নেকী কমপক্ষে ১০ গুণ বর্ধিত করে দেওয়া হয় । এভাবে সারা বৎসর নফল রোজা রাখার সওয়াব হবে ।

 

 

( সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিম )

হযরত আবু যর গিফারী রাদিআল্লাহু তাআলা আনহু থেকে বর্ণিত।‌ নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ হে আবূ যর ! প্রতি মাসে তিন দিন নফল রোজা রাখতে চাইলে ১৩,১৪ ও ১৫ এই তিন দিন রাখবে । ( জামে তিরমিজি ও নাসায়ী শরীফ )

শবে বারাআতের একটি নফল‌ রোজা আর আইয়ামে বীজের তিনটি রোজা । মোট চারটি রোজা রাখতে পারেন।‌ আর যদি আইয়ামে বীজের তিনটি রোজা না রাখলেও শুধু শবে বরাতের একটি রোজা রাখতে পারেন । আর যদি‌ একটি রোযাও না থাকেন তাহলে কোন গুনাহ হবে না । শুধু সওয়াব থেকে বঞ্চিত হবেন । এ কথা জোর দিয়ে বলা যায় ।

 

 

শবে বরাতের করণীয় ও বর্জনীয়

 

শবে বারাআতে আমাদের করণীয় হচ্ছে বেশি বেশি ইস্তেগফার করা । আল্লাহর কাছে গুনাহ মাফের জন্য কান্নাকাটি করা । দুআ করা , কোরআন তেলাওয়াত করা । অনির্ধারিতভাবে নফল নামাজ পড়া। জিকির-আজকার ইত্যাদি করা উত্তম ও ফজিলতপূর্ণ ।

 

 

এসব নফল ইবাদত । করলে সওয়াব আছে । না করলে কোন গোনাহ হবে না ।

শবে বরাতে আমাদের বর্জনীয় কাজ হল আতশবাজি করা । হালুয়া-রুটির আয়োজন করা । বিশেষ পদ্ধতির নামাজ পড়াকে জরুরী মনে করা । এ রাতে গোসল করাকে সওয়াবের কাজ মনে করা এবং মসজিদে গিয়ে সম্মিলিত ভাবে রাত জাগা ইত্যাদি কাজ করা বিদআত ।

 

শবে বরাতের ভাগ্য নির্ধারণ

 

সমাজে প্রচলিত আছে শবেবরাত ভাগ্য রাত নামে ।‌‌ অনেক বক্তা এবং সাধারণ মুসলমান এসব কথা বলে বেড়ায় ।‌‌ কিন্তু বাস্তব কথা হচ্ছে  বরাত মূলত ভাগ্য রজনী নয় । এটা হচ্ছে মুক্তির রাত ।‌ ক্ষমা পাওয়ার রাত। আল্লাহর রহমত লুফে নেওয়ার রাত । তবে যারা শবে বরাতকে ভাগ্য রাত বলে তারা এই আয়াত থেকে ভুল বুঝেছে ।

حٰمٓ ۚۛ . وَالۡکِتٰبِ الۡمُبِیۡنِ .اِنَّاۤ اَنۡزَلۡنٰہُ فِیۡ لَیۡلَۃٍ مُّبٰرَکَۃٍ اِنَّا کُنَّا مُنۡذِرِیۡنَ.

فِیۡہَا یُفۡرَقُ کُلُّ اَمۡرٍ حَکِیۡمٍ. اَمۡرًا مِّنۡ عِنۡدِنَا ؕ  اِنَّا کُنَّا مُرۡسِلِیۡنَ ۚ .

رَحۡمَۃً مِّنۡ رَّبِّکَ ؕ  اِنَّہٗ ہُوَ السَّمِیۡعُ الۡعَلِیۡمُ ۙ .

অনুবাদ: হা-মীম। শপথ সুস্পষ্ট কিতাবের। আমি একে নাযিল করেছি। এক বরকতময় রাতে, নিশ্চয় আমি সতর্ককারী। এ রাতে প্রত্যেক প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয় স্থিরীকৃত হয়। আমার পক্ষ থেকে আদেশক্রমে, আমিই প্রেরণকারী। আপনার পালনকর্তার পক্ষ থেকে রহমতস্বরূপ। তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ। ( সুরা দুখান, আয়াত ১- ৬)

এই আয়াতে মোবারক রাত দ্বারা শবে বরাত উদ্দেশ্য নিয়ে ভুল করেছে । মূলত মোবারক রাত দ্বারা শবে কদর উদ্দেশ্য । আর শবে কদর মূলত ভাগ্য রজনী । শবে বরাত নয় ।

 

শবে বরাতে যাদের দোয়া কবুল হয় না

 

হযরত আবু মুসা আশ’আরী রাদিআল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত । রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন ,

আল্লাহ তাআলা মধ্য শাবানের রাতে আত্মপ্রকাশ করেন । এবং মুশরিক ও হিংসুক ব্যতীত সকল সৃষ্টিকে ক্ষমা করে (ইবনে মাজাহ, হাদীস নং ১৩৯০, হাদীসের মান হাসান সহীহ )

হাদীস থেকে বোঝা গেল মুশরিক এবং হিংসুক ব্যক্তিরা ক্ষমা পায় না । অন্য কিতাব থেকে জানা যায় ৮ ব্যক্তিকে এ রাতে আল্লাহ তাআলা ক্ষমা করেন না ,যদি তারা খাঁটিভাবে তাওবা না করে । ১. মুশরিক ২. জাদুকর ৩. গণক ৪. মদ্যপ ৫. সুদখোর ৬. পিতা-মাতার অবাধ্য সন্তান ৭. আত্মীয়তা ছিন্নকারী ৮. ব্যভিচারী ও হিংসুক ।

 

শবে বরাতের আমল

 

অন্যান্য হাদীস থেকে শবে বরাতে তিনটি আমল প্রমাণিত হয়েছে । ১. কবর জিয়ারত করা । নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যেহেতু বরাতের রাতে জান্নাতুল বাকি নামক মদিনার একটি কবরস্থানে গিয়েছিলেন জিয়ারতের জন্য অতএব এই রাতের জন্য কবরস্থানে যাওয়া জায়েজ আছে । তবে এই আমলটি কে অত্যাবশ্যকীয় মনে করা যাবে না ।‌‌ কেননা এখানে একটা বিষয় লক্ষণীয় আর তা হল নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কবর জিয়ারত করতে গিয়েছিলেন একাকী । কাউকে ডেকে জামাত সহকারে আড়ম্বর করে যাননি ।

এটা আবশ্যক পর্যায়ের বা সকলের করণীয় পর্যায়ের বিষয় হলে অবশ্যই নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সকলকে ডেকে জামাতের সাথে তা করতেন । অতএব কেউ চাইলে আড়ম্বর ছাড়া কবরস্থানে গিয়ে কবর জেয়ারত করে আসতে পারেন । তবে প্রত্যেকটা আমল সেভাবে করতে হবে যে ভাবে কোরআন হাদীসে এসেছে ।

স্মরণ রাখতে হবে কবর জিয়ারত মৃতদের জন্য এক ধরনের ইছালে ছাওয়াব । ইছালে ছাওয়াব এর অর্থ হল সওয়াব পৌঁছে দেওয়া । যারা দুনিয়া থেকে চলে যান তাদের কাছে আমরা বিভিন্ন ভাবে সওয়াব পৌঁছাতে পারি । দোয়া করলেও তার সওয়াব পৌঁছে । যেকোনো ইবাদাত করে নফল নামাজ পড়ে, কোরআন তেলাওয়াত করে, জিকির-আজকার করে দান সদকা করে যেকোনো ভাবে নফল ইবাদত করে তাদের কাছে সওয়াব পৌঁছাতে পারি । এটাকে বলে  ইসালে সওয়াব। ঐ রাতে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুমিন নর- নারীর জন্য দোয়া করেছিলেন । শহীদদের স্মরণে দোয়া করেছিলেন এগুলো ইছালে ছাওয়াব পর্যায়ভুক্ত ।  তাই এরাতে  মৃতদের জন্য অন্য যেকোন ভাবে এসব করা যায় করা যায় । গরিবদের জন্য কিছু আহার এর মাধ্যমে ব্যবস্থা করা যায় এদিকে খেয়াল রাখা । তবে অবশ্যই সেটা যেন হালুয়া-রুটি না হয় সেদিকে খেয়াল রাখা ।

২. রাত জেগে ইবাদত করা ।

ইবাদতের মধ্যে নামাজের পর সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ইবাদাত হচ্ছে দুআ করা । অন্য হাদীসে ডাকে সমস্ত ইবাদতের মূল বলা হয়েছে ।‌‌তাই বরাতের রাতে দুআ করে আল্লাহর কাছে সবকিছু চেয়ে নেওয়া প্রয়োজন ।‌‌যেহেতু তিনি এই রাতে সৃষ্টির দিকে মনোযোগ দেন এবং দয়ালু ভূমিকায় অবতীর্ণ হন ।‌‌ তাই যত সম্ভব ততো বেশি দুআ করা উচিত ।  কারো মনে প্রশ্ন আসতে পারে

তাকদীরে সব লেখা থাকলে দুআ করতে হবে কেন? 

উত্তরটা একটু ভালো করে বুঝুন ।

তাকদীর অর্থ ভাগ্য, অদৃষ্ট, নসিব ইত্যাদি  ৷ শরীয়াতে তাকদীরের প্রতি ঈমান রাখা গুরুত্ত্বপূর্ণ একটি বিষয় ৷ ঈমানে মুফাসসালে বর্ণিত একটা অংশ ৷ পবিত্র হাদীসে পরিষ্কার এসেছে মাতৃগর্ভে সন্তান প্রতি চল্লিশ দিনে রুপান্তরিত হওয়ার শেষ সময়ে ফেরেশতা প্রেরিত হন ৷ তিনি (ফেরেশতা) তার ভেতর রুহ ফুঁকে দেন। তাঁকে চারটি বিষয় লিখে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়৷ জীবিকা, বয়স, আমল ও তার সৌভাগ্য-দুর্ভাগ্য। (সহীহ বুখারী: হাদীস নং  ৩২০৮)
হাদীসের বিবরণ দ্বারা বুঝা গেলো মানুষের ভাগ্য তার জন্মের পূর্বেই নির্ধারিত হয়ে যায়। আর একটু ক্লিয়ার করে বুঝুন!
আল্লাহ তাআলা দুনিয়াতে বান্দাকে পাঠান ভাগ্য নির্ধারণ করে দিয়ে ৷ এবং কোন কাজ করতে বান্দাকে বাধ্য করেন না। বরং তাকে ভালো- মন্দ সব কাজের স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে। কিন্তু আল্লাহ তাআলা যেহেতু সর্ব বিষয়ে জ্ঞাত। তাই তিনি আগে লিখে রেখেছেন বান্দা কী করবে? এটাই তাকদীর। আর আল্লাহর এ লিখে রাখা বান্দার কর্মের উপর কোন প্রভাব সৃষ্টি করে না। তাই, বান্দা তার কর্ম অনুপাতে ফল পাবে। ভালো করলে ভালোর প্রতিদান ৷ আর মন্দ করলে শাস্তির বিধান ৷ আর বান্দা যেহেতু জানে না, আল্লাহ তাআলা কি লিখে রেখেছেন, তাই বান্দার উচিত ভাল কর্ম করতে সর্বদা সচেষ্ট থাকা। এবং মন্দ কর্ম থেকে নিজেকে বিরত রাখা। পাশাপাশি বান্দার কর্তব্য হলো বেশি বেশি দুআ করা ৷ কুরআনের ঘোষণায়—
ইউনুুস আলাইহিস সালাম  যদি আল্লাহর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা না করতো তাহলে তাকে মাছের পেটে কিয়ামত পর্যন্ত থাকতে হতো। (সূরা সাফফাত: আয়াত নং ১৪৩, ১৪৪ )
যেহেতু তিনি দুআ করেছিলেন তাই আল্লাহ তাকে মাছের পেট থেকে বের করে অনুগ্রহ করেছেন ৷  এ ব্যাপারে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
দুআ ব্যতীত অন্য কোন কিছুই ভাগ্যের পরিবর্তন করতে পারে না এবং সৎকাজ ব্যতীত অন্য কোন কিছুই হায়াত বাড়াতে পারে না। (জামে তিরমিজি: হাদীস নং ২১৩৯)
উপরোক্ত আয়াতে কারীমা এবং সহীহ হাদীসের আলোকে বুঝা গেলো দুআ ভাগ্যকে পরিবর্তন করতে পারে ৷ অতএব সবকিছু পূর্ব থেকে তাকদীরে লেখা থাকলেও বিপদ-আপদ থেকে বাঁচতে দুআ করতে হবে ৷
আর হ্যাঁ তাকদীর নিয়ে বেশি বেশি আলোচনা, গবেষণা করা ,প্রশ্ন করা নিষেধ ৷ কেননা তাকদীর এটি আল্লাহ তাআলার গোপন রহস্য। এ রহস্য সম্পর্কে কোন ফেরেশতা বা কোন নবীও ওয়াকিফহাল নন। তাই এ বিষয়ে আমাদের চিন্তা ফিকির করা নিজের ঈমানের ক্ষতি করা ছাড়া আর কোন ফায়দা নেই।
হযরত আবু হুরায়রা রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। একদা রাসুল সাল্লাল্লাহু  আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের কাছে আসলেন এমতাবস্থায় যে, আমরা তাকদীর বিষয়ে আলোচনা করছিলাম। তখন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রচন্ড রেগে গেলেন।রাগে চেহারা আনারের মত রক্তিম বর্ণ হয়ে গেল। তিনি বললেন, তোমরা এ এসব করতে আদিষ্ট হয়েছো? নাকি আমি এসবের জন্য আবির্ভূত হয়েছি? ইতোপূর্বের লোকজন এ বিষয়ে আলোচনা করে ধ্বংস হয়েছে, আমি তোমাদের দৃঢ়তার সাথে বলছি, তোমরা এ বিষয়ে বিবাদে লিপ্ত হয়ো না। (তিরমিজী, হাদীস নং-২১৩৩)
আরও একটি হাদীস দেখুন!  হযরত ইয়াহইয়া বনি আব্দুল্লাহ বিন আবী মুলাইকা তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন, তিনি একদা হযরত আয়শা রাদিআল্লাহু তাআলা আনহা এর নিকট গেলেন। তখন তিনি তাকদীর বিষয়ে তাকে কিছু জিজ্ঞাসা করেন, তখন হযরত আয়েশা রাদিআল্লাহু তাআলা আনহা বলেন, আমি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি যে, যে ব্যক্তি তাকদীর বিষয়ে কথা বলে, কিয়ামতের ময়দানে এ কারণে সে জিজ্ঞাসিত হবে। আর যে এ বিষয়ে আলোচনা না করবে, তাকে জিজ্ঞাসা করা হবে না। (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস নং-৮৪ )

৩. পর দিন রোজা রাখা ।

শবেবরাত সহ অন্যান্য রোজা পালনের ক্ষেত্রে মহিলারা অগ্রণী ভূমিকা পালন করে । তারাই বেশি রোজার খোঁজখবর নিয়ে থাকে । এজন্য মহিলাদের পাশাপাশি পুরুষদেরও নফল রোজার আগ্রহী হওয়ার প্রয়োজন । এই প্রবন্ধের শুরুর দিকে রোজা সংক্রান্ত আলোচনা করা হয়েছে ‌‌। খেয়াল করে পড়ুন । আশা করি নতুন করে আর প্রশ্ন থাকবে না ।

তবে শবে বরাতের আমল সম্মিলিতভাবে নয় । রাতের ইবাদত শুধুমাত্র ব্যক্তিগত । বিশুদ্ধ মতানুসারে এটাই সহীহ কথা । ফরজ নামাজ তো অবশ্যই মসজিদে গিয়ে আদায় করতে হবে । এরপর যা কিছু নফল পড়ার তা নিজে নিজে ঘরে পড়তে পারেন। এসব নফল আমলের জন্য দলে দলে মসজিদে হাজির হওয়ার কোন হাদীস নেই । সাহাবায়ে কেরামের যুগে এই রেওয়াজ ছিল না । ( মারাকিল ফালাহ ২১৯)

শবে বরাতের আমল

 

আর হ্যাঁ যদি ঘরে আমলের পরিবেশ না থাকে এবং কোন আহ্বান ও ঘোষণা ছাড়া এমনিতেই কিছু লোক মসজিদে এসে যায় তাহলে প্রত্যেকে নিজ নিজ আমলে মশগুল থাকবে। একে অন্যের আমলের কোন ডিস্টার্ব করবে না । তাহলে এতে কোন দোষ দেখি না ।

কিন্তু অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে শবে বরাতের অধিকাংশ শহর-গ্রামের মসজিদে মাগরিব বা ইশার পর থেকে ওয়াজ নসীহত আরম্ভ হয় । আবার কোথাও কোথাও ওয়াজের পর মিলাদ মাহফিলের অনুষ্ঠান হয় । তবারক নিয়ে কাড়াকাড়ি হয় । কোথাও তো সারারাত মাইকে খতমে সবীনা পড়া হয় । এসব গুলো হচ্ছে সমাজে প্রতিষ্ঠিত ভুল আমল । আর বারাআতের রাতে কবর জিয়ারত করতে যাওয়া এটাও জরুরী নয় । বিভিন্ন মাজারগুলো এরাতে বিশেষ ভাবে সাজানো হয় । শরীয়ত বহির্ভূত আরো অনেক কিছু করা হয় ।সেখানে অংশগ্রহণ করা বা আত্মীয় স্বজনের কবর জিয়ারত করতে গিয়ে বাড়াবাড়ি করা কখনই সমীচীন নয় । ঘরে বসে থেকেও তো‌ পুরুষ-নারী ঈসালে সাওয়াব করতে পারেন ।‌

 

 

শাবান মাসের ফজিলত ও আমল‌

 

আরবী ১২ মাসের মধ্যে অন্যতম একটি হচ্ছে সাবান ।

সাবান ( شعبان )অর্থ বিস্তৃত হওয়া, ছড়িয়ে পড়া ইত্যাদি । এ মাসে আল্লাহ তাআলা পৃথিবীবাসীর উপর রহমত বিস্তার করেন । এই কারণে একে সাবান বলা হয়েছে ।

হযরত উসমান রাদিআল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত ।‌ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- شعبان شهري ورمضان شهر الله

অনুবাদ: শাবান আমার মাস আর রমজান ‌আল্লাহর মাস । ( শুয়াবুল ঈমান )

যে জিনিসের সম্বন্ধ প্রিয় জিনিসের প্রতি হয় তার মূল্য বেড়ে যায় ।‌ যেমন যায়েদ ইবনে হারেসা রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর গোলাম ছিলেন নবীজির দিকে নিসবত করার কারণে তার মূল্য বেড়ে গেছে সবার উপর । পৃথিবীতে অসংখ্য মসজিদ রয়েছে । কিন্তু মসজিদে নববী বললে তার মর্যাদা অন্যান্য মসজিদ থেকে বেশি ।‌ নবীর দিকে নিসবত হওয়ায় সেখানে নামায পড়লে সওয়াবও বেশি । তেমনি ভাবে নবীজি সাবানকে নিজের দিকে সম্বন্ধ করায় এ মাস রমজান ছাড়া সকল মাস থেকে উত্তম ও শ্রেষ্ঠ ।

শেখ আব্দুল কাদের জিলানী রহ: বলেন شعبان শব্দের মাঝে মোট ৫ টি হরফ রয়েছে। যেমন ش- ع-ب-ا-ن

এই ৫ টি হরফ দ্বারা পাঁচটি জিনিসের দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে ।

১. ش দ্বারা شرف অর্থাৎ সম্মান ২. ع দ্বারা علو অর্থাৎ সমৃদ্ধি ৩. ب দ্বারা بر অর্থাৎ নেকী ৪. الف দ্বারা الفت অর্থাৎ ভালোবাসা ৫. ن দ্বারা نور অর্থাৎ আলো ।

এক কথায় কোন বান্দা যদি শাবান মাসে বেশি বেশি ইবাদত-বন্দেগী করে তাহলে আল্লাহর পক্ষ থেকে সে সম্মান, সমৃদ্ধি ,নেকী, আল্লাহর ভালবাসা ও ঈমানের নূর অর্জন করতে পারবে ।‌ ( গুনিয়াতুত তালেবীন , পৃষ্ঠা নং ৪৪৫)

 

শবে বরাতের আমল

এই শাবান মাসের মধ্যেই কেবলা পরিবর্তন হয়েছে ।‌বায়তুল মুকাদ্দাসের পরিবর্তে বায়তুল্লাহ দিকে মুখ করে নামাজ পড়ার নির্দেশনা এসেছে । তাই শাবান মাসে এক দিকে যেমন মুসলিম স্বাতন্ত্র্য ও ইসলামী ঐক্যের মাস ‌অন্যদিকে কাবা কেন্দ্রিক মুসলিম জাতীয়তাবোধে উজ্জীবিত হওয়ার মাস । হযরত আনাস রাদিআল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত । রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রজব-শাবান মাস থেকে এই দোয়াটি বেশি করে পাঠ করতেন ।

اَللّٰهُمَّ بَارِكْ لَنَا فِىْ رَجَبَ وَ شَعْبَانَ وَ بَلِّغْنَا رَمَضَانَ.

অনুবাদ: হে আল্লাহ পাক আপনি আমাদেরকে রজব ও শাবান মাসে বরকত দান করুন এবং রমযান শরীফ পর্যন্ত পৌঁছে‌‌ দেন । ( মু’জামে ইবনে আসাকীর, হাদীস নং-৩০৯, মুসনাদুল বাজ্জার, হাদীস নং-৬৪৯৪, শুয়াবুল ঈমান, হাদীস নং-৩৫৩৪, মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং-২৩৪৬)

অতএব শাবান মাসে নফল নামাজ , নফল রোজার পাশাপাশি এই দোয়াটি সকাল সন্ধ্যা পাঠ করুন ।

 

শেষকথাঃ

 

সুপ্রিয় পাঠকবৃন্দ ! শবে বরাত নিয়ে তথ্য ভিত্তিক অনেক আলোচনা করা হলো । আজ আর নয় । বিদায় নেওয়ার পূর্বে একটি জরুরী কথা । লেখাটি কেমন হয়েছে জানাবেন।‌ আপনাদের কোন প্রশ্ন থাকলে কমেন্ট করুন । দলীল ভিত্তিক জবাব দেবো ইনশাআল্লাহ । সবাই ভালো থাকুন‌ । সুস্থ থাকুন । শীর্ষবার্তার সাথে থাকুন আল্লাহ হাফেজ ।‌